শ্রমিক আন্দোলন-সংগঠনের ধারণা নতুনভাবে বিন্যস্ত হচ্ছে by আনু মুহাম্মদ

ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলেও যেহেতু শ্রমিকদের মজুরিসহ বঞ্চনা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, সেহেতু ক্ষোভ-বিক্ষোভও সমাজে বিস্তৃত হচ্ছে। সে জন্য গত এক দশকে শ্রমিক আন্দোলনের একটি নতুন চেহারা আমরা দেখতে পেয়েছি। এ আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্ত, অনেক বিস্তৃত।


তবে দিকনির্দেশনার অভাবে মাঝে মধ্যেই পর্যুদস্ত


বাংলাদেশে গত চার দশকে সমাজ ও অর্থনীতির মধ্যে যে পরিবর্তনগুলো হয়েছে, তার একটি বড় বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণীর গঠনের পরিবর্তন। বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংস্কারের নামে আশির দশক থেকে অনেকগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষিত হয়েছে। সর্বশেষ বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে আদমজী পাটকল। এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প-কারখানা বন্ধ হওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। আশির দশক পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প খাতের শ্রমিকরাই ছিল শিল্প শ্রমিকদের প্রধান সংগঠিত অংশ। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প-কারখানা বন্ধ করায় এটি শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ ব্যক্তিদখলে নেওয়ার প্রক্রিয়াই ছিল না, একই সঙ্গে শিল্প শ্রমিকদের সংগঠিত শক্তিকে ভেঙে দেওয়ার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অংশ ছিল। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে শিল্প খাতের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প খাতের অবস্থান খুবই প্রান্তিক। একই কারণে ইউনিয়নভুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যাও তুলনায় অনেক কম। আশির দশক থেকে যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার প্রায় অনুপস্থিত। রফতানিমুখী হিসেবে গার্মেন্ট শিল্প খাতের মধ্যে এখনও প্রাধান্যে রয়েছে। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শ্রমিক এ খাতেই নিয়োজিত। কিন্তু এই খাতে কোনো ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নেই। আশির দশকের সামরিক শাসনের সময় থেকে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নসহ বিভিন্ন অধিকার থেকে বঞ্চিত করার যে সংগঠিত আয়োজন শুরু হয়, তা পরবর্তী নির্বাচিত সরকারগুলোর সময়েও অব্যাহত থাকে।
অন্যদিকে গত কয়েক দশকে একই অর্থনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে উদ্ভূত হয়েছে কয়েক হাজার দখলদার চোরাই কোটিপতি। উৎপাদনশীল প্রক্রিয়া অব্যাহত এবং বিকশিত করার চেয়ে দখল, লুণ্ঠন ও পাচারের মধ্য দিয়ে কোটিপতি হওয়াই তাদের লক্ষ্য। বাংলাদেশের রাজনীতি-অর্থনীতি প্রধানত তাদের দ্বারাই পরিচালিত। সে কারণে জনগণের বৃহত্তম অংশ শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষ তাদের নূ্যনতম গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত আছে। সে কারণে বেশিরভাগ শিল্প-কারখানায় নূ্যনতম বাঁচার মতো মজুরি আট ঘণ্টা শ্রম দিবস, নিয়োগপত্র. সাপ্তাহিক ছুটি, কাজ ও কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। গার্মেন্টের বিকাশের মধ্য দিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর গঠনে লিঙ্গীয় পরিবর্তন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হয়েছে। এখন অধিকাংশ শ্রমিকই নারী। এই শ্রমিকদের বঞ্চনা ও নিপীড়নের মধ্য দিয়ে নারী শ্রমিক নতুন প্রতিবাদী সামাজিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলেও যেহেতু শ্রমিকদের মজুরিসহ বঞ্চনা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, সেহেতু ক্ষোভ-বিক্ষোভও সমাজে বিস্তৃত হচ্ছে। সে জন্য গত এক দশকে শ্রমিক আন্দোলনের একটি নতুন চেহারা আমরা দেখতে পেয়েছি। এ আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্ত, অনেক বিস্তৃত। তবে দিকনির্দেশনার অভাবে মাঝে মধ্যেই পর্যুদস্ত। শ্রমিকশ্রেণীর বর্তমান গঠনের কারণে অস্থায়ী, দিনভিত্তিক, খণ্ডকালীন, ইনফর্মাল শ্রমিকের সংখ্যাই এখন বেশি। সুতরাং তাদের আন্দোলনে সংগঠনের ধারণাও নতুনভাবে বিন্যস্ত হচ্ছে। মে দিবসের মূল যে দাবি আট ঘণ্টা কাজ করে বাঁচার মতো মজুরি, তা থেকে বাংলাদেশের শ্রমিক মেহনতি মানুষ অনেক দূরে। বর্তমান সময়ে যে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলন এ বিষয়কে ধারণ করেই কেবল অগ্রসর হতে পারে।

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
 

No comments

Powered by Blogger.