গানওয়ালাদের গান শোনা

গানই যাদের জীবন, তারা কোন সুরে কান পাতছেন? কখনই বা তারা গান শোনেন? আইপড ভালবাসেন, না গাড়ির মিউজিক সিস্টেম? ভারতের পাঁচ সঙ্গীতশিল্পীর এসব প্রশ্নের জবাবে কী বলেন?

রবীন্দ্রনাথ আর বিয়নসে নোয়েলস: সুনিধি চৌহান
কী শোনেন: এখন বিয়নসে নোয়েলস ছাড়া কিছু শুনছি না। বিয়নসের কণ্ঠস্বরে এমন একটা বন্যতা আছে, যা সচরাচর আর কারও গানে আমি পাই না। আমার নিজের গায়কীর সঙ্গে কোথাও ওর একটা মিল আছে-যদিও আমি হিন্দি গান গাই। আর বিয়নসে আন্তর্জাতিক শিল্পী। ওর ‘হেলো’ গানটা আমি বারবার শুনি তবু পুরনো হয় না যেন। গীতিকার হিসেবেও বিয়নসে খুব উঁচুদরের। খুব বড় ভাবনাচিন্তা নিয়ে গান লেখেন যেটা শ্রোতাকে একটা অন্য জগতে পৌঁছে দেয়। যেমন এই ‘হেলো’র গানের কথা ‘আই ক্যান ফিল ইওর হেলো, আই ক্যান সি ইওর হেলো’ বা ওই একই গানের ‘স্ট্যান্ডিং ইন দ্য লাইট অফ ইওর হেলো, আই গট মাই এঞ্জেল নাও’ এই সব লাইন, আমাকে অপার্থিব জগতে ভাসিয়ে নিয়ে যায় বারবার। আর এক জনের গানও আমার খুব প্রিয়। মাইকেল জ্যাকসন। ওর ‘ব্যাড’ অ্যালবামের গানগুলো আজও নতুন। অথচ ২৫ বছর হয়ে গেছে অ্যালবাম রিলিজের। মাইকেল জ্যাকসন আমি শুনতে নয়, শোনাতেও ভালোবাসি। তাই রিংটোনেও মাইকেল জ্যাকসনেরই গান। রোজ নিয়ম করে লতা মঙ্গেশকর আর আশা ভোঁশলের গান শুনি। এই অভ্যেসটা আমার গানের ক্লাসে যাওয়ার মতো। বলিউড মিউজিকে আছি অথচ নিয়মিত ওদের দু’জনের গান শুনব না এটা ভাবতেই পারি না। আর একটা কথা, আমি কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনি। আমার কাছে কয়েকটা সিডি আছে। সেগুলো শুনি। শিল্পীদের নাম বলতে পারব না। নাম করতে পারি একজনেরই যার গানে এক ধরনের উদাত্ত ব্যাপার আছে-তিনি লোপামুদ্রা মিত্র। খুব দরাজ গলা। অন্যদের রবীন্দ্রসঙ্গীতের চেয়ে আলাদা।

কীসে শোনেন: ওয়াকম্যানে গান শুনি।
কখন শোনেন: বিকেল চারটে থেকে পাঁচটা আমি শুধুই গান শুনি। ওই সময়টা আমি ফ্রি।
প্রিয় সঙ্গী: গান একা শুনতেই ভালো লাগে। তবে এখন বিয়ের পর আমি আর আমার বরও একসঙ্গে গান শুনি মাঝে মাঝে। ওর আর আমার গানের টেস্ট-টা একই ধরনের।

ডার্টি পিকচার’এর ‘উলাল্লা’বার বার: বাপ্পি লাহিড়ি

কী শোনেন: নিজের সুর দেয়া গান। মাঝে মাঝে নিজের কম্পোজিশন। ‘ডার্টি পিকচার’এর ‘উলাল্লা’ বার বার শুনছি। অন্য গান শুনতে হলে লোকসঙ্গীত, লোকবাদ্যই সবচেয়ে প্রিয়। লোকসঙ্গীতের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে মাটির গন্ধ। যে দেশেরই ফোক শুনি না কেন তা আমার সুর দেয়ার কাজে লাগতে পারে। আফ্রিকার লোকসঙ্গীত খুব প্রিয়। ওখানকার গানে বিট বা তালের ব্যবহার খুব সুন্দর, সাহসী। শচীন দেব বর্মনের লোকগীতিগুলো আমি আজও শুনি। উনিই তো প্রথম বাংলার লোকগানকে বলিউডে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি তারপর। এখনও সুযোগ পেলে বাংলার লোকগান জোগাড় করে শুনি। কিছু নতুন পেলে মনে প্রাণে আর কানে ঢুকে যায়। এ ছাড়া ওয়েস্টার্ন-এর মধ্যে হুইটনি হিউসটনের গান শুনতে ভালেবাসি। খুব জোরালো ছিল ওর গানের স্টাইল। কিন্তু চলেই গেলেন। সামনেই ‘দর্দে ডিসকো’ রিলিজ করবে। ছবির সুর আমার। এই ছবির গানও শুনছি। ‘জিপসি কিং’ স্প্যানিশ ব্যান্ডের গান খুবই প্রিয়। হিন্দি গানের সুর দিতে গেলে ওয়েস্টার্ন ব্যান্ডের গান শুনলে অনেক রকম আইডিয়া মাথায় আসে।
কখন শোনেন: রাত তিনটে পর্যন্ত। মধ্যরাতে গান শুনতে ভালো লাগে। গান শোনার সময় শুধুই গান শোনা। কোনো কথাবার্তা নয়। গান শুনতে শুনতে ঘুমোতে যাই। তখন মাঝে মধ্যে বাখ, বেঠোফেনও চলে।
কীসে শোনেন: নিজের বাড়িতেই বিরাট রেকর্ডিং স্টুডিও আছে। দিনের বেলা গান শুনতে হলে সেখানেই যাই। আর রাত্রে আমার বিছানায় লাগোয়া মিউজিক সিস্টেমে।
প্রিয় সঙ্গী: আমাদের পরিবার গানের পরিবার। মা-বাবা বাঁশরি লাহিড়ি আর অপরেশ লাহিড়ি দু’জনেই গানের মানুষ ছিলেন। আমার স্ত্রীও গান জানেন। ছেলে বাপ্পা, মেয়ে রিমা দু’জনেই সঙ্গীতশিল্পী। তাই ওদের সঙ্গে বসেও অনেক সময় গান শুনি।

বেশির ভাগ ভালো গানই ট্র্যাফিক জ্যামে শোনা: শান্তনু মৈত্র

কী শোনেন: প্রত্যেক উইকএন্ডে নিয়ম করে শুনবই শুনব সলিল চৌধুরীর সুর ও কথার গান। ওর গানে ওয়েস্টার্ন মিউজিকের দারুণ প্রভাব। কিন্তু যখন নিজে গান বেঁধেছেন তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। শ্রোতার কাছে নিজের পাণ্ডিত্য দেখাতে যাননি। এটা আমার কাছে শিক্ষণীয় ব্যাপার। সলিলের সুরে লতাজির গান আর দেশাত্মবোধক গান শোনা টপ অব দ্য লিস্টে থাকে প্রত্যেক সপ্তাহে। ‘মধুমতী’র ‘দইয়া রে দইয়া’ ভাটিয়ালি সুরের গান মাঝে মাঝে চালিয়ে দিই। এত বছর ধরে গান শুনতে শুনতে মনে হয়েছে যে কোনও দেশের লোকগীতিই হল আসল গান। একটা সময় পর্যন্ত এ সব গান গ্রাম্য-গরিবি গান মনে করা হত। এর পর ষাটের দশকের শেষে বা সত্তরের গোড়ায় লোকগীতিকে নতুন করে আবিষ্কার করে আধুনিক করার একটা আন্দোলন শুরু হলো। যার ফল বিটলসের গান-যেখানে ‘শি লভস ইউ ইয়া ইয়া ইয়া’র পেছনে আফ্রিকান রিদম বাজে। জাপানি, কোরিয়, আফ্রিকান-পৃথিবীর সব দেশের ‘ফোক’ আমার কানে বাজে।
সারা বিশ্বের লোকগীতি শুনলে মনে মনে ফ্রিতে সারা দুনিয়াটাই যেন ঘুরে বেড়ানো হয়ে যায়। শুনি পশ্চিম আফ্রিকার সেনেগলের শিল্পী বাবা মালের গান। ওর ‘এলেম্মা এলেম্মা’ গানটা প্রায়ই শুনি। অ্যাক্যুস্টিক গিটার বাজিয়ে লোকগীতি গান, কী অপূর্ব যে লাগে। ওর বাবা ছিলেন জেলে। মাছ শিকারিদের এক ধরনের লোকগান হয়, তার প্রভাব রয়েছে বাবা মালের গানে। প্রকৃতি, আকাশ, বাতাস যে গানে ছাপ ফেলে সে গান আমার খুব ভাল লাগে বলেই ‘থ্রি ইডিয়টস’-য়ে ‘বহেতি হাওয়া সা থা ও’ গানখানা অমন দরাজ ভাবে কমপোজ করতে পেরেছিলাম। যদিও এই গানটায় প্রভাব রয়েছে ভাটিয়ালির।
কখন শোনেন: মুম্বইয়ের রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামে যখন আটকা পড়ে যাই তখন গাড়িতে গান শুনি। বেশির ভাগ ভালো গানই ট্র্যাফিক জ্যামে শোনা।
কীসে শোনেন: কার সাউন্ড সিস্টেমে শুনি। বাড়িতেও ভাল সাউন্ড সিস্টেম আছে। রেডিওতে গান কখনওই শুনি না। কারণ সেখানে আমার কোনো চয়েস থাকে না। আর-জে যা ঠিক করে দেবে তাই শুনতে হবে এটা আমি মানতে রাজি নই।
প্রিয় সঙ্গী: স্ত্রী সারদার সঙ্গে গান তো শুনছিই বহু কাল ধরে। কিন্তু এখন আমার গানের প্রিয় সঙ্গী ছেলে শুভম। ওর বয়স চোদ্দো। ওর একটা ব্যান্ড আছে। নতুন জেনারেশন কী ধরনের গান গাইছে, কী ধরনের গান পছন্দ করছে ওর কাছ থেকে শুনি। সেটা আমার গানের সুর দেয়ার সময় মাথায় থাকে। প্লাস আমি যে ধরনের গান ভালোবাসি সেগুলো ওকে শোনাই। আমার উত্তরসূরিকে আমি যা জানি তার কিছু দিয়ে যেতে হবে তো!

রেডিওতে কিশোরকুমার, আশাজির গান: শান

কী শোনেন: মুড অনুযায়ী গান। যেমন সকালে জিমে গেলে তাল বা বিট প্রধান গানবাজনা ভালো লাগে। তাতে এক্সারসাইজ করার মধ্যে এক ধরনের ছন্দ আসে, ফোর্স আসে। ঘাম ঝরাতে সুবিধে হয়। বাড়িতে নিজের সঙ্গীত চর্চার মতো সময় থাকলে অবশ্যই শুনি রাগ সঙ্গীত। এর মধ্যে আমার গুরুজি উস্তাদ গুলাম মুস্তাফার গান শুনি। বিদেশি গায়কদের মধ্যে প্রিয় স্টিভি ওয়ান্ডার, আর সিয়েলের গান। ওদের গানের স্টাইল এখন বলিউড মিউজিককেও প্রভাবিত করছে। তাই শুনতেই হয়। বিশেষ পছন্দ জর্জ মাইকেলের ‘ওল্ডার’ অ্যালবাম। গানের কথা, সুর মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট খুব আধুনিক অথচ দারুণ রোমান্টিক। আজকাল রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইছি। পুরস্কার পেয়েছি তার জন্য।

খুব বেশি অ্যালবাম কালেকশনে না থাকলেও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাসের গান শুনি নিজের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য। মাঝে মাঝে শুনি শ্রীকান্ত আচার্য। আমার বাবা মানস মুখোপাধ্যায়ের গলায় ‘শুধু তোমার বাণী নয় গো, হে বন্ধু হে প্রিয়’ বারবার শুনি।

বাবার গান বলেই বারবার শুনতে ইচ্ছে করে। আমি যে ধরনের রোম্যান্টিক গান গাই তার সঙ্গে গজলের একটা যোগ আছে। নিজে যখন গান লিখতাম, সুর দিতাম তখনও গজল আমাকে প্রভাবিত করত। মেহেদি হাসান আর জগজিৎ সিংহের গজল আপন মনে একা থাকলে শুনতে চমৎকার লাগে। হালকা ফুলকা গজল আমার পছন্দ নয়। গভীর ভাব আছে এমন গজলই শুনি।

যেমন জগজিৎ সিংহের গালিবের গজলের অ্যালবাম, বা মেহেদি হাসানের ‘অবকে হম বিছড়ে’ বা ‘শোলা থা জ্বল বুঝা’র মতো গভীর অনুভূতির গানই আমাকে বেশি টানে।

কখন শোনেন: বাড়িতে ফিরে গান শোনার সময় পাওয়া যায় না। পরিবারকে তো সময় দিতে হয়। একেবারে একান্তে ব্যক্তিগত ভাবে গান শোনার প্রিয় সময় যখন গাড়িতে থাকি তখন। হুহু করে গাড়ি ছুটছে কিংবা ট্র্যাফিক জ্যামে বোর হচ্ছি- দুটো সময়ই গান দিয়ে ভরিয়ে দেয়া যায়।

কীসে শোনেন: কার মিউজিক সিস্টেম। বাড়িতে মাঝে মাঝে রেডিও চালাই। কিশোরকুমার, মুহম্মদ রফি, লতাজি, আশাজির পুরনো গান রেডিওতে শুনতে এখনও ভালো লাগে। সেলফোনের রেডিওর কথা কিন্তু বলছি না। ঠিকঠাক রেডিও বলতে যা বোঝায় তাতেই গান শুনি।

প্রিয় সঙ্গী: আমার গান শোনার সঙ্গী আমি নিজে।

জ্যাজ হলে আমার পছন্দ নোরা জোনস: শ্রেয়া ঘোষাল

কী শোনেন: লেডি গাগা, বিয়নসে, এনরিকে ইগলেশিয়াসের গান জনপ্রিয় তাই মাঝে মাঝে এ দিক, সে দিক শুনে ফেলি। কিন্তু একান্ত পছন্দের শিল্পী এরা নন। আমার পছন্দ কিছুটা বিদঘুটে। চলতি ধারার বাইরে অলটারনেটিভ মিউজিকে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে চাইছি। ভালো লাগে ইংরেজ গীতিকার ডিডো ফ্লোরিয়ানের গান। গানের কথা তারুণ্যে ভরপুর, অসম্ভব গর্জাস। আবার রোমান্টিকও। ওয়ার্ল্ড মিউজিকের কথা উঠলে ডিডোর নাম আসবেই। ওর ‘লেটস ডু থিংস উই নরমালি ডু’ গানটা আমার খুবই পছন্দের। আজকাল প্রায়ই শুনছি সুফজান স্টিভনের গান। ইলেকট্রনিকা থেকে ফোক সবেতেই সুফজানের সহজ ‘মেলোডিয়াস’ আসা যাওয়া। নিজেও খুব ভালো গান লেখেন। জ্যাজ শুনতে হলে আমার পছন্দ নোরা জোনস। যেটাকে ‘নিও জ্যাজ’ বলা হচ্ছে-সিন্থেটিক গিটার ইত্যাদি ব্যবহার করে নানা রকম পরীক্ষানিরীক্ষা করছেন আর এক জন শিল্পী। প্যাট ম্যাথনি। দারুণ ফেভারিট।

এ ছাড়া বেগম আখতার, জগজিৎ সিংহ, মধু রাণি, গুলাম আলি সকলেরই গজল এন্তার শুনি। ইদানীং গজলের জনপ্রিয়তা কমেছে। কিন্তু গজল না শুনলে একজন শিল্পীর সম্পূর্ণতা আসে না। নিজেকে সমৃদ্ধ করার জন্য হিন্দি, উর্দু গজল শুনি। খুব শিগ্গির আমার একটা গজলের অ্যালবামও রিলিজ করবে।

কখন শোনেন: যখন নিজের কোনো রেকর্ডিংয়ের কাজ থাকে না, একদম ফ্রি থাকি, তখন বাড়িতে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে গান শুনি। ছুটি পেলে যে সব গান অনেক দিন ধরে শুনব ভাবছি কিন্তু শোনা হচ্ছে না, সেগুলোই বেশি করে শুনে নিজেকে আপডেটেড রাখি।

কীসে শোনেন: একটা খুব সুন্দর পোর্টেবল মিউজিক সিস্টেম আছে আমার, ল্যাপটপের সঙ্গে সেটা লাগিয়ে হাই ভলিউমে গান শুনি। কানে লাগিয়ে গান শুনতে ভালো লাগে না। সেইজন্যই আইপড পছন্দ নয়। তাতে গান বা বাজনা সারা ঘরে ছড়িয়ে এফেক্টটা তৈরি করতে পারে না।

প্রিয় সঙ্গী: মা-বাবা দু’জনেই গান ভালোবাসেন। ওদের জন্যই আজ আমি গায়িকা। দু’জনের সঙ্গেই গান শুনতে ভালো লাগে। ভাইও ভালো গান গায়, ওর সঙ্গেও শুনি। তবে একান্ত প্রিয় সঙ্গী হলো বাবা। বাবা নরম সুরের ক্লিন অ্যারেঞ্জমেন্টের গান পছন্দ করেন। আমারও এরকম গানই পছন্দ। সূত্র: ওয়েবসাইট।

No comments

Powered by Blogger.