পাবনার ভাবনা-আত্মতুষ্টি নয়, প্রয়োজন আত্মবিশ্লেষণ by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

পাবনা এখন আমাদের অনেকের ভাবনায়। আমরা যারা সুশাসনের স্বপ্ন দেখি, রাজনীতির দায়বদ্ধতা প্রত্যাশা করি এবং অপরাজনীতির অবসান চাই, তাদেরকে পাবনা অনেক ভাবাচ্ছে। এই ভাবনা এখন মিডিয়াজুড়ে এবং বোধ করি প্রশাসনের প্রায় সবার মধ্যেই। শুধু সরকারের ভেতর এর কোনো প্রকাশ নেই।


পাবনায় একটা ঘটনা ঘটেছিল। এটা ঘটতে দেওয়ায় এবং এর মোকাবিলায় স্থানীয় প্রশাসনের ব্যর্থতা ছিল। এই ব্যর্থতার জন্য প্রশাসনের ওপরের সারির সবাইকে বদলি করা হয়েছে। এখন তদন্ত হবে, তারপর দেখা যাবে, এই ব্যর্থতার জন্য তাদের আর কী শাস্তি দেওয়া যায়—এই হলো সরকারের অবস্থান। সরকারদলীয় অবস্থানটাও প্রায় কাছাকাছি এবং তা এ রকম: পাবনার ডিসি জামায়াত-বিএনপির লোক; তিনি একটি উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সরকারকে বিপদে ফেলতে চেয়েছেন, হয়তো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও বাধাগ্রস্ত করতে চেয়েছেন। ফলে তাঁকে বদলি করাটা সরকারের সময়োপযোগী এবং সঠিক সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সরকার ও আওয়ামী লীগ, উভয়েই ভাবছে, ঘটনাটা এখন অতীত, এ নিয়ে ভাবাভাবির কিছু নেই। বস্তুত খবরের কাগজগুলোতে ঘটনার ১০-১৫ দিন পরও যে এ রকম শিরোনাম আসছে, ‘প্রশাসনে উত্তাপ বাড়াল পাবনা’, ‘প্রশাসনে অসন্তোষ’, ‘প্রশাসনে জুনিয়ররা ক্ষুব্ধ সিনিয়ররা চুপচাপ’—এসব খবরকেও হয়তো ভালো চোখে দেখা হচ্ছে না। এমনিতেই পাবনার ডিসি যেদিন শহরটির নাগরিক সমাজের সঙ্গে সভা করে তার অসহায়ত্বের বর্ণনা দিতে গিয়ে কেঁদেছিলেন, তার সচিত্র প্রতিবেদন টিভিতে-কাগজে দেখানো হলে বলা হয়েছিল, এটি মিডিয়ার অতিরঞ্জন, বাস্তবে কেউ কাঁদেননি। যেখানে এসব প্রতিবেদনকে নিশ্চয় ‘মিডিয়ার বাড়াবাড়ি’ হিসেবেই দেখা হবে।
পাবনার ডিসি তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে ওই সভায় কেঁদেছিলেন কি না; কাঁদলেও একে কান্না বলা যায় কি না, এবং যদি না কাঁদেন, মিডিয়া তাকে কেন কান্না বলল—এসব দার্শনিক প্রশ্নে না গিয়েও বলা যায়, বিষয়টি মানুষের মনে দাগ কেটেছে। জেলা প্রশাসক নাগরিক সমাজের সঙ্গে সভা করে হয়তো চাকরিবিধি লঙ্ঘন করেছেন। সরকার হয়তো এ বিষয়ে তাঁর বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ খাড়া করতেই পারে, কিন্তু মানুষের কাছে চাকরিবিধির এই স্খলনটি বড় হয়ে দেখা দেয়নি, বরং অতিশয় বড় হয়ে দেখা দিয়েছে ডিসির ওপর স্থানীয় এমপি ও আওয়ামী-যুব-ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মীর খবরদারি এবং একটি অনৈতিক কাজে তাঁকে বাধ্য করানোর প্রয়াসটি।
এ দেশের সব মানুষ সক্রিয় রাজনীতি করে না; সব মানুষ টেন্ডার আর তদবিরের পেছনে ছোটে না। বরং বেশির ভাগ মানুষের মনে নৈতিকতার প্রতি একটি প্রবল সমর্থন আছে। এই সমর্থনের কারণেই গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এমন বিশাল বিজয় পেয়েছিল। ২০০১-২০০৬ মেয়াদের জোট সরকারের অপশাসন ও দুর্নীতি মানুষ পছন্দ করেনি; ক্ষমতার দম্ভকে ক্ষমা করেনি এবং হাওয়া ভবন ফেনোমেননটিকে ভালো চোখে দেখেনি। ফলে নির্বাচন বিএনপি-জামায়াতকে জবাব দিয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ নির্বাচন করেছিল ‘পরিবর্তনের’ অঙ্গীকার নিয়ে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে। এখন দেখা যাচ্ছে, পাবনা সেই পরিবর্তনের বাইরে, এবং পাবনা প্রমাণ করেছে, সে যে শুধু ডিজিটাল নয়, তা নয়; অ্যানালগেরও আগের জামানার। বলা বাহুল্য, পাবনা এখন একটি অপচর্চার নাম, একটি প্রবণতার নাম, দেশজুড়ে চলছে যার বিস্তার। সরকারকেও তাই পাবনা নিয়ে ভাবতে হবে। আওয়ামী লীগকেও। পাবনার শিক্ষাগুলো গ্রহণ করে নিজেদের শুধরে নিতে হবে। তা না হলে সামনে যে বিপর্যয়, তা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না।
কী হয়েছিল পাবনাতে? না, ডিসি অফিসে তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের একটা নিয়োগ পরীক্ষা ছিল, ১৭ সেপ্টেম্বর। স্থানীয় এমপি ডিসিকে চাপ দিলেন, তাঁর পছন্দের লোক নিতে হবে। ডিসি রাজি হলেন না। ফলে, যুবলীগ-ছাত্রলীগের একটি বাহিনী সেদিন পরীক্ষাস্থলে হামলা করে পরীক্ষা ভণ্ডুল করেছিল। তারা ধাওয়া করল ডিসিকে, একজন নারী কর্মকর্তাকে। প্রায় প্রতিটি কাগজে এবং টিভি চ্যানেলে মোটামুটি এ-ই ছিল ঘটনার বিবরণ। পত্রপত্রিকা থেকে আরও জানা গেল, ডিসি-এমপির বিরোধটি নতুন নয় এবং এর মূলে রয়েছে আধিপত্যের প্রশ্নটি। এমপির নানা চাহিদা ছিল ডিসি থেকে কিন্তু তিনি সেসব মেটাননি। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, এমপিরই জয় হলো। সমকাল ৩০ সেপ্টেম্বরের একটি সংবাদে জানিয়েছে, পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক বলেছেন, ‘এই ডিসির প্রত্যাহারের মাধ্যমে পাবনা আওয়ামী লীগ এবং সাধারণ মানুষের জয় হয়েছে।’ আওয়ামী লীগের জয়ের বিষয়টা খুবই পরিষ্কার, কিন্তু সাধারণ মানুষের? পাবনায় এখন সরকারি নিয়োগ আওয়ামী লীগের নির্দেশে হবে, এখন ডিসির কাজের খবরদারি করবেন নানা লীগ-নেতারা। এতে সাধারণ মানুষের কী লাভ? তাদের জয়টাই বা কোনখানে?
ডিসির ওপর হামলার ঘটনায় বেশ কিছু নেতা-কর্মীর নামে একটা মামলা হয়েছে। কিন্তু পুলিশ দু-চারজন বাদে আর কাউকে গ্রেপ্তার করেনি। পরে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের নির্দেশে নেতা-কর্মীরা আত্মসমর্পণ করে। আদালত তাদের জামিন না দিয়ে জেলে পাঠান। জেলে যাওয়ার সময় ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতাকে দেখা গেল, ডান হাত উঁচিয়ে দুই আঙুলে বিজয়চিহ্ন দেখাচ্ছে। তার মুখে হাসি। এই বিজয়চিহ্ন কেন, এবং এটি কার বিরুদ্ধে বিজয়—এ নিয়ে একটা ধন্ধ ছিল আমার। পাবনা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদকের বক্তব্যে সেই ধন্ধটি অপসারিত হলো। তাঁকে ধন্যবাদ। এই নেতা-কর্মীরা যেদিন জেল থেকে ছাড়া পাবে, সেদিন নিশ্চয়ই তাদের ‘ফুলেল সংবর্ধনা’ দেওয়া হবে। শেষ খবর হলো, এই নেতা-কর্মীরা একটি মামলায় জামিন পেয়েছে। কিন্তু আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল, পাকিস্তান আমলে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবিতে সংগ্রামরত ছাত্রলীগের নেতাদের যখন পুলিশ জেলে পুরত, জেলগেটে তাঁরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতেন। তখন দুই আঙুলে বিজয়চিহ্ন দেখানোর রেওয়াজ ছিল না। ফলে তাঁদের প্রত্যয়ী হাসিটিই হতো পাকিস্তানি অপদেবতাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামী বাঙালির লড়াইয়ের বিজয়চিহ্ন। যাক সে কথা।
পাবনার ঘটনা থেকে যে বিষয়গুলো বেরিয়ে এল, তা আমাদের মতো আশাবাদী মানুষদেরও হতাশ করেছে। এখন দেশজুড়ে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মীর মধ্যে একটা বেপরোয়া ভাব এসেছে। টেন্ডারবাজি, নানান সন্ত্রাস ও নিয়োগ-বাণিজ্যে তাঁরা লিপ্ত। নিয়োগ-বাণিজ্য এখন পত্রিকার শিরোনামও হচ্ছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদেরই এক কর্মীকে হলের চতুর্থ তলা থেকে ফেলে মেরে ফেলেছে ছাত্রলীগের অন্য কর্মীরা। প্রতিদিনের সংবাদপত্রে খবর থাকে যুব-ছাত্রলীগের সন্ত্রাস নিয়ে। আওয়ামী লীগের নেতাদের এমনকি এমপিদের বেআইনি কাজেরও খবর বেরোচ্ছে প্রায়ই। শিক্ষাঙ্গনগুলোতে ছাত্রলীগের দুই বা তিন উপদলের ভেতর সহিংসতাও চলছে। সেদিন কাগজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ হাসিনার জন্মদিনে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে বের করা মিছিলে ইডেন কলেজের ছাত্রলীগ নেত্রীদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেত্রীদের চুলোচুলির সচিত্র সংবাদ পড়লাম। এক নেত্রীর চুল ধরে অন্যরা টানছে, আর তার পায়ের নিচে পড়ে আছে শেখ হাসিনার ছবিসংবলিত পোস্টার। শেখ হাসিনা জাতিসংঘে ভাষণ দিয়ে দেশে ফিরেছেন, তাঁকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের প্রথম বর্ষের আবাসিক ছাত্ররা যায়নি? সে জন্য কার্জন হলের সামনে ৫০ জন ছাত্রকে রাত একটায় দাঁড় করিয়ে রেখেছিল ওই হলের ছাত্রলীগের এক নেতা। প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দিতে যাওয়াটা যদি রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতা হয়ে থাকে, তাহলে ওদের পাঠানোর ব্যবস্থা তো বিশ্ববিদ্যালয় নিত। তাহলে ছাত্রলীগের ওই নেতা নিশ্চয়ই গুরুতর অপরাধ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল আইনে নিশ্চয়ই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। কিন্তু সে রকমটা ঘটার কোনো সম্ভাবনাও নেই। সারা দেশে এই যে অসংখ্য নেতা আইনকে নিজেদের হাতে তুলে নিচ্ছে, অন্যায় করছে, সন্ত্রাস করছে, পাবনা তাদেরকে উৎসাহিত করবে। তাদের কাছে পাবনা একটা বাণী পৌঁছে দিল: দেশ বড় নয়, দল বড়। এটি কি কাম্য?
প্রশাসনের কাছেও পাবনা একটা বার্তা পাঠাল, এবং তা হলো, দলকে মেনে চলতে হবে। অথচ প্রশাসন রাষ্ট্রের, দলের নয়। কুড়ি বছর ধরে প্রশাসনকে দলীয়করণ করা হয়েছে। যে দল ক্ষমতায় এসেছে, সে দলই চেয়েছে প্রশাসনের মুখ্য সচিব থেকে পিয়ন পর্যন্ত থাকলেই তাঁর হয়ে কাজ করবে। ফলে প্রশাসন স্থবির হয়ে পড়েছে। এমনিতেই আমাদের প্রশাসনের আদলটা উপনিবেশ আমলের। আমলাদের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কটাও ক্ষীণ।
এই আমলাতন্ত্রকে আমূল বদলে ফেলে একে গণমুখী, দক্ষ এবং সক্রিয় করার চেষ্টা করাটাই সব সরকারের জন্য ছিল অবশ্যকর্তব্য। তা না করে একে রাজনীতির একেবারে কেন্দ্রে আনার প্রয়াস চলেছে। প্রজাতন্ত্রে কর্মচারী থাকতে না দিয়ে প্রশাসনের লোকদের দলের মানুষে পরিণত করার চেষ্টা হয়েছে। যাঁরা সৎ থাকতে চেয়েছেন, দলীয় তিলক লাগাতে চাননি কপালে, তাঁদের ওপর খড়্গ নেমে এসেছে। গত ১০ বছরে প্রশাসনে-পুলিশে আমার পরিচিত প্রায় ৩০ জনকে দেখেছি, দলীয় নয় এই বিবেচনায় ওএসডি হয়ে বসে থাকতে। গোপালগঞ্জে বাড়ি হওয়ার ‘অপরাধে’ জোট সরকারের সময় আমার এক ছাত্রের প্রায় চাকরি যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। এ রকম দলীয় পরিচয়প্রধান প্রশাসন স্থবির হয়ে পড়লে দোষ দেবেন কাকে?
সরকারকে তাই ভাবতে হবে। আওয়ামী লীগকে ভাবতে হবে। সারা দেশে লীগের এবং এর সব সহযোগী সংগঠনের সদস্যদের সব অনৈতিক ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কঠোর হাতে দমন করতে হবে। শুধু চার-পাঁচজনকে বহিষ্কার করে একটি খুনের ঘটনা বা টেন্ডার-সন্ত্রাসের ঘটনা মোকাবিলা করা যায় না। এ জন্য অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের একটি প্রিয় উচ্চারণ, ‘অপরাধী যে-ই হোক, পার পাবে না’। এটি একটি ভবিষ্যদ্বাদী দর্শন, এবং বাস্তবে প্রয়োগ প্রায় শূন্য। আশা করি পাবনার মামলা থেকে এই দর্শনের বাস্তবায়ন শুরু হবে।
পাবনা যেন সরকারকে আত্মতুষ্ট না করে। আত্মতুষ্টি নয়, এখন প্রয়োজন আত্মবিশ্লেষণের। নির্বাচন এখনো দূরে, কিন্তু খুব দূরেও নয়। পাবনার মতো ঘটনাগুলো সরকারকে আগামী নির্বাচনে কঠিন বিপদে ফেলবে। গত নির্বাচনে দুই কোটি নতুন ভোটারের যে বেশির ভাগ শেখ হাসিনার পেছনে দাঁড়াল, তারা ছাত্র-যুবলীগের সদস্য নয়। সারা দেশে ছাত্র-যুবলীগের সদস্যসংখ্যা কত? দুই লাখ? পাঁচ লাখ? কিন্তু এদের একটি অংশের জন্য যদি ওই দেড়-পৌনে দুই কোটি ভোটার মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন পাবনার দিকে ফিরে তাকিয়ে আওয়ামী লীগের হা-হুতাশ করা ছাড়া আর কী করার থাকবে?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.