সত্য প্রকাশ পাবেই by কামরান শফি

শেষ পর্যন্ত ওসামা বিন লাদেন পাকিস্তানের এবোটাবাদ ক্যান্টনমেন্টে মার্কিন নৌসেনাদের হাতে নিহত হয়েছে। আর আফগানিস্তান থেকে এই হেলিকপ্টারচালিত হামলাটি আমেরিকানরা নিজেরাই পরিচালনা ও কার্যকর করে। এখন বড়জোর আমরা প্রশ্ন করতে পারি, যখন চারটি বিদেশি হেলিকপ্টার আমাদের সীমান্ত অতিক্রম করে এক ঘণ্টা ধরে


আমাদের স্বাধীন ভূমিতে উড়ে এবোটাবাদে হামলে পড়ল তখন আমাদের 'ঘইরাত ব্রিগেডের' ঘইরাত কোথায় ছিল। কোথায় আমাদের আত্মসম্মান রইল, এ প্রশ্ন আমরা নিশ্চিতভাবেই করতে পারি। ইতিপূর্বে আমেরিকানরা ঘোষণা করেছিল যে, তারা যাকে শত্রু বিবেচনা করে তার সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য পেলে তাকে তারা পাকড়াও করবেই। এখানে কোন দেশে শত্রু লুকিয়ে আছে সেটা তাদের কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়। তারা যা বলেছিল এবার তা করে দেখিয়েছে। এখন আমাদের রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র বলে বড়াইকরণেওয়ালারা ওসামা বিন লাদেন এত বছর এবোটাবাদ ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় বসবাস করার তথ্যটি কেন জানত না সে প্রশ্ন অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। ওসামা বিন লাদেন ও তার ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টারা পাকিস্তানে লুকিয়ে আছে বলার পর কেন সবাই এবং নিরাপত্তা এস্টাবলিস্টমেন্ট তেড়েফুড়ে অস্বীকৃতি জানাল।
ওসামা বিন লাদেনের কিডনি নষ্ট হওয়া ও তার নিয়মিত ডায়ালিসিসের প্রয়োজন, এটা এস্টাবলিস্টমেন্টের পক্ষ থেকে আমাদের সামনে প্রকাশ করার পর আমি যখন তার এ অবস্থায় কোনো পাহাড়ের গুহা বা দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান করা সম্ভব হবে না, বললাম তখন আমাকে কেন বিশ্বাসঘাতক ও আমার মরা উচিত বলা হলো? আফগান প্রেসিডেন্ট যখন আল কায়দার শীর্ষ নেতৃত্ব পাকিস্তানে লুকিয়ে আছে বললেন, তখন কেন তার প্রতি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখানো হলো? এই বছরগুলোতে কেন তীব্রভাবে অস্বীকৃতির পালা চলল?
সিএনএন গুগল ম্যাপ ব্যবহার করে লন্ডন সময় সোমবার সকালে আমাদের জানায়, ওসামা এবোটাবাদের ওই আলিশান বাড়িটিতে তার যুবতী স্ত্রী ও পরিবারের আরও সদস্য নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন। ওই এলাকার বাড়িগুলো থেকে আটগুণ বড় এই বাড়িটির প্রতিরক্ষায়ও সশস্ত্র প্রহরী দল ছিল। তবে উঁচু দেয়াল বেষ্টিত এই বাড়ির সঙ্গে কোনো টেলিফোন বা সেলফোন সংকেত কখনও বাইরে যায়নি।
আমি উল্লেখ করেছিলাম যে, যেসব বাড়ি নির্জন ও কিম্ভূতকিমাকার সেগুলো সাধারণত সব গোয়েন্দা সংস্থারই সন্দেহের তালিকায় থাকে। তবে আমাদের বলা হয়েছে যে, হাজারা পুলিশ, আইবি, আইএসআই বা এমআই_ কেউই জানত না এই অদ্ভুত বাড়িটিতে লাদেন লুকিয়ে আছে বা এ ব্যাপারে সামান্যতম সন্দেহ কারও হয়নি। অথচ বাড়িটি সামরিক একাডেমী সংলগ্ন। এই একাডেমীতেই পাকিস্তানের ক্যাডেটরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। এই একাডেমী ছাড়াও এখানে রয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তিনটি রেজিমেন্টাল সেন্টার। এসব সেন্টারে সৈনিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। অতএব এই ক্যান্টনমেন্ট এলাকাটি অবশ্যই অতি গুরুত্বপূর্ণ।
আমি শুধু বলব, এখানে লাদেনের অবস্থান সম্পর্কে তারা যদি কিছু না জেনে থাকেন, তাহলে কেন তারা তা জানেননি? একদিন না একদিন সত্য বেরিয়ে আসবেই।
এই অপারেশন সম্পর্কে আমাদের সরকার অবহিত ছিল এবং আমাদের গোয়েন্দা এজেন্টরা এর অংশ ছিল বলে যে কিছু দাবি উত্থাপিত হয়েছে মার্কিন সরকারের ভাষ্যে তা নাকচ হয়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট ওবামার ওয়াশিংটন ডিসিতে দেওয়া বিবৃতিতে সুস্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেছেন, প্রায় নয় মাস আগে গত আগস্টে তাকে লাদেনের পাকিস্তান অবস্থান করা সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে জানানো হয়। এবোটাবাদে লাদেনের অবস্থান সস্পর্কে পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হয়ে তিনি গত শুক্রবার সেখানে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন বলে জানান। ওবামার কথা অনুসারে অপারেশনের সংবাদ তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে টেলিফোনে জানান এবং এর সাফল্যও নিশ্চিত করেন।
নাইন-ইলেভেনের ঘটনায় আমার ছেলের হারিয়ে যাওয়ার (ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ৪নং ভবনে সে কর্মরত ছিল তখন) ঘটনায় চার ঘণ্টার এক তীব্র যন্ত্রণাকাতর সময় গিয়েছিল আমার। তখন আমি ওসামা বিন লাদেনের কর্মকাণ্ডকে এই বলে তীব্র নিন্দা জানিয়েছিলাম যে, তিনি শুধু আফগানিস্তানের পর সৌদি আরব এবং এভাবে গোটা ইসলামী দুনিয়ার ক্ষমতা কব্জা করতে চান, গরিব দেশটির উন্নতির জন্য কিছুই করছেন না এবং করবেনও না। আফগানিস্তানে তার বিরাট অঙ্কের অর্থ সাহায্যে কোনো হাসপাতাল বা স্কুল বা ক্লিনিক বা ডিসপেনসারি গড়ে ওঠেনি। তালেবানদের কাছ থেকে তার নিরাপত্তার বিনিময়ে তিনি শুধু ঘুষ হিসেবে তাদের অর্থ দিয়েছেন।
এবার অপারেশন সম্পর্কিত বক্তব্যে ফিরে আসছি। এটা যে আর একটি মিথ্যা নয় সে ব্যাপারে আমরা আশ্বস্ত হতে চাই। এখানেই শেষ খেলাটা খেলতে হবে, ওসামা বিন লাদেনের নিশ্চিহ্ন হওয়ার মধ্য দিয়ে তা কেবল ত্বরান্বিত হলো। এখন ২০১৪ সালের আগে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি জোরালো হবে।
তবে আমেরিকানরা তো আর নেকড়ের দলের কাছে আফগানিস্তানকে সমর্পণ করে যেতে পারবে না। কারণ, আল কায়দার পাকিস্তানি ও আফগানি প্রাণের সখা দুই দেশের তালেবানের ভয় কিন্তু রয়ে যাচ্ছে। মার্কিনীরা আমাদের কাছ থেকে সহযোগিতা প্রত্যাশা করবে, যাতে আর সীমান্ত এলাকায় তাদের সৈন্য দলের ক্ষতি না হয়।
আমরা যাই বলে থাকি না কেন, আমাদের মনে রাখতে হবে যে, লাদেন পাকিস্তানের এবোটাবাদেই আস্তানা গেড়ে এতদিন তার কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন। তাই আমাদের ওপর থেকে আমেরিকানদের সন্দেহ সহজে দূর হবে না। আমাদের সম্পর্কে আমেরিকার নেতারা যেসব মন্তব্য করেন সেগুলোকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে আমাদের বিবেচনা করতে হবে। আমরা অবশ্যই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের মন্তব্যকে আমলে নেব। তিনি বলেছিলেন, তার বিশ্বাস হয়তো পাকিস্তান এস্টাবলিস্টমেন্টের উচ্চ পর্যায়ের কেউ জানেন না লাদেন ও আল কায়দা বা মোল্লা ওমর ও আফগান তালেবান নেতৃত্ব কোথায় লুকিয়ে রয়েছে। তবে এই সরকারের মধ্যে এমন লোক থাকতে পারে যারা এ সম্পর্কে জানে। যুক্তরাষ্ট্রে যারা ৯/১১-তে হামলা চালিয়েছিল তাদের বিচারের মুখোমুখি করা, ধরা বা খতম করার জন্য পাকিস্তানের কাছ থেকে আরও ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা কামনা করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
আমরা যদি এখনও ঠিক না হই, তাহলে এটা আমাদের ভয়ানক বিপদের কারণ হবে। সত্য বেরিয়ে আসবেই।

ডন থেকে ভাষান্তর
দুটি লেখাই ভাষান্তর করেছেন সুভাষ সাহা
 

No comments

Powered by Blogger.