কণ্ঠস্বর-লাদেন নেই কিন্তু তারপর? by রাহাত খান

দৈনিক সমকালে আমার নির্ধারিত লেখাটা প্রায় শেষ করে এনেছিলাম। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সংবিধান নিয়ে নানারকম কথাবার্তা চলছে। চলছে নানা মতের বক্তৃতা-বিবৃতি দেওয়া। হুঙ্কার দেওয়া এবং তর্জন-গর্জন করাও কিছু কম হচ্ছে না। লিখেছিলাম এই প্রসঙ্গেই।


তৃতীয় বিশ্বের নানা দেশে বাহুবলে ক্ষমতায় আসা লৌহমানব বা একনায়করা প্রথমেই যা করতেন তা হচ্ছে সংবিধান বাতিল করা। কিংবা সংবিধানের মূল নীতিগুলো তছনছ করে দেওয়া। এই বিষয়টি প্রসঙ্গক্রমে আমার লেখায় উঠে এসেছিল। তৃতীয় বিশ্বের নানা উপদ্রুত দেশের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে সংবিধান বিষয়ক আমার লেখাটায় আরও বলতে চেয়েছিলাম, বাহুবলে ক্ষমতাসীন হওয়া স্বৈরশাসকরা যাই ভাবুন, একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক সংবিধানের অনুশাসনই শুধু পারে খুব দ্রুত লয়ে না হলেও সঠিক পন্থায় দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে।
আমার লেখা প্রায় শেষ। এই সময় একটি মৃত্যু সব ওলটপালট করে দিল। বাধ্য হয়ে আমার প্রায় শেষ হওয়া লেখাটাকে বিবেচনার বাইরে নিক্ষেপ করতে হলো। শুধু আমার তো নয়, গোটা মিডিয়া জগৎকেই আগের সব আয়োজন, সব প্রস্তুতি বাদ দিয়ে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসতে হলো সন্ত্রাস ও অন্ধকার জগতে যার বসবাস সেই ওসামা বিন লাদেন এবং তার মৃত্যু সংবাদকে। ইতিমধ্যে প্রায় সবাই জেনে গেছে, লাদেনের মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। প্রতিপক্ষের আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে রক্তাক্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন লাদেন। লাদেন ছিলেন পশ্চিমা এবং গণতান্ত্রিক বিশ্বের বিপক্ষে দাঁড়ানো এক সশস্ত্র অধিনায়ক। নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত সারাবিশ্ব প্রায় বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে, লাদেন এক অপ্রতিহত শক্তি, তাকে গ্রেফতার করা বা মেরে ফেলা অসম্ভব ব্যাপার।
বিশ্ববাসীর এরকম বিশ্বাস বা হতাশার কারণ আছে। প্রভাব, লোকবল, অস্ত্রবল, কোনোদিক দিয়েই লাদেন তার মূল প্রতিপক্ষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধারেকাছে ছিলেন না। কোনো দেশের শাসক বা অধিকর্তাও ছিলেন না লাদেন। এরপরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে আক্রমণের সূচনা করেন তিনিই। ফিলিস্তিনে যুগের পর যুগ মুসলমানদের ওপর ইসরায়েলের দমন-পীড়ন লাদেনকে উত্ত্যক্ত এবং ক্ষুব্ধ করেছিল খুবই। কিন্তু লাদেন হয়তো অসম্ভবের চেয়েও বেশি সাহস দেখিয়ে ফেলেছিলেন। মোল্লা ওমরের আতিথ্য গ্রহণ করে আফগানিস্তান থেকে আফ্রিকার দুটি দেশের দুটি মার্কিন দূতাবাসে মিসাইল নিক্ষেপ করেছিলেন বর্তমান-ভবিষ্যৎ কিছুই চিন্তা না করে।
এরপর প্রতিপক্ষ অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশোধ নেওয়ার পালা। বিল ক্লিনটন তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। খুব একটা প্রতিহিংসাপরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন না। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আক্রমণ? এই 'বেয়াদবি' তো সহ্য করা যায় না। শুরু হয় আফগানিস্তানের বিপক্ষে পাল্টা মিসাইল আক্রমণ। পাশাপাশি পাকিস্তানের সহায়তায় বিমান হামলা। তালেবান রাজত্ব চুরমার হয়ে গেল। মোল্লা ওমর এবং লাদেন আশ্রয় নিলেন কান্দাহারের দুর্ভেদ্য গুহায়।
রাজ্যহারা মোল্লা ওমরের আর এক পয়সার দাম ছিল না। কিন্তু লাদেন এবং তার তথাকথিত জিহাদের থিয়োরিস্ট জাওয়াহিরি সৌদি আরব এবং অন্যান্য তেলসমৃদ্ধ আরব দেশগুলোর মার্কিন ও ইসরায়েলবিরোধী ধনকুবেরদের কাছ থেকে অঢেল অর্থ সাহায্য আদায় করে সশস্ত্র আল কায়দা গ্রুপকে আগের চেয়েও বেশি শক্তিশালী করে গড়ে তোলেন। কাণ্ডজ্ঞানহীন এবং একরোখা আল কায়দা এরপর বর্তমান শতকের সবচেয়ে বিধ্বংসী ঘটনাটা ঘটনায়। আত্মঘাতী কয়েকটি বিমান হামলা চালিয়ে তারা ধ্বংস করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কস্থিত বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রের অতিকায় ভবনটি, ধ্বংস করে পেন্টাগনের দু'একটি ভবন। এছাড়া পেনসিলভানিয়া এবং ওয়াশিংটনেও তারা ব্যর্থ বিমান হামলা চালিয়েছিল। বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রের হামলায় ভবনটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় এবং প্রায় পাঁচ হাজার নিরীহ, বেসামরিক নর-নারী ও শিশু নিহত হয় ওই হামলায়। নিহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশিও ছিলেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট তখন ডবি্লউ জর্জ বুশ জুনিয়র। প্রতিশোধ নিতেই এরপর মার্কিন বাহিনী প্রথমে বিমান ও মিসাইল হামলা চালিয়ে আফগানিস্তানকে ধ্বস্ত-বিধ্বস্ত করে। এরপর মার্কিন সৈন্যরা নানারকম ফাঁদ পেতে লাদেনকে জীবন্ত ধরার চেষ্টা চালায়। পরে প্রেসিডেন্ট বুশ লাদেনকে 'মোস্ট ওয়ান্টেডম্যান' হিসেবে ঘোষণা করে জীবিত বা মৃত লাদেনকে ধরার নির্দেশ দেন। নাইন-ইলেভেনের পর লাদেন আমেরিকার ওপর আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ কিছু চালাতে পারেননি। এমনকি বুশ প্রেসিডেন্সি যখন তেলসম্পদ লুণ্ঠনের গোপন ইচ্ছা গোপনে রেখে ইরাক আক্রমণ করে, আরব জাতীয়তাবাদের একজন নিশান-বরদার হয়ে ওঠা প্রেসিডেন্ট সাদ্দামকে প্রহসনের বিচারে ফাঁসিতে ঝুলায়, সমস্ত ইরাক বোমা মেরে লণ্ডভণ্ড করে দেয়, তখনও কিছু করা দূরে থাক এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন আল কায়দাপ্রধান বিন লাদেন। ২০০৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত নিশ্চিত ধরা পড়ার পাঁচ পাঁচটি মার্কিন প্রচেষ্টা তিনি ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন। এ জন্য বিশ্বের বহু লোকই ভাবতেন, লাদেন হয়তো অপরাজেয় কোনো শক্তি নন, হয়তো আল কায়দাকে ধ্বংস করা কিংবা ধ্বংসের কাছাকাছি পেঁৗছে দেওয়া অসম্ভব কিছু নয়। তবে ওসামা বিন লাদেনকে ধরা বোধকরি অসম্ভবের চেয়েও বেশি কিছু। মানুষের কাছে প্রায় অকল্পনীয় এবং প্রায় অভাবনীয় ছিল প্রতিপক্ষের হাতে বিন লাদেনের ধরা পড়া কিংবা নিহত হওয়ার বিষয়টি। কিন্তু এখন লাদেন সম্পর্কে অকল্পনীয়, অভাবনীয় এবং অসম্ভব_ এই তিনটি শব্দই অর্থহীন এবং অকেজো হয়ে পড়েছে। চূড়ান্ত পরীক্ষা এবং যাচাইয়ে দেখা যায়, ওসামা বিন লাদেনের সারা শরীর রক্তাক্ত এবং প্রাণহীন। লাদেনকে না ধরতে পারার অসম্ভবের গল্পটি ২০১১ সালের ২ মে অবান্তর ও অসত্য বলে প্রতিপন্ন হয়েছে।
বিন লাদেন আর নেই। এখন তিনি মৃত। কেউ কেউ তাকে চিহ্নিত করেন একজন সাচ্চা মুসলিম জাতীয়তাবাদী হিসেবে। কেউ কেউ মনে করেন, বিন লাদেন ছিলেন একজন 'ইভিল জিনিয়াস' বা 'প্রতিভাবান এক শয়তান'। মার্কিন বা পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সবাই যে তাকে দেখবেন, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। আমরা বরং কোনো মন্তব্য না করে ইতিহাসের ওপরই লাদেনের বিচার করাটা ছেড়ে দিলাম। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, নাইন-ইলেভেনে আত্মধ্বংসী বিমান হামলা চালিয়ে বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রের অতিকায় ভবনটি ধ্বংস করা এবং প্রায় পাঁচ হাজার নিরীহ, বেসামরিক লোককে হত্যা করা ছিল এক জঘন্য অপরাধ। শতাব্দীতে এভাবে কয়েক হাজার নিরপরাধ লোককে এমন নৃশংসভাবে হত্যার নজির নেই।
ওসামা বিন লাদেনের যারা বিশ্বস্ত বন্ধু ও জীবনীকার, তারা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন যে, বালক বয়সে ওসামা ছিলেন একটু লাজুক স্বভাবের। তার বাবা মোহাম্মদ বিন লাদেন ছিলেন সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় কন্ট্রাক্টর এবং সবচেয়ে বিত্তশালী লোকদের একজন। তার এক খালা বা ফুফুর বিবাহ সূত্রে সৌদি বাদশাহেরও আত্মীয় ছিলেন তিনি। তালাক দিয়ে দিয়ে সবসময় চারজন স্ত্রী রাখার অনুসারী মোহাম্মদ ছিলেন ৫০ সন্তানের পিতা। ওসামা ছিলেন তার পিতার দশম স্ত্রীর একমাত্র সন্তান। পিতাকে অল্প বয়সে হারান। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে যে সম্পত্তি ও অর্থ পেয়েছিলেন তা ছিল কয়েক মিলিয়ন ডলারের সমমূল্যের। ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে ওসামা দেশে ফিরেছিলেন সম্ভবত পিতার থেকে পাওয়া কনস্ট্রাকশন ব্যবসা ভালোভাবে দেখাশোনা করতেই এবং এর প্রসার ঘটাতে। তার জীবনে এ সময় তিনটি ঘটনা ঘটে যা জীবনের মোড় সম্পূর্ণই ঘুরিয়ে দেয়। দেশে ফেরার পর তার খুবই প্রিয় ও অন্তরঙ্গ এক সৎ ভাইয়ের হত্যাকাণ্ড ঘটে। এরপর ব্যবসায়েও নানা গোলমাল চলছিল, খুব বড় ব্যবসায়ে যা সাধারণত ঘটে থাকে। তৃতীয় ঘটনাটি হচ্ছে জনৈক ফিলিস্তিনি পণ্ডিতের সঙ্গে দেখা হওয়া, যিনি ওসামাকে আফগানিস্তানে গিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে 'বিপ্লবে' অংশ নিতে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করেন।
নানা কারণে সংক্ষুব্ধ, একটুবা হতাশ ওসামা শেষ পর্যন্ত পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন দেওয়া আফগানদের রুশ তাড়াবার 'বিপ্লবেই' অংশ নেন। চেহারায় বিশিষ্ট, অস্ত্রবিদ্যায় অসাধারণ এবং চিন্তা ও চেতনায় উচ্চাকাঙ্ক্ষী লাদেনকে চোখে পড়ে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর এবং তারাই উৎসাহ জুগিয়ে জীবনে বড় কিছু করার উপযোগী করে তোলেন লাদেনকে। ভাগ্যেরই পরিহাস বলতে হয়, ওসামাকে তৈরি করেছিল সিআইএ_ শেষ পর্যন্ত বিরুদ্ধপক্ষে যাওয়ার 'অপরাধে' সেই সিআইএর হাতেই মৃত্যু ঘটল ওসামার।
ওসামা তো নেই। পরপারে। তার এই মৃত্যু জঙ্গি দল হিসেবে আল কায়দাকে কি বহুদিনের জন্য রক্ষণাত্মক ভূমিকায় ঠেলে দেবে? মৃত্যু সংক্রান্ত আলোচনায় ওসামা বিন লাদেন প্রায়ই বলতেন, এক ওসামার মৃত্যু হলে হাজার ওসামার জন্ম হবে। কথাটা ওসামার বিশাল ব্যক্তিত্বের পরিপূরক বটে। তবে ইতিহাস ভিন্ন কথা বলে। যুদ্ধে এক সেনাপতি মারা গেলে তার জায়গা নেয় আরেক সেনাপতি। কিন্তু দ্বিতীয় সেনাপতি যদি বিগত হওয়া প্রধান সেনাপতির যুদ্ধ পরিচালনার সেই মেধা ও সক্ষমতা না থাকে? সিজারের নিহত হওয়ার পর দ্বিতীয় সিজার কেউ জন্মেনি। জাওয়াহিরি ওসামা বিন লাদেনের শূন্যস্থান পূরণের ঘোষণা দিয়েছেন বটে। তবে তিনি তো নিতান্তই এক তাত্তি্বক। তার সামরিক পারদর্শিতা ও মেধা দূরে থাক, এখন প্রায় অবশ্যম্ভাবী বিবদমান আল কায়দাকে দল হিসেবে টিকিয়ে রাখার সাংগঠনিক দক্ষতা তার আছে বলে কেউ মনে করেন না। ওসামার মৃত্যু আল কায়দা এবং বিশ্বব্যাপী তৈরি ধর্ম ব্যবসায়ী উগ্র জঙ্গিদের পশ্চাদপসরণে বাধ্য করবে বলে অনেকে মনে করেন। জঙ্গি-হাফ জঙ্গি নির্বিশেষে জঙ্গিবাদীরা অন্তত এই মুহূর্তে আশ্রয়ের জন্য ইঁদুরের গর্ত খুঁজবে। গণতান্ত্রিক বিশ্বের জন্য সুসংবাদ বয়ে এনেছে ওসামা বিন লাদেনের আকস্মিক মৃত্যু। অনেকে মনে করেন, বহুকাল চলবে ওসামার মৃত্যুর শুভ প্রতিক্রিয়া। নাইন-ইলেভেনের পর যে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা বিশ্বকে গ্রাস করেছিল, একটু একটু করে সেটা কেটে যেতে শুরু করলেও ওসামার মৃত্যুতে এখন হয়তো অর্থনৈতিক মন্দা অতিক্রমণের সেই প্রচেষ্টা কল্পনার চেয়েও বেশি দ্রুত হবে।

রাহাত খান : সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.