পোশাক শিল্প নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন-শ্রমিক অসন্তোষের জন্য মালিক পক্ষের অন্যায়ই মূলত দায়ী by আবুল কাশেম

পোশাক শিল্পে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হলে মালিকরা এর প্রকৃত কারণ আড়ালে রেখে নানা 'ষড়যন্ত্র' খুঁজে বেড়ান। প্রতিবারই অস্থিতিশীলতার জন্য 'দেশি-বিদেশি' ষড়যন্ত্রের কথা বলেছে মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। গত এপ্রিল-মে মাসের শ্রমিক অসন্তোষের পেছনেও ষড়যন্ত্রকেই কারণ বলে দাবি করেছেন তাঁরা।
অথচ সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সময়মতো বেতন-ভাতা না দেওয়া, বেতন বৃদ্ধির দাবি, অনিয়মতান্ত্রিকভাবে শ্রমিক ছাঁটাই, পিসরেট বাড়ানোর দাবি ও শ্রমিকদের সঙ্গে কারখানাগুলোর মধ্যম সারির কর্মকর্তাদের অসদাচরণ ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার কারণে পোশাক শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি হচ্ছে। গত কয়েক দিনের শ্রমিক অসন্তোষের নেপথ্যেও একই কারণ রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে।
প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, গত ১৬ এপ্রিল থেকে ১৫ মে পর্যন্ত ঢাকা মহানগরী, সাভার ও আশুলিয়া, গাজীপুরের টঙ্গী ও নারায়ণগঞ্জ সদর, ফতুল্লা এবং সিদ্ধিরগঞ্জে যে ১০টি শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর পেছনেই এসব কারণ দায়ী। গার্মেন্ট সেক্টরে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য প্রতিবেদনে মালিকদের আরো বেশি সক্রিয়, আন্তরিক ও যত্নবান হতে সুপারিশ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
পোশাক শিল্প সম্পর্কিত 'ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টবিষয়ক কোর কমিটি'র এক বৈঠকে শিল্প পুলিশের মহাপরিচালক আবদুস সালামও সঠিক সময়ে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ না করা, কারখানা বন্ধ করে দেওয়া, শ্রমিক ছাঁটাই ও পিসরেটকে পোশাক শিল্পে অস্থিতিশীলতার জন্য দায়ী বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, সঠিক সময়ে বেতন পরিশোধ না হওয়ার কারণে গত তিন মাসে ৩৪৮টি কারখানায় সমস্যা সৃষ্টি হয়। ওই বৈঠকে শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মুন্নুজান সুফিয়ান বলেছেন, মিড-লেভেল ম্যানেজমেন্টের (মধ্যম সারির কর্মকর্তা) দুর্ব্যবহারের কারণে অনেক সময় শ্রম অসন্তোষ হয়। সম্প্রতি আশুলিয়ায় হা-মীম গ্রুপের কারখানায় এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা থেকে শ্রম অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছিল।
তবে ওই বৈঠকে বিজিএমইএর প্রতিনিধি বরাবরের মতোই বলেছেন, 'বর্তমানে কমপ্লায়েন্ট (ভালো মানের) কারখানাগুলোয় শ্রম অসন্তোষ সৃষ্টি হচ্ছে। এর সঠিক কারণ উদ্ঘাটন করা প্রয়োজন।' সময়মতো বেতন-ভাতা পরিশোধে বিজিএমইএ তৎপর রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গোপন প্রতিবেদনটি এবং গত ১৬ মে অনুষ্ঠিত ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট-বিষয়ক কোর কমিটির ১১তম সভার কার্যবিবরণী-সংক্রান্ত প্রতিবেদনটিও কালের কণ্ঠের হাতে এসেছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনটি গত ২৯ মে মহাপুলিশ পরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ, শ্রম মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মিকাইল শিপার ও বাণিজ্যসচিব মো. গোলাম হোসেনের কাছে পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদনে ৭৮টি গার্মেন্ট কারখানার নাম-ঠিকানা ও মালিকের নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এসব কারখানায় শ্রমিকদের গত এপ্রিল মাসের বেতন মে মাসের ১৫ তারিখেও দেওয়া হয়নি। এসব কারখানার মালিকদের মধ্যে কেউ কেউ সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও উচ্চবিত্ত।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৬ এপ্রিল থেকে ১৫ মে পর্যন্ত ঢাকা মহানগরী, সাভার ও আশুলিয়া, গাজীপুরের টঙ্গী ও নারায়ণগঞ্জ সদর, ফতুল্লা এবং সিদ্ধিরগঞ্জের কারখানাগুলোতে ১০টি শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে যথাসময়ে বেতন-ভাতা পরিশোধ না হওয়ার কারণে দুটি গার্মেন্ট কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে। আর বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে অসন্তোষ ঘটেছে একটিতে। পিসরেট কম হওয়ার অজুহাতে অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে তিনটি, শ্রমিক ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে একটি ও মধ্যম সারির কর্মকর্তাদের খারাপ আচরণের প্রতিবাদে তিনটি শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব রুখসানা হাসিন স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে শ্রমিক ছাঁটাই সম্পর্কে বলা হয়েছে, 'মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের অবনতি, ফ্যাক্টরির শ্রমিকের শৃঙ্খলাবিরোধী কাজে লিপ্ত হওয়া, বিভিন্ন দাবি আদায়ে সোচ্চার হওয়াসহ অন্যান্য কারণে প্রায়ই অনিয়মতান্ত্রিকভাবে শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়।'
আর কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে মধ্যম সারির কর্মকর্তাদের আচরণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, 'গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে কর্মরত মিডলেভেল ম্যানেজমেন্ট কর্মকর্তাদের সাধারণ শ্রমিকদের সঙ্গে নানা ধরনের অসদাচরণ, শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত, স্বজনপ্রীতি প্রভৃতি কারণে বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে নানা ধরনের শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়।'
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে গার্মেন্টে শ্রম অসন্তোষ দূর করতে তিনটি সুপারিশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিয়মিত পরিশোধ করা, ন্যায্য মজুরি বা পিসরেট (প্রতিপিস পোশাক তৈরির ভিত্তিতে মজুরি) নির্ধারণ ও অনিয়মতান্ত্রিকভাবে শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধসহ মধ্যম সারির কর্মকর্তাদের আচরণগত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। যেসব কারখানা এপ্রিল মাসের বেতন-ভাতা এখনো (১৫ মে) পরিশোধ করেনি, সেসব কারখানায় যেকোনো সময় যেকোনো স্থানে অরাজকতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে। এ ধরনের অরাজকতা বা বিশৃঙ্খলা পরিহারে যত দ্রুত সম্ভব বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
এদিকে ভারপ্রাপ্ত শ্রম পরিচালক আই কে এম এহতেশামুল হক স্বাক্ষরিত ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট-বিষয়ক কোর কমিটির ১১তম সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, শিল্প পুলিশের মহাপরিচালক গার্মেন্ট সেক্টরে শ্রম অসন্তোষ নিরসনে শ্রমিকদের ডেটাবেইস থাকা এবং কারখানা পর্যায়ে শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বমূলক কমিটি থাকার বিষয়ে জোর দিলেও বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ তা মানতে রাজি হয়নি। ওই বৈঠকে বিকেএমইএ সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেছেন, কারখানাগুলোতে দক্ষ শ্রমিকের অভাব থাকায় ডেটাবেইস তেমন কার্যকর করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া বৈঠকে বলা হয়, আশুলিয়া সড়কে সড়ক দুর্ঘটনায় কোনো শ্রমিক আহত হলেও কারখানায় ভাঙচুর শুরু হয়। এ জন্য ওই রাস্তাটিকে চার লেনে রূপান্তর করার পক্ষে মত দেন তাঁরা।
বেতন বকেয়া ফেলা ৭৮ গার্মেন্ট : এপ্রিল মাসের বেতন-ভাতা মে মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে যে ৭৮টি কারখানা পরিশোধ করেনি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে তাদের তালিকা রয়েছে। তালিকায় রয়েছে- অর্থ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এ এইচ এম মোস্তফা কামালের মালিকানাধীন আশুলিয়ার কাইচাবাড়ির লোটাস কামাল লিমিটেড, বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও দেশের অন্যতম বৃহৎ গার্মেন্ট ব্যবসায়ী আনিসুর রহমান সিনহার মালিকানাধীন আশুলিয়ার ওপেঙ্ সুয়েটার লিমিটেড। অন্যগুলো হচ্ছে-
আশুলিয়া এলাকা : বাঁশতলায় মো. দুলালের মালিকানাধীন এভারগ্রিন ফ্যাশন, শিমুলতলায় মুসফিক আল সালেহীনের পার এক্সিলেন্স ফ্যাশন, আশুলিয়া বাজারে হারুনের মালিকানাধীন ম্যাবন ডেনিম, বেলতলায় হারুন অর রশীদের ইস্ট ওয়েস্ট, ইউনিক মোড়ে সামসুল আরেফিনের ময়ূরী নিটওয়্যার ও পলাশবাড়ীতে হালিমুর রহমানের আরবি নিট।
ঢাকার দক্ষিণখান এলাকা : আশকোনায় হ্যারিস যাস দেবার হেলিঙ্ গার্মেন্ট, দেওয়ানবাড়ীতে জামালউদ্দিনের খালিদ গার্মেন্ট, দক্ষিণখান বাজারে কছিমউদ্দিনের নেক ফ্যাশন, রাজু আহমেদের রাজু ফ্যাশনওয়্যার ও রাকিবুল হাসান সুমনের ভেরোনিকা অ্যাপারেল।
উত্তরখান এলাকা : চামুরখানে গাউস খানের মালিকানাধীন ইছামতী ফ্যাশন, মাদারবাড়ীতে জহিরুল ইসলামের উত্তরণ ওভেন ও চামুরখানে মাইনুল ইসলামের টেনডেম সুয়েটার।
ঢাকার অন্যান্য এলাকা : মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় মনির হোসেনের কে মরিয়ম গার্মেন্ট, পূর্ব হাজীপাড়ায় বাহাউদ্দিনের মিকফিও অ্যাপারেল, পূর্ব রামপুরার ইসেক্স গার্মেন্ট, মালিবাগ বাজারে সাইফুল ইসলামের বনি ডিজাইন, আবুল কাশেমের টেকনো ফ্যাশন, পূর্ব রামপুরায় গাজী মহিউদ্দিনের জেএনজি ফ্যাশন, পূর্ব শেওড়াপাড়ায় মনির হোসেনের বিসমিল্লাহ ফ্যাশন, হাটখোলা রোডে শফিকুর রহমানের মিলেনিয়াম গার্মেন্ট, সাভারে ওয়াহিদ উন নবীর জিং বাংলা, মিরপুর সনি সিনেমা হলের পাশে আবুল খায়ের ভুঁইয়ার প্রসিউ বস্ত্র, কল্যাণপুরে এস জি মোস্তফার সেনজেন উইন্টার ওয়্যার ও মিরপুর রূহানি মার্কেটে মাঈন উদ্দিনের মালিকানাধীন উদ্যোগ ফ্যাশন।
গাজীপুরের টঙ্গী এলাকা : কারখানাগুলোর মধ্যে রয়েছে- দারাইলে শাহজাহানের মালিকানাধীন সিডনি সুয়েটার, এরশাদনগরে আবদুল মান্নানের রিলেয়েবল ফ্যাশন, খরতেলে শামসুল আলমের গালফ নিটিং, আবদুল হামিদের দেউড়ি ফ্যাশন, বিসিকে আবদুল হামিদের ওয়েস্ট ওয়েজ সুয়েটার, চেরাগআলীতে জাহিদ হোসেনের জাওয়াদ ফ্যাশন, বিসিকে নাইম আহম্মদের মৌলী ফ্যাশন, জাভেল ই নূরের জাভেল ই নূর ওয়াশিং অ্যান্ড ডাইং, ফকির মার্কেটে মোস্তাফিজুর রহমানের ঢাকা ডাইং ও বনমালা রোডে আবুল বাশারের এ বি ফ্যাশন।
ঢাকার পল্লবী এলাকা : সেকশন-৭-এ শফিকুল ইসলামের মাইচয়েজ স্টার প্রাইজ, গালিব আবদুল সাত্তারের উডল্যান্ড অ্যাপারেল, সেকশন-১২-তে গোলাম রাব্বানীর ডিজাইন টেক্সটাইল, অনিক প্লাজায় সোহেলের এসএমওয়াই ফ্যাশন, বিল্লাল হোসেনের অল ওয়েদার গার্মেন্ট, সেকশন-১২-তে এম এ মান্নানের এরিজোনা সুয়েটার, কামরুল ইসলামের ভিস্তা ফ্যাশন ও ইউ এম আশোকের অন্বেষা স্টাইল।
নারায়ণগঞ্জ জেলা : ফতুল্লা বিসিকে শাকিল আহম্মেদের কচুয়া নিট ফ্যাশন, আবু সাঈদের মুন্সি নিটওয়্যার, আওলাদ হোসেনের ফ্যাশন নিট হাউস, আবদুল কাইয়ুমের ফ্যাশন বাংলা নিট, শামীম আহমেদের সুইং গার্ডেন গার্মেন্ট, গৌতম কুমারের জননী নিট হাউস, সেলিম সরোয়ারের সেলিন নিট ফ্যাশন, আবদুল্লাহেল মামুনের কটনবেলী নিটওয়্যার, জয়দেব সাহার এভার ইউথ নিটওয়্যার, গোপাল দত্তের নিটমার্ট, অনিক কুমার রায়ের এ বি ফ্যাশন, সামসুল আলমের দোয়েল অ্যাসোসিয়েট, কেতাবনগরে মাহামুদুল হাসান বাচ্চুর ডিভাইন টেক্স, বটতলায় হামিদ ফ্যাশন, সিদ্ধিরগঞ্জের জালকুড়ায় সীমা নিট অ্যান্ড ডাইং ও ধর্মগঞ্জে আবু তাহেরের এন কিউ ফ্যাশন। এ ছাড়া সিদ্ধিরগঞ্জের মৌচাকে মোস্তফা জামান মহিউদ্দিনের ফরেন বাংলাদেশ সুয়েটার, দেলোয়ার হোসেনের আল শাইন নিটওয়্যার, আদমজী ইপিজেডে জাকির হোসেনের হাইলেন সুয়েটার, শিমরাইল মোড়ে আবদুল্লাহ সাদেকের হায়দরী টেক্স অ্যান্ড গার্মেন্ট, এনায়েতনগরে শফিকুল ইসলামের রেবেলেশন ফ্যাশন অ্যান্ড ডিজাইন, সিদ্ধিরগঞ্জ পুলে মাহবুব আলমের আনোয়ার স্টাইল, ফতুল্লার তাগারপাড়ে জহিরুল ইসলামের টোকেন টেক্স, টানবাজার সদরে সোহেল মিয়ার পিকিউএস গার্মেন্ট, সানারপাড়ে নাসির উদ্দিনের সিকো টেক্স ও মৌচাকে আলমের আর আর নিটওয়্যার।

No comments

Powered by Blogger.