চলতি প্রসঙ্গ-গৃহকর্মী বনাম গৃহশ্রমিক by নূর কামরুন নাহার

শ্রমের স্বীকৃতিই যদি সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত না হয়, তবে শ্রম বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা কি প্রতিষ্ঠিত হবে! তাই নীতিমালাই যদি করতে হয়, তাদের ন্যায্য পাওনাই যদি নিশ্চিত করতে হয় এবং গৃহশ্রম দেওয়া-নেওয়ার ক্ষেত্রে যদি একটা সুষ্ঠু প্রক্রিয়া ও জবাবদিহিতা তৈরি করতে হয় তবে অবশ্যই আগে একে শ্রমের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে


শ্রমের ওপর দাঁড়ানো সমাজ, অর্থনীতি, জীবনব্যবস্থা কিন্তু শ্রমিকের শ্রম, ঘাম, দাম নিয়ে কথা হয় খুব কম। কারণ সে সমাজের প্রান্তীয় মানুষ। কেন্দ্রে অবস্থানরত মানুষের কাছে শ্রমের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও শ্রমিক মূল্যহীন। সারা বছর তাই শ্রমিকের বিষয়ে কথা হয় না। মে দিবসে তার কথা হয়। কিন্তু এ মে দিবসেও আবার একজনের কথা হয় না। কারণ তার শ্রমের কোনো স্বীকৃতিই নেই। শ্রমিক নামক প্রান্তীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যেও সে প্রান্তে অবস্থান করে। সে গৃহশ্রমিক তবে তার নামের সঙ্গে শ্রমিক শব্দটি নেই। সে সাধারণভাবে 'কাজের বুয়া', 'কাজের মেয়ে', 'কাজের লোক' ও চাকর। সম্প্রতি অবশ্য তারা 'গৃহকর্মী' নামক একটি শব্দ লাভ করেছে। মে দিবসে তাদের কোনো ছুটি নেই এবং অন্যান্য শ্রমিকের সঙ্গে মিশে মে দিবসের অধিকার অথবা আনন্দের ভাগ নিতে জানে না তারা । তারা জানে শুধু শ্রম ঢেলে দিতে।
লেবার ফোর্স সার্ভে ২০০৬-এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে গৃহকর্মে নিয়োজিত মোট শ্রমিক ৩,৩১,০০০ (১৫ বছরের ওপর)। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জাতীয় শিশু শ্রম জরিপ ২০১০ সালের তথ্য অনুযায়ী গৃহকর্মে নিয়োজিত মোট শিশু (৫-১৭) শ্রমিক হচ্ছে ১ লাখ ২৫ হাজার। এর মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগ মেয়েশিশু। এই বিপুলসংখ্যক শ্রমিকের সুরক্ষার জন্য সরকার গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা ২০১০-এর খসড়া তৈরি করেছে। নীতিমালায় গৃহশ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য তাদের কাজের কর্মঘণ্টা, মজুরি নির্ধারণ, ছুটির দিন নির্ধারণ, কাজের জন্য চুক্তি, মাতৃত্বকালীন ছুটি ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সরকারের এ নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে সন্দেহ নেই গৃহশ্রমিকদের শ্রম অনেক সুরক্ষিত হবে, তাদের অনেক বঞ্চনার অবসান হবে। সবচেয়ে বড় কথা, হাজার বছর ধরে অবমূল্যায়ন আর অবমাননার যে শ্রম অদৃশ্য হয়ে আছে, যে শ্রমের কোনো স্বীকৃতি নেই, সে শ্রমের স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, নীতিমালায় বলা হয়েছে গৃহকর্মী, গৃহশ্রমিক নয় কেন! নীতিমালার গৃহকর্মের সংজ্ঞা অনুযায়ী গৃহকর্ম হচ্ছে গৃহস্থালির সব কাজ যা ব্যবসা বা মুনাফার সঙ্গে জড়িত নয়। অর্থাৎ গৃহকর্ম হচ্ছে অনুৎপাদনশীল (?) কাজ এবং এ কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা গৃহকর্মী। জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় ২৩, ২৪ ও ২৫ অনুচ্ছেদে শ্রমিকের মানবাধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সব কর্মী বা শ্রমিকের সমমজুরি, বিশ্রাম, অবসর, যুক্তিযুক্ত কর্মঘণ্টাসহ শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষার্থে সব অধিকার সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে; কিন্তু অন্যান্য শ্রমিকের জন্য যেসব সুবিধা রয়েছে গৃহশ্রমিকদের জন্য তা নেই।
বস্তুত আবহমানকাল থেকেই গৃহের শ্রমকে কোনো শ্রম হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি। জিডিপিতেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত নারীর এ গৃহশ্রম ও পরিবারকে ভালোবেসে যে শ্রম প্রদান করে তাকে 'ভালোবাসার অর্থনীতি' আখ্যায়িত করে ভালোবাসার অর্থনীতির আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করেছেন প্রায় ২ লাখ ৪৯ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা। জিডিপিতে এই মূল্যমান যোগ করা হলে জিডিপি বেড়ে দাঁড়াবে ৭ লাখ ১৭ হাজার ১২ কোটি টাকা। সে হিসাবে ভালোবাসার অর্থনীতির আয়তন হবে বর্তমান জিডিপির ৫৩ শতাংশ। এ হিসাবের ভিত্তি হলো বাংলাদেশে ১০ বছর ও তদূর্ধ্ব নারীরা গৃহস্থালি কাজে বছরে সময় ব্যয় করেন ১৬ হাজার ৬৪১ কোটি শ্রমঘণ্টা।
গৃহশ্রমিকরা সাধারণত নিগৃহীত হয় গৃহকত্রী দ্বারা। এ নিগ্রহের মূল কারণও হচ্ছে গৃহশ্রমের অস্বীকৃতি। গৃহশ্রমের স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন না থাকায় গৃহকর্ত্রীও অবমূল্যায়িত। অবমূল্যায়নের ফলে তার ভেতর জন্ম নেয় ক্ষোভ এবং প্রতিশোধপ্রবণতা। সে অবমূল্যায়িত। তার গৃহশ্রমের যেমন স্বীকৃতি মেলে না। তার কাছে গৃহশ্রমিকও ন্যায্য ব্যবহার ও মূল্যায়ন পায় না।
কোনো ব্যক্তি বা কাজকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করা হলে, ন্যায্য পাপ্য প্রদান না করা হলে এবং ন্যায়বিচারের ঘাটতি হলে সেখানে নানা অন্যায়-অনিয়মের জন্ম হয়। গৃহশ্রমকে ঘিরেও তাই হয়েছে। গৃহশ্রমিক যেমন নানা নিপীড়ন-নির্যাতন, বঞ্চনার শিকার হচ্ছে, তেমনি নিয়োগকর্তাকেও নানা সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। নাগরিক জীবন জটিল হয়ে ওঠায় এবং কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় গৃহশ্রমিকের চাহিদা ব্যাপকহারে বেড়েছে। গার্মেন্ট খাতসহ অন্যান্য শিল্পখাতে নারী শ্রমিকের প্রচুর চাহিদা এবং বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে গৃহকর্মে নারী শ্রমিকের চাহিদা থাকায় দেশে গৃহশ্রমিকের সংকট রয়েছে। এ সংকটকে পুঁজি করে অনেক সময় গৃহশ্রমিকরাও নানা সুযোগ নিচ্ছে এবং অরাজক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটাচ্ছে। অনেক অন্যায় এবং গুরুতর অপরাধের জন্ম দিচ্ছে এবং অনেক দুর্ঘটনাও হচ্ছে। এসব কিছুর সমাধান অবশ্যই এ খাতটাকে নিয়ম-নীতির মধ্যে নিয়ে আসা, একটা জবাবদিহিতা ও আইনের কাঠামোর ভেতর একে নিয়ে আসা।
সে জন্য নীতিমালাকে অবশ্যই স্বাগতম। কোনো অন্যায় এবং অসঙ্গতি দূর করতে হলে তাকে গোড়া থেকে উৎপাটন করতে হয়। রোগকে আগে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে হয়, তারপর ওষুধের ব্যবস্থা। তা না হলে শুভ কিছু আশা করা যায় না। গৃহশ্রমের এত শোষণ অবমূল্যায়ন আর বঞ্চনার কারণ হচ্ছে এক শ্রম হিসেবে চিহ্নিত না করা, উৎপাদনে এর ভূমিকাকে অস্বীকার করা। নীতিমালায়ও গৃহশ্রমকে শ্রম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। গৃহশ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে গৃহের শ্রমকে শ্রমের মর্যাদা দিতে হবে। শ্রমের স্বীকৃতিই যদি সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত না হয়, তবে শ্রম বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা কি প্রতিষ্ঠিত হবে! তাই নীতিমালাই যদি করতে হয়, তাদের ন্যায্য পাওনাই যদি নিশ্চিত করতে হয় এবং গৃহশ্রম দেওয়া-নেওয়ার ক্ষেত্রে যদি একটা সুষ্ঠু প্রক্রিয়া ও জবাবদিহিতা তৈরি করতে হয় তবে অবশ্যই আগে একে শ্রমের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

নূর কামরুন নাহার : কলাম লেখক
nurquamrunnaher@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.