রোহিঙ্গা সংকট-১-অপরাধের আখড়া রোহিঙ্গা বসতি-নাগালের মধ্যেই ইয়াবা, চাইলে অস্ত্রও মেলে by মেহেদী হাসান ও রফিকুল ইসলাম

বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ গত জানুয়ারি মাসে কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের কাছে ধরা পড়েছিলেন মিয়ানমার থেকে আসা দুই নারী। তাঁদের গন্তব্য ছিল কক্সবাজার শহর। গত মার্চ মাসে কুতুপালং শিবিরের ভেতরে শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত এক নারী ধরা পড়েন আধা কেজি গাঁজা ও দুই লাখ সাত হাজার টাকা নিয়ে।


এভাবে প্রায় প্রতিদিনই ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইনসহ নানা ধরনের মাদক নিয়ে ধরা পড়ছে মিয়ানমার থেকে আগতরা। তারা রোহিঙ্গা নামে পরিচিত। স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, ওই রোহিঙ্গারাই এখন বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে মাদক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশ সরকারের উদারতার সুযোগে এ দেশে আশ্রয় নিয়ে তাদের বসতিগুলোকেও ইয়াবাসহ নানা রকম মাদকের আখড়া বানিয়েছে তারা। এ দেশে শরণার্থী শিবির ও এর আশপাশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের আয়ের অন্যতম উৎস মাদক। রোহিঙ্গাদের ঘিরে টেকনাফ এলাকায় মাদক ব্যবসা জমিয়ে তুলেছে স্থানীয় প্রভাবশালী চক্র। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, কেবল মাদক নয়, দেশি-বিদেশি অবৈধ অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গেও ওরা জড়িত।
গত মে মাসের শেষ সপ্তাহে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের কাছাকাছি বসতি স্থাপনকারী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানায়, টাকা দিলেই তারা ইয়াবা দেবে। এগুলো আসে মূলত মিয়ানমার থেকে। স্থানীয় বাসিন্দাদের কয়েকজন জানায়, উখিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত যে পরিমাণ অত্যাধুনিক মোটরসাইকেল চোখে পড়বে, তার অর্ধেকও দেখা যায় না কক্সবাজার শহরে। মোটরসাইকেল আরোহী যুবকদের অনেকেই মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাদের আনাগোনা মিয়ানমার সীমান্ত, রোহিঙ্গাদের বসতি আর বাস টার্মিনাল ঘিরে। পরে বাস-মিনিবাস, ট্রলারে নানা বেশের যাত্রীর মাধ্যমে ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদক ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে।
ইয়াবা কিভাবে ঢুকছে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উখিয়ার এক ব্যক্তি বাংলাদেশের কাছাকাছি মিয়ানমারের মংডু শহরে কয়েকটি কারখানার কথা উল্লেখ করেন। তবে তাঁর দাবি, ওই কারখানাগুলোতে উৎপাদিত ইয়াবা খুবই নিম্নমানের। এ ছাড়া তিনি বলেন, অনেক সময় দেখা যায়, জ্বর বা অসুস্থতা নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বয়স্ক ব্যক্তিরা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েন। এরপর কর্তৃপক্ষ তাঁদের আটকালে তাঁরা পায়ে ধরে অসুস্থতার কথা জানান। চিকিৎসা খরচ মেটাতে অনেক সময়ই তাঁরা সঙ্গে নিয়ে আসেন ইয়াবা, যা বিক্রি করে বা ঘাটে ঘাটে দিয়ে বাংলাদেশের বেশ ভেতরে পৌঁছান।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, ইয়াবা ও অন্যান্য মাদকসহ মিয়ানমার থেকে আগতরা ধরা পড়লেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা পার পেয়ে যায়। কারণ একবার তাদের কারাগারে পাঠানোর অর্থ হলো- তাদের দায়দায়িত্ব অনেকটা এ দেশেরই কাঁধে চলে আসা। কেননা মিয়ানমার তাদের নাগরিক বলে স্বীকার না করায় ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়াটিও অনেক জটিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো আরো জানিয়েছে, রোহিঙ্গা বসতিগুলোর আড়ালে মাদকের পাশাপাশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে নারী-শিশুসহ মানব পাচার, মৌলবাদী ও জঙ্গি তৎপরতা, যৌন ব্যবসা, চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, ছিনতাইয়ের মতো গুরুতর সব অপরাধ। এসব এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছেন রোহিঙ্গা নেতা বা সরদাররা। তাঁরা পরিচিত 'মাঝি' নামে। তাঁদের অনেকেই মিয়ানমারে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রশিক্ষিত রোহিঙ্গা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উপস্থিতি : প্রশিক্ষিত রোহিঙ্গা বিচ্ছিন্নতাবাদীরা নামে-বেনামে বাংলাদেশে অবস্থান করছে। তারা বিগত বছরগুলোর সময়েও বাংলাদেশে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণে ভূমিকা রেখেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, ১৯৮৬ সালে প্রথম রোহিঙ্গা বিচ্ছিন্নতাবাদী ডা. ইউনুস ও নুরুল ইসলাম গড়ে তোলেন 'রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশন' বা 'আরএসও'। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের দুর্গম পাহাড়ি অরণ্যে সে সময় সংস্থাটি একাধিক সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচালনা করে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে আরএসও ভেঙে সেলিম উল্লাহর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে 'আরকান আর্মি' নামে নতুন গেরিলা সংগঠন। কিছুদিন যেতে না যেতেই ফের ভাঙনের কবলে পড়ে উভয় সংগঠন। সৃষ্টি হয় 'আরকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অরগানাইজেশন' বা 'এআরএনও'। সীমান্তবর্তী অরণ্যগুলোতে তৎপরতা চালাতে থাকে থাইল্যান্ড সীমান্তভিত্তিক কারেন গেরিলার অংশ 'ন্যাশনাল ইউনাইটেড পার্টি অব আরকান' বা 'নোপা'। এর নেতৃত্ব দেয় ২০০৪ সালে বঙ্গোপসাগরে ১৪ মাঝিমাল্লা হত্যার প্রধান আসামি নাজমুল আলম চৌধুরী। ওই সময় সৃষ্টি হয় ডা. নুরুল ইসলাম ও জহিরের নেতৃত্বে 'আরকান রোহিঙ্গা ইন্টেলিজেন্স ফোর্স' বা 'আরিফ', 'ইক্তেদাতুলা আল মুসলেমিন' বা 'আইটিএম', 'ইউনাইটেড স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন অব আরকান মুভমেন্ট' বা 'ইউএসএএন'সহ বেশ কয়েকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ। এই বিচ্ছিন্নতাবাদী রোহিঙ্গা গ্রুপগুলোর প্রকাশ্য তৎপরতা চলে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। ২০০৪ সালের ১ অক্টোবর নাইক্ষ্যংছড়ির তৎকালীন বিডিআরের ফাঁদে ভারী অস্ত্রসহ ধরা পড়ে এআরএনও কমান্ডার আনোয়ার। মূলত সেই থেকে রোহিঙ্গা বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পাহাড়ে তাদের গেরিলা ট্রেনিং ক্যাম্পগুলো গুটিয়ে নিতে শুরু করে। তাদের হাতে থাকা বিপুল পরিমাণ ভারী অস্ত্র, গোলা-বারুদ পাহাড়ে নিরাপদে মাটির নিচে লুকিয়ে রাখে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
আনোয়ারের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার পাহাড়ি সীমান্ত এলাকায় ২০০৫ সালে তৎকালীন বিডিআর ও নিরাপত্তা বাহিনীর যৌথ অভিযানে একে-৪৭, এম-৬০, এলএমজি, এসএমজি, থ্রিনটথ্রি রাইফেল, পিস্তল, রিভলবারসহ তিন শতাধিক ভারী অস্ত্র, প্রায় ৭০ হাজার গুলি, ৩৬০টি ম্যাগাজিন, ১৪টি রকেট লঞ্চার, ৪১টি গ্রেনেড ও মাইন, ৪৮টি ওয়াকিটকি, ১৪টি টেলিস্কোপ, পাঁচ কেজি বিস্ফোরক, ৭৫ সেট সেনা পোশাক, ৩২টি অ্যান্টি পার্সোনেল মাইনসহ বিপুল পরিমাণ যুদ্ধসরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছিল।
জঙ্গি তৎপরতা : রোহিঙ্গা বিচ্ছিন্নতাবাদী বিভিন্ন সংগঠনের সহযোগিতায় এ দেশে মৌলবাদী জঙ্গি তৎপরতা শুরু হয় নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে। ১৯৯৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি উখিয়ার থাইংখালী লুণ্ডাখালীর গহিন জঙ্গল থেকে নিরাপত্তা বাহিনী অভিযান চালিয়ে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বা হুজির ৪১ সদস্যকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রসহ আটক করে। এই ৪১ জঙ্গির মধ্যে তিনজন রোহিঙ্গা বলে জানা গেছে।
২০০০ সালের ২৯ আগস্ট উখিয়ার সমুদ্র তীরবর্র্তী ইনানীর জুমশিয়া গহিন অরণ্যে পুলিশ, বিডিআর, আনসার যৌথ অভিযান চালিয়ে জঙ্গিদের একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প, অস্ত্র পাচার এবং সমুদ্রপথে অস্ত্র খালাসের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেয়। ক্যাম্পে প্রশিক্ষণরত ৬০ জঙ্গি পালিয়ে গেলেও মিয়ানমারের মংডুর আন্ডাং এলাকার আবু ইয়াছির ধরা পড়ে। ১৯৯৮ সালের ১১ নভেম্বর উখিয়া থানার পুলিশ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের ডেইলপাড়া গ্রামে অভিযান চালিয়ে হরকাতুল মুজাহিদের সক্রিয় সদস্য বগুড়া সদর উপজেলার নুরুল ইসলামের ছেলে আবদুল হান্নান ও সুলতান আহমদের ছেলে আবুল খায়েরকে গ্রেপ্তার করে। হান্নান স্বীকারোক্তি দেয়, '৯৩ সালে ঢাকার লালবাগ এলাকার হরকাত নেতা মুফতি শফিকুর রহমানের দলে যোগ দেয় সে। সেখান থেকে তাকে মিয়ানমার সীমান্তের আমতলীর দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় হরকাতের ট্রেনিং ক্যাম্পে পাঠানো হয়। সেখানে চার বছর প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর অন্য সহযোদ্ধা ইয়াহিয়াসহ মিশনে ফেরার পথে ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে দুটি এসএমজিসহ বিডিআরের হাতে আটক হয়। '৯৬ সালের ২৭ মার্চ উখিয়ার ডেইলপাড়া গ্রামের সুলতান আহমদের ছেলে আবুল খায়ের ও চট্টগ্রামের আনোয়ারার পীরখাইন গ্রামের হারুনুর রশিদের ছেলে মো. জাকারিয়া যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি একটি এসএমজি, তিনটি ম্যাগাজিনসহ গ্রেপ্তার হয়। ২০০০ সালের ৭ মার্চ রাজাপালং মাদ্রাসা আশ্রয়কেন্দ্রের তৃতীয় তলায় পুলিশ অভিযান চালিয়ে হরকাতুল মুজাহিদের সশস্ত্র সদস্য নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলার জামরিলভাঙ্গা গ্রামের মোহসেন উদ্দীন, এমদাদুল ও হাফিজুল একটি এলজিসহ গ্রেপ্তার করে।
এভাবেই রোহিঙ্গা বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর হাত ধরে অসংখ্য জঙ্গি সংগঠনের নেটওয়ার্ক বিস্তৃতি লাভ করে বাংলাদেশে। মিয়ানমার সীমান্তের জঙ্গি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পগুলোতে ট্রেনিং নিয়ে শত শত বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা জঙ্গি আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে তালেবানি যুদ্ধে অংশ নেয়। এদের বেশির ভাগ বাংলাদেশে ফিরে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন নামে জঙ্গি তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।
অনেকে ইমাম ও মুয়াজ্জিন : সশস্ত্র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রায় দুই হাজার রোহিঙ্গা জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) 'আরবান রিফুউজি কার্ড' নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ছদ্ম নাম-ঠিকানায় চাকরি করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। উখিয়া ও টেকনাফের শিবিরগুলোতে প্রশিক্ষিত রোহিঙ্গারা অবস্থান নিয়ে প্রত্যাবাসনবিরোধী তৎপরতা চালাচ্ছে। উখিয়া, টেকনাফসহ কক্সবাজার, বান্দরবান ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের কয়েক শ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন 'রোহিঙ্গা' বলে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম, কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার সেলিম মো. জাহাঙ্গীর, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার ফিরোজ সালাহ উদ্দিন জানান। তারা রোহিঙ্গা শিবির বা বস্তি এলাকায় জঙ্গি তৎপরতায় অংশ নেয় বলে তাঁদের দাবি। উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন গ্রামে বিশেষ করে রোহিঙ্গা বসতিগুলোর কাছাকাছি বিভিন্ন সংগঠনের অনুদানে সুরম্য মসজিদ গড়ে উঠছে। আর সেগুলোতে ইমাম-মুয়াজ্জিনের চাকরি পাচ্ছে রোহিঙ্গারা।
টেকনাফের ৪২ বিজিবি অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাহেদ হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ইয়াবা, মাদক পাচার, ডাকাতিকাজে অস্ত্র ব্যবহারে রোহিঙ্গারা জড়িত। ইতিমধ্যে বেশ কিছু রোহিঙ্গাকে অস্ত্র, মাদকসহ আটক করা হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার সেলিম মো. জাহাঙ্গীর কালের কণ্ঠকে বলেন, রোহিঙ্গারা সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি, পাহাড়-বন ধ্বংসসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিনি বলেন, 'মাদক পাচারে এ দেশের কিছু লোক তাদের ব্যবহার করছে। তবে মাদক পাচারে তাদের কিছু অংশ জড়িত থাকলেও মানব পাচারের ক্ষেত্রে ওরা নিজেরাই আগ্রহী।' ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সীমান্ত সুরক্ষা এবং অনুপ্রবেশ রোধে সীমান্ত এলাকায় রাস্তা করলে সীমান্ত অনেকটা নিরাপদ রাখা যাবে বলে তিনি ধারণা করেন।

No comments

Powered by Blogger.