জাতীয় বাজেট ২০১২-১৩-প্রবৃদ্ধি চাই, বৈষম্যও কমাতে হবে

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১২-১৩ অর্থবছরের জন্য এক লাখ ৯১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেছেন। এবারের বাজেটে আয়ের উৎস বহুলাংশে অভ্যন্তরীণ কর ও রাজস্ব আয়। চলতি অর্থবছরের মতো বাজেটে সরকারি ব্যয় ও জিডিপির অনুপাত একই। অর্থাৎ ১৮ দশমিক ১ ধরা হয়েছে।


তাই আকস্মিক কোনো জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির মুখে না পড়লে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবকে সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছাপূরণে উচ্চাভিলাষী না বলে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা বলাই শ্রেয়। এ জন্য অর্থমন্ত্রীকে সাধুবাদ জানাতে হয়। তাকে ধন্যবাদ জানাতে হয় বাজেট বক্তৃতায় বিগত তিন বছরের অসম্পূর্ণ ও অসম্পন্ন কাজগুলোর কথা উল্লেখ করার জন্যও। তবে অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি যে ৭ দশমিক ২ ধরেছেন, সেটা কতটা বাস্তবসম্মত_ সে প্রশ্ন থেকেই যায়। উচ্চহারের প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য আমাদের যে ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন ছিল, সেটা কি আমরা করে উঠতে পেরেছি? তার ওপর বিদ্যুৎ সমস্যার মতো শিল্প বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রবণতা সৃষ্টিকারী উপাদানের যন্ত্রণাভোগী তো সাধারণ মানুষও। বিজ্ঞ অর্থমন্ত্রী হয়তো রাজনৈতিক সরকারের বাজেট করেছেন বলে তাকে জনতুষ্টির কথা বিবেচনায় রাখতে হয়েছে। এখানে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তা অব্যাহত রাখাই প্রাধান্য পাওয়া উচিত ছিল। তাছাড়া অর্থমন্ত্রী ভালোই জানেন যে, শুধু প্রবৃদ্ধিই জীবনযাত্রার ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে না; এটা নির্ভর করে প্রবৃদ্ধির চরিত্রের ওপর। এই বিশেষ দিকটি কিছু ক্ষেত্রে নজর দেওয়া হলেও সাধারণ গাইডলাইন হিসেবে অনুসৃত হয়নি। এতে সমাজে আয় ও সম্পদবৈষম্য আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারের ব্যয় খাতে কোনো নাটকীয় পরিবর্তন নেই। বরং এ ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা রক্ষার চেষ্টা দৃশ্যমান। শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দের হার হ্রাস এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। চলতি অর্থবছরে যেখানে শিক্ষা খাতে জিডিপির ২ দশমিক ৪ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, সেখানে আগামী অর্থবছরে এই হার কমিয়ে ২ দশমিক ১ শতাংশ করা হয়েছে। টাকার অঙ্কে মোট বরাদ্দ বাড়লেও জিডিপির অনুপাতে ব্যয়হার হ্রাস সরকারের শিক্ষা বিস্তারের ঘোষিত নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কৃষিক্ষেত্রও গুরুত্ব পেয়েছে এ বাজেটে। কিন্তু ভূমিহীনদের মধ্যে খাসজমি বরাদ্দের কোনো ঘোষণা নেই।
মোবাইল ফোনের ওপর করারোপ প্রস্তাব সঙ্গত হয়নি। এতে মোবাইলের ব্যবহার সংকুচিত হতে পারে। এদিকে টিআইএন না থাকলে ব্যাংকের সুদে ১০ শতাংশের বদলে ১৫ শতাংশ হারে করারোপ সাধারণ মানুষকে ক্রমে ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল করার প্রচেষ্টায় আঘাত হানবে। এখান থেকে যে পরিমাণ অর্থ পাওয়া যাবে, তা কি অন্য উৎস থেকে মেটানো যেত না? তাছাড়া যারা ব্যাংকে টাকা রাখেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন লাখ লাখ পেনশনভোগী, গৃহবধূ, ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। এখানে কর বৃদ্ধি করার সময় এসব সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনায় আনা উচিত ছিল। অর্থমন্ত্রী রফতানিকারকদের উৎসে কর দ্বিগুণ করার প্রস্তাব করেছেন। এর যুক্তিগ্রাহ্য কারণ রয়েছে কি? তাছাড়া বিশ্বমন্দার কারণে আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী রফতানি আয় না হলে এর বিরূপ প্রভাব তো বাজেটের ওপরও এসে পড়বে। বরাবরের মতো এবারও বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে। যদিও করের সঙ্গে অতিরিক্ত ১০ শতাংশ জরিমানার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এবং এই অর্থের একটা অংশ বিনিয়োগে আসবে বলে মনে করা হয়; তবুও বলতেই হবে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে এই পদক্ষেপ সাংঘর্ষিক।
নূ্যনতম আয়কর ২ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন হাজার টাকা করা হয়েছে। করযোগ্য আয়ের সীমা বৃদ্ধি করলে এর সপক্ষে যুক্তি খুঁজে পাওয়া যেত। শেয়ারবাজারকে স্থিতিশীল করতে প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এবারের বাজেটে। তবে এবারও যাতে এ বাজার ম্যানিপুলেটরদের আখের গোছানোর উপায় না হয়ে দাঁড়ায়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। বাজারদরের সঙ্গে সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করে সমাজে বিত্তবান নির্ধারণ না করার কারণে এদের বিরাট একটি অংশ সামর্থ্য অনুযায়ী কর দেয় না। অথচ বিত্তবানদের অবস্থান নির্ণয়ের মাধ্যমেই প্রায় হাজার কোটি টাকা বাড়তি আয় করতে পারে সরকার। এতে সাধারণ মানুষের ওপর করের চাপ কিছুটা হলেও কমানো যায়।
বর্জ্য শোধনাগার স্থাপন ছাড়াও বাজেটের আরেকটি ভালো পদক্ষেপ হলো, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর পরিধি আরও বৃদ্ধি এবং নিরাপত্তা কর্মসূচি নিয়ে মাস্টার ডাটাবেজ করার প্রস্তাব। এর ফলে এখানে দুর্নীতি কমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। সরকার আরও কিছু ভালো পদক্ষেপ নিতে পারে। যেমন_ সৌরবিদ্যুতের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র সোলার প্যানেল নির্মাণ শুল্কমুক্ত রাখা গেলে গ্রাম ও শহরে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার বাড়বে। এলপিজি সিলিন্ডার ক্রয়ে সাশ্রয়ী মূল্য নিশ্চিত হলে ভোক্তারা উপকৃত হতে পারেন। এ জন্য এলপিজি উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থাপনায় নজরদারি বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে সরকারকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে আরও গতিশীলতা আনয়ন ও এ ক্ষেত্র থেকে কী করে দুর্নীতি পর্যায়ক্রমে কমানো যায়, তার দিকনির্দেশনা দিতে হবে।
তবে, এবারও বাজেটে কাঠামোগত সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেই। স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে আর্থিক বিকেন্দ্রীকরণের কোনো আভাসও নেই এখানে। ফলে স্থানীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতায়ন উপেক্ষিতই থাকছে।
বাজেটে জনপ্রত্যাশা একেবারেই সীমিত থাকে। যারা দিন আনে দিন খায়, তারা বাজেটের ভেতর যেতে চায় না। সাধারণ মানুষ চায়, তাদের উপার্জনের সক্ষমতার ওপর সরকার আস্থা রাখুক। তাহলে তারা নিজেরাই নিজেদের চালিয়ে নিতে পারবে। তাদের বড় প্রত্যাশা, দ্রব্যমূল্য যাতে সহনীয় পর্যায়ে থাকে। এবারের বাজেট বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় সাম্য নিশ্চিত হলে দ্রব্যমূল্য আকাশছোঁয়ার কথা নয়।
বাজেট পুরোপুরি বাস্তবায়ন চিরাচরিত কারণ ছাড়াও আরও কতিপয় বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। ইউরোপের অর্থনৈতিক মন্দার অভিঘাত কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে, জ্বালানি তেলের মূল্য আরও বাড়বে কি-না, বৈদেশিক প্রত্যাশিত ঋণ সহায়তা ও বিনিয়োগ মিলবে কি-না, আমাদের রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স খাতে প্রত্যাশিত অর্জর্ন সম্ভব হবে কি-না এবং দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে কি-না_ এসবের ওপরও নির্ভর করবে বাজেট প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ হবে।
তবে বিরোধী দলের বাজেট বিতর্কে অংশ নেওয়ার জন্য সংসদে যাওয়া খুবই প্রয়োজন। জনগণের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত অর্থনৈতিক প্রস্তাবগুলোতে তারা প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে জনস্বার্থ সমুন্নত রাখতে পারেন।
 

No comments

Powered by Blogger.