এই সমাজ-সামাজিক শক্তির জাগরণ চাই by শেখ জিনাত আলী

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড যখন সীমাবদ্ধ গণ্ডির মধ্যে ঘুরপাক খায় বা যখন দেশের সমস্যা সমাধানে বিব্রত থাকে অথবা দোদুল্যমান তখন সমাজকে নাড়াতে হলে সমাজের সৎ, নিষ্ঠাবান দেশপ্রেমিক ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হয় মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের চাপে রেখে ঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবায়নে, মানবিক অধিকার সংরক্ষণে।


এমন একটি পরিস্থিতি এই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে হাল আমলে উদ্ভব হয়েছে। দেশের সমস্যাগুলোর তালিকা দেওয়ার জন্য এ লেখা নয়, সমস্যার গোড়াতে যাতায়াত চেষ্টা এটা অথবা বলা চলে সমস্যার কারণ অনুসন্ধানের এক নগণ্য প্রয়াস।
সমস্যাগুলো সবার জানা, পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনের পর্দায় তার খণ্ডচিত্র প্রতিনিয়ত মানুষ প্রত্যক্ষ করছে। তবে সমস্যাগুলো উপস্থাপনের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্নতা অত্যন্ত স্পষ্ট। মূলধারার পত্রিকা ও দূরদর্শন চ্যানেল হাতেগোনা কয়েকটি। মূলধারা বলতে আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মূলনীতি তথা বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি বোঝাচ্ছি। এ চার নীতি ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অত্যন্ত নৃশংসভাবে সপরিবারে হত্যা করে আমাদের সুন্দর ১৫৩ অনুচ্ছেদের সংবিধান থেকে বিদায় দেওয়া হয়েছে জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক ফরমানবলে। তারপর টানা ৩৫টি বছর দেশ শাসিত হয়েছে সামরিক আইন বা পাকিস্তানি কায়দায় বেনামে সামরিক আইনের আবহ দিয়ে। আওয়ামী লীগের শাসনামলটাতে (১৯৯৬-২০০১ সালের জুন পর্যন্ত কালটায়) সংবিধান পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। দীর্ঘ তিন দশকের অধিক সময় একটানা মূলধারার বিপরীতে মূলত প্রতিবিপ্লবী ধারায় দেশ শাসিত হয়েছে এবং এখনও সে ধারার মূলোৎপাটন না হওয়ায় অসত্য, মিথ্যাচার, ইতিহাস বিকৃতি, দুর্বৃত্তায়ন ও নানা রঙঢঙের অপরাধপ্রবণতা, মালভর্তি দোকানে ক্রমেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দারিদ্র্য, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, ধর্মান্ধতা, গোমরাহিপনা বিষয়গুলো এতটা প্রবল হয়েছে যে, সত্যকে সমাজ থেকে প্রায় নির্বাসনে পাঠানোর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এসবের মধ্যে একটি অপবিত্র সম্পর্ক বিদ্যমান। মানুষ মানুষের জন্য_ এ কথাটা এখন আর হালে পানি পাচ্ছে না। বাঙালি সমাজ বিভিন্ন ধর্ম মতের মানুষের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এবং আমাদের সমাজের শক্তিটা এখানে নিহিত। অসাম্প্রদায়িকতা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটি স্তম্ভ। বাঙালি সমাজের সমন্বয় ধর্মিতার মধ্যে আরও রয়েছে আদিবাসী নৃতাত্তি্বক গোষ্ঠীগুলো, যারা পাহাড়ি আবাসভূমিতে বিস্তার লাভ করে আছে। তাদের জীবন অপশাসনে হুমকির মুখে। ৫০টির মতো আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভাষা-সংস্কৃতি বিলুপ্তির পথে। তারা আমাদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে বৈচিত্র্য দিয়ে এবং তারা মুক্তিযুদ্ধে সবার সঙ্গে একযোগে অংশগ্রহণ করেছে। আমাদের সংবিধানে ১৯ অনুচ্ছেদে (১) 'সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন'। (২) 'মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধা দান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।'
প্রায় তিন যুগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে একটি প্রতিবিপ্লবী ধারায় সামরিক শাসন জারি করে দেশ পরিচালনা করেছে সেনা ছাউনিতে জন্ম নেওয়া দুই জেনারেলের দল। এতে রাজনীতি ও দেশের যে ক্ষতি হয়েছে তাকে কেউ কেউ বিবেচনায় না নিয়ে যে লেখালেখি পত্রিকায় আমরা দেখছি তাতে দুই বড় দলের পাল্টাপাল্টি চিত্র চিত্রায়িত করা হচ্ছে কোনোরকম বাছবিচার না করে। তাতে বাঙালি জাতির ক্ষতটা অনেক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। সামরিক ছায়ায় গড়ে তোলা দলকে এক প্রকার গ্রহণযোগ্যতা দেওয়া হচ্ছে। মূলধারার রাজনীতি এখন প্রায় নির্বাসিত আমাদের সমাজ থেকে। আওয়ামী লীগ একটি প্রাচীন দল এবং পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এ পর্যায়ে উপনীত। তার মধ্যে অনেক দোদুল্যমানতা রয়েছে। সততা ও নিষ্ঠার অভাব থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে এখনও দূরে চলে যায়নি, যেতে পারে না এ দল। এই কথাটা অনেক বাঘা বাঘা রাজনীতিক ও পত্রিকা মানতে, বুঝতে চাইছেন না বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতে। আমাদের সাংবাদিক জগতেও এরূপ ভাবসাব চলতে দেখি। এ রকম ভাবভঙ্গিতে সংবাদ চিত্র পত্রিকার পাতায় দেখে বর্তমান প্রজন্ম ভীষণভাবে বিভ্রান্ত এবং পশ্চিমা শাসকরা এরূপ ক্ষেত্রে দু'দলের ধারা বজায় রাখতে বেজায় খুশি। একটি টিভি চ্যানেলে শুনলাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে মুক্ত বিশ্বের নেতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কোনো কোনো ভাষ্যকার দু'দলকে সমান্তরালে চিত্রিত করতে বেশি আগ্রহী মনে হয়। আওয়ামী লীগের তথা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার যে ঘোষণাপত্র দেশবাসীর কাছে উপস্থাপন করে ক্ষমতায় এসেছে তা এখনও বাস্তবায়নের পথে বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি, সরকার ক্ষেত্রবিশেষে নির্লজ্জ ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। এটা মেনে নিয়েই বাস্তবতার মুখোমুখি আমাদের হতে হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগের বিকল্প আওয়ামী লীগই। সামাজিক গণতন্ত্রী ধরনের কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে ক্ষমতাসীন, এশিয়ায় আছে ভারতে কংগ্রেস দল। জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও পছন্দমতো লোক নির্বাচিত হয় নির্বাচনবিধি অনুযায়ী। এসব দল মানুষের জন্য কিছু ভালো কাজও করে থাকে। এক সময় পৃথিবীতে সামাজিক গণতন্ত্রীদের মধ্য থেকে বাম কমিউনিস্ট পার্টির উদ্ভব হয় বস্তুবাদী দর্শনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে। আজ কমিউনিস্ট ভাবধারায় কিছু ভাটার টান লক্ষ্য করা গেলেও বস্তুবাদী দর্শনের বিকাশ ঘটে চলছে। সমস্যা হলো বস্তুবাদকে (মার্কসবাদ) আপ্তবাক্য গণ্য যারা করেছে তারাই বেশি করে হতাশ হয়েছে। এ কারণে সামাজিক গণতন্ত্রীদের সঙ্গে তাদের বিরোধ বৈরিতায় পর্যবসিত হয় এবং হয়েছে। আমাদের বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রে বিরোধ সক্রিয় থাকার ফলে সামাজিক জাগরণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে মানুষের সমস্যা বেড়েই চলছে। সংগঠিত হতে পারলেই মানুষ সৃষ্ট সমস্যা মানুষ সমাধান করতে পারে। এ ছাড়া অন্য পথ মানুষের সভ্যতায় সৃষ্টি হয়নি। বাম বস্তুবাদীদের সঙ্গে সামাজিক গণতন্ত্রীদের ঐক্য ছাড়া পৃথিবীর কোথাও কোনো সমস্যা সমাধান হয়েছে এমন কোনো নজির নেই। সামাজিক আন্দোলনের রূপটাও এই বোধ থেকে আজকাল উদ্ভব হচ্ছে। অথবা অন্য ভাষায় সুশীল সমাজের ভূমিকাও এরূপ ক্ষেত্রে অগ্রণী হতে পারে। কাজটা মূলত রাজনীতিকদের। কিন্তু রাজনীতিকরা বিশেষ করে সামাজিক গণতন্ত্রী ধরনের রাজনীতিকরা ভুল সহজে স্বীকার করতে চান না। এরূপ গোঁ-ধরা অবস্থা মানুষের ক্ষতি করে, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটায়। একে আত্মকেন্দ্রিকতা বলা যায়।
আমি যে সামাজিক আন্দোলনের কথা বলছি তার উৎপত্তি তো সভ্যতা সৃষ্টি ও বিস্তারের উষালগ্নে, কেননা মানুষের মূল সংগ্রাম প্রকৃতির বিরুদ্ধে। প্রকৃতির খামখেয়ালি রূপটা আমরা ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা, খরা, তাপমাত্রার আধিক্য বা নিম্নগতি। ভূমিকম্প এসবের মধ্যে প্রত্যক্ষ করি। এগুলোকে একমাত্র জ্ঞানার্জন দ্বারা প্রযুক্তি ব্যবহার ও উদ্ভাবন করে অনেকটা মোকাবেলা করা যায়। তবে মানুষ সৃষ্ট সমস্যা বড় হয়ে দেখা দেয় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, কৃষকের কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাধা, শ্রমিকের জীবনধারণের অনুপযুক্ত বেতন-ভাতা, রাস্তাঘাট, পয়ঃপ্রণালির দুরবস্থা, যোগাযোগে বিঘ্ন সৃষ্টি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি সরবরাহের বেহাল দশা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাবনীয় অব্যবস্থা, বিচারালয়ের সুবিচার না পাওয়া, অফিস-আদালতে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঘুষ-দুর্নীতি, মানুষের মধ্যে ধর্ম বিশ্বাস ও জাতিগত বিদ্বেষ-দেশান্তর, স্বাস্থ্যসেবায় অমার্জনীয় অব্যবস্থা-দুর্নীতি ইত্যাদিতে। আজকাল রাজনৈতিক নেতাদের, অফিসের আমলাদের কাছ থেকে অহরহ সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক আসে ওমুক সমস্যার ক্ষেত্রে, তমুক সমস্যার ক্ষেত্রে। মোটকথা সামাজিক আন্দোলন সর্বত্র বিরাজমান। এটি একই সঙ্গে সাংস্কৃতিক আন্দোলনও বটে। মাদকাসক্ত, নারী নির্যাতন আজকাল আলোচনার প্রাণকেন্দ্র, ফতোয়াবাজি ও দোররার আঘাতে শরীয়তপুরের হেনা নামের কিশোরীর মৃত্যু জনজীবনকে নাড়া দিয়ে গেল। গ্রামে, একেবারে অজপাড়াগাঁয়ে কতশত কিশোরী ধর্ষণের শিকার তার খবর আমরা কতটাই জানি। শহর-নগরে এক ধরনের অপসংস্কৃতি গড়ে উঠছে, আমাদের ভাষার ব্যবহার অপাঙ্ক্তেয় এবং এটি গ্রামাঞ্চলের সহজ-সরল মানুষের মধ্যেও সংক্রমিত হচ্ছে। আমাদের জীবনধারা ভেঙে যাচ্ছে ও প্রজন্ম দিশেহারা পশ্চিমা বাতায়নে। এটি বাঙালি সমাজের প্রতি একটি আঘাত। আমাদের পরিবারগুলো একই সঙ্গে ভেঙে যাচ্ছে। মেকি সভ্যতার হাতছানিতে জঙ্গিরা যে কোনো সময় আঘাত হানতে পারে। আসুন, আমরা এসবের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ-প্রতিকার গড়ে তুলি। সামাজিক আন্দোলন গড়ি পাড়া-মহল্লায়।

ড. শেখ জিনাত আলী : শিক্ষক
 

No comments

Powered by Blogger.