বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত-‘দ্রুত’ ও ‘বিশেষ’ আইনের বিপদ by এ কে এম জাকারিয়া

সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র মানেই তখন প্রতিযোগিতা। শুধু অস্ত্র নিয়ে নয়, সব ক্ষেত্রেই। কোন দেশ কোন ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে, কোনটি আগে করে ফেলছে—এসব নিয়ে প্রতিযোগিতা। এমন অবস্থায় প্রথম মানুষ হিসেবে মহাশূন্যে পরিভ্রমণ করে এসেছেন সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউরি গ্যাগারিন।
যুগান্তকারী ঘটনা বলতে যা বোঝায়, তা-ই করে বসেছে সোভিয়েতরা। ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল সোভিয়েত মহাকাশযান ভোস্টক ১-এ ঘটনা ঘটান গ্যাগারিন। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে বিষয়টি হজম করা কঠিন। জন এফ কেনেডি তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, গ্যাগারিনের মহাশূন্যে পদচারণের ৪৩ দিনের মাথায় তিনি চাঁদে লোক পাঠানোর ঘোষণা দেন। ১৯৬১ সালের ২৫ মে তিনি ঘোষণা করেন, তাঁর দেশ একজন আমেরিকানকে নিরাপদে চাঁদে পাঠানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। বোঝাই যাচ্ছে প্রতিযোগিতাটি কেমন ছিল। মহাশূন্য গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্রের এই পিছিয়ে পড়া নিয়ে নাকি কিছুটা মনঃকষ্টে ছিলেন কেনেডি। এ নিয়ে প্রচলিত গল্পটি হচ্ছে, কত দ্রুত চাঁদে লোক পাঠানো যায়, সে ব্যাপারে মার্কিন মহাকাশ সংস্থার (নাসা) প্রধানকে চাপ দিয়েছিলেন তিনি। তখন জবাবে নাসার প্রধান বলেছিলেন, একটি সন্তান জন্ম দিতে ১০ মাস ১০ দিন সময় দিতেই হবে, আপনি জোর-জবরদস্তি করেও এ ক্ষেত্রে কিছু করতে পারবেন না। চাঁদে যাওয়ার প্রস্তুতি এবং তা সম্ভব করতে একটি নির্দিষ্ট সময় আপনাকে দিতেই হবে। তাড়াহুড়ো করে কিছুই হবে না। কেনেডি চাঁদে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছিলেন ১৯৬১ সালে, আর তা সফল হয়েছিল ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই।
এ গল্পটিকে যদি একটি উপদেশমূলক গল্প ধরে নিই, তবে এর মরাল হচ্ছে কিছু কাজের জন্য এর নির্দিষ্ট সময় দিতেই হবে। যতই প্রয়োজন থাক, দ্রুত বা তাড়াহুড়ো করে তা করা যায় না। এত বড় ভূমিকাটি দিতে হলো সংসদে গত রোববার পাস হওয়া একটি বিল নিয়ে। বিলটির নাম ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) বিল ২০১০’। সংসদে পাস হওয়া এ বিলে রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর দিলেই তা আইনে পরিণত হবে। বিলটির নাম থেকেই এর উদ্দেশ্যের বিষয়টি ধারণা করা যাচ্ছে, দ্রুত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উৎপাদন নিশ্চিত করা। সরকার ও সরকারি দল মনে করছে, দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সংকট যে আকার ধারণ করেছে, তাতে দ্রুত উৎপাদনের জন্য এ ধরনের একটি বিধান করা জরুরি। কিন্তু চাইলেই কি দ্রুত গ্যাস, কয়লা বা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়? তাড়াহুড়ো করে কি বিদ্যুৎ উৎপাদন বা গ্যাস ও কয়লা তুলে ফেলা যাবে? এ প্রক্রিয়াগুলো একদিকে যেমন সময়সাপেক্ষ, তেমনি প্রচুর অর্থের প্রশ্ন জড়িত। এ ধরনের একটি খাতের জন্য ‘দ্রুত’ ও ‘বিশেষ’ বিধান আখেরে কতটুকু কার্যকর হবে, সে প্রশ্ন উঠেছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন বা জ্বালানি উত্তোলন-প্রক্রিয়ায় স্বাভাবিক যে সময়ের প্রয়োজন, সে ক্ষেত্রে এ ধরনের বিল বাড়তি কোনো ‘দ্রুত’ পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারবে না। একটি নির্দিষ্ট সময় দিতেই হবে। যেখানে সময় বাঁচানোর কথা বলা হচ্ছে, তা হচ্ছে দরপত্রের ঝামেলা এড়ানো, যাচাই-বাছাই ও যাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও গ্যাস বা কয়লা উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া হবে, তাদের সঙ্গে সমঝোতার ক্ষেত্রে সময় কমিয়ে আনা। এই বিধানের মাধ্যমে সেটা হয়তো কিছুটা সম্ভব, কিন্তু দুর্নীতি ও ভাগবাটোয়ারার আশঙ্কা নিশ্চিতভাবেই বহুগুণ বেড়ে যাবে, আর স্বচ্ছতা বলে কিছুই থাকবে না। সবচেয়ে বড় কথা, এ ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম বা ত্রুটি হয়ে থাকলে তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করা যাবে না। একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা হয় দীর্ঘ মেয়াদে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য। কয়লা বা গ্যাস উত্তোলনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। চুক্তিতে কোনো ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি হলে তার খেসারত জনগণকে দীর্ঘ দিন দিতে হবে, কারণ এতে যে অর্থনাশ ঘটবে, চূড়ান্ত বিচারে তার দায় জনগণকেই বইতে হবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি-সংকটের সমাধান নিশ্চয়ই আমাদের করতে হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ‘দ্রুত’ সমাধানের পথ নেই। আর ‘বিশেষ’ আইন বা বিধান দিয়ে কখনোই এ ধরনের পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায় না। অতীতে যত ‘বিশেষ’ বিধান বা আইন হয়েছে, তা পরবর্তী সময় কালো আইন বা বিধান হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে। ‘কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও গৃহস্থালি কাজের চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ ও জ্বালানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করিবার লক্ষ্যে উহাদের উৎপাদন বৃদ্ধি, সঞ্চালন, পরিবহন ও বিপণনের নিমিত্ত দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের সুবিধার্থে, এবং প্রয়োজনে বিদেশ হইতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি আমদানি করিবার পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন এবং জ্বালানি-সম্পর্কিত খনিজ পদার্থের দ্রুত আহরণ ও ব্যবহারের নিমিত্ত অনুসরণীয় বিশেষ বিধান প্রণয়নকল্পে আনীত’ এ বিল আইনে পরিণত হলে এর ভাগ্যেও যে একই পরিণতি ঘটবে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। আইন বা বিধানের ভাগ্যে না হয় ‘কালো’ তকমা জুটল, কিন্তু এ বিধানের সুযোগে ক্ষতির যে আশঙ্কা রয়েছে, তেমন কিছু হলে তা পূরণ হবে কীভাবে?
দ্রুত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সংসদে যে বিল তোলা হয়েছে, দুটি দিক থেকে এর ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা যায়। প্রথমটি হচ্ছে, দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে যে দুর্নীতি ও ভাগবাটোয়ারা হবে না, তার নিশ্চয়তা কী? দ্বিতীয়টি হচ্ছে, এ ধরনের একটি বিল আইনগতভাবে কতটা সঠিক? বিষয় দুটি একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। দুর্নীতি ও ভাগবাটোয়ার যে আশঙ্কা, সে ক্ষেত্রে বলা যায় শত শত কোটি টাকার কাজ হবে যে খাতে, সেখানে কোনো ধরনের জবাবদিহি ছাড়া একতরফা যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার পরিণতি কী হতে পারে, তা অনুমান করতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
এই আইন একদিকে যেমন দুর্নীতির উৎসব করার সুযোগ করে দেবে, তেমনি কেউ দুর্নীতি করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পথও বন্ধ করে দেবে। বিলে বলা হয়েছে, ‘এই আইনের অধীনে কৃত বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোনো কার্য, গৃহীত কোনো ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোনো আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতের নিকট প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’ আইনজীবী শাহ্দীন মালিক এ ধরনের বিধানকে সামরিক আইনের বিধিবিধানের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এটা দুঃখজনক যে আমাদের সংসদ সামরিক আইনের মডেলে আইন প্রণয়ন করছে (ডেইলি স্টার, ২৭ সেপ্টেম্বর)। সবচেয়ে বড় কথা, সংবিধান জনগণকে যে ‘আইনে আশ্রয় লাভের অধিকার’ (৩১ অনুচ্ছেদ) দিয়েছে, তার সঙ্গে এই আইনকে মেলানো যাচ্ছে না।
আগামী দুই বছর ধরে ‘সরকার এবং সরকারি মালিকানাধীন বা নিয়ন্ত্রণাধীন সকল প্রতিষ্ঠান, এই আইনের অধীন বিদ্যুৎ বা জ্বালানির দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধি, সঞ্চালন, পরিবহন ও বিপণন-সংক্রান্ত যেকোনো পরিকল্পনা গ্রহণ বা বিদেশ হইতে বিদ্যুৎ বা জ্বালানির আমদানি ও উহার সঞ্চালন, পরিবহন ও বিপণন-সংক্রান্ত যেকোনো পরিকল্পনা গ্রহণ ও উহার দ্রুত বাস্তবায়নের নিমিত্ত যেকোনো প্রস্তাব গ্রহণ করিতে পারিবে।’ দুই বছরের জন্য এই যে খোলা চেক দেওয়া হলো, এর আওতায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যেকোনো শর্তে চুক্তি হবে, কয়লা বা গ্যাস উত্তোলনের দায়িত্ব যেকোনো শর্তে দিয়ে দেওয়া যাবে। আমদানিও করা যাবে যেকোনো শর্তে। সবকিছুকেই ‘সরল বিশ্বাসে কৃত’ কাজ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। ‘এই আইন বা তদাধীন প্রণীত বিধি, সাধারণ বা বিশেষ আদেশের অধীন দায়িত্ব পালনকালে সরল বিশ্বাসে কৃত বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোনো কার্যের জন্য কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো প্রকার আইনগত কার্যধারা গ্রহণ করা যাইবে না।’
প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ডাকা, কারিগরি মূল্যায়ন, প্রয়োজনে পুনঃ দরপত্র, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট ২০০৬, দাতা দেশ ও গোষ্ঠীর তদারকি—এত কিছুর পরও দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতি ও ভাগবাটোয়ারার অভিযোগের শেষ নেই। আর নতুন আইন যে জবাবদিহিহীন পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে যাচ্ছে, তা কোথায় নিয়ে যাবে কে জানে! এ ধরনের একটি আইন কার্যকর হয়ে গেলে ভবিষ্যতের জন্য তা উদাহরণ হিসেবে কাজ করবে। দুর্নীতি ও ভাগবাটোয়ারার সুযোগ করে দেয়, এমন কোনো আইনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করার বিষয়টি তাই কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এই আইনের মাধ্যমে ‘দ্রুত’ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উৎপাদন করা না গেলেও এই ‘বিশেষ’ আইনের মাধ্যমে ভাগবাটোয়ারার কাজটি যে দ্রুত সারা যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করলে সংসদে পাস হওয়া এ বিলটি আইনে পরিণত হবে। এ ধরনের একটি আইনে স্বাক্ষর না করার জন্য রাষ্ট্রপতির প্রতি অনুরোধ জানাই। এ বিলে আদালতে যাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে যে বিধান রাখা হয়েছে, তা সংবিধানে দেওয়া মৌলিক অধিকারের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ হওয়ায় এই আইন চ্যালেঞ্জ করে কেউ মামলা করলে আইনটি নাও টিকতে পারে।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.