বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৪২১ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মতিউর রহমান, বীর বিক্রম পরাক্রমী যোদ্ধা অন্ধকার রাত। অন্যদিকে ঝড়বৃষ্টি। তার মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধারা বেরিয়ে পড়লেন। তাঁদের নেতৃত্বে মতিউর রহমান। পথে তিস্তা নদী। নদীতে বেশ স্রোত। নৌকায় সবাই নদী পার হলেন।


এরপর হেঁটে দ্রুত পৌঁছালেন লক্ষ্যস্থল শঠিবাড়িতে। পরের ঘটনা শোনা যাক মতিউর রহমানের বয়ান থেকে।
‘সেখানে একটা বিল্ডিং ছিল। এর সামনে প্রায় ৫০ গজ চওড়া ছোট একটি ক্যানেল। তখন প্রায় ভোর হয় হয়। আমি আমার কোম্পানিকে দুই ভাগে ভাগ করলাম। একটি দল ক্যানেল ক্রস করে রৌমারীর দিকে যে রাস্তা, সেই রাস্তায় অ্যামবুশ করল। প্ল্যান ছিল, আমি আক্রমণ চালালে পাকিস্তানি সেনারা যেন রৌমারীর দিকে পালিয়ে যেতে না পারে। অপরদিকে রৌমারী থেকেও যেন তারা না আসতে পারে।
‘আমি আমার মর্টার দিয়ে প্রথম ফায়ার ওপেন করলাম। পাকিস্তানি সেনারা কিছুটা বিচলিত। তবে পরক্ষণেই পাল্টা আক্রমণ চালায়। আমি এবং আমার সঙ্গের সবাই ক্যানেল পার হয়ে বিল্ডিংয়ের ওপর চড়াও হই। পাকিস্তানিরা তখন পালানোর চেষ্টা করে।
‘আক্রমণে ১৫ জন পাকিস্তানি নিহত হয়। ১৫ জনের সাতজন ছিল সেনাবাহিনীর। অপর আটজন ছিল ইপিকাপ। আহত হয় অনেক। এই সংঘর্ষ আগস্টের শেষের দিকে অথবা সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঘটে। ঠিক তারিখ মনে নেই।
‘ভারতীয়রা বলত, প্রমাণস্বরূপ যুদ্ধে নিহত পাকিস্তানি সেনাদের মাথা কেটে নিয়ে আসতে। আমরা ১৫ জনের মাথা কেটে এবং তাদের ইউনিফর্ম নিয়ে আমাদের গন্তব্যে রওনা হই। এই সংঘর্ষে আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং তিনজন গুরুতরভাবে আহত হন। এই আক্রমণের জন্যই পরবর্তী সময়ে আমাকে বীর বিক্রম উপাধি দেওয়া হয়।
‘পাকিস্তানিরা যখন অস্ত্র ফেলে পালাচ্ছিল, তখন মক্তিযোদ্ধারা পিছু ধাওয়া করে কয়েকজনকে হত্যা করে। তাঁদের সাহস দেখে আমি সেদিন বিস্মিত হয়েছিলাম। এই অপারেশনে আমার সাব-সেক্টরে ভীষণ মরাল ইফেক্ট হয়েছিল। যার ফলে আমার রেইডিং পার্টি পরবর্তী সময়ে সৈয়দপুর পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে রেইড করত। প্রতিটি রেইডই সাকসেসফুল হয়েছে।’
শঠিবাড়ি নীলফামারী জেলার অন্তর্গত। ১৯৭১ সালে সেখানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত এক প্রতিরক্ষা। মতিউর রহমান এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে সেখানে আক্রমণ করে বড় ধরনের সাফল্য পান।
মতিউর রহমান চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে (বর্তমান পাকিস্তান)। তখন তাঁর পদবি ছিল লেফটেন্যান্ট। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সেখান থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধে যোগ দেন। প্রথমে ৬ নম্বর সেক্টরের সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরে, পরে পাটগ্রাম সাব-সেক্টরে যুদ্ধ করেন। তিনি পাটগ্রাম সাব-সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন।
পাটগ্রাম সাব-সেক্টরের আওতাধীন এলাকা ছিল লালমনিরহাট জেলার বড়খাতা, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ ও পাটগ্রাম। এই সাব-সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধকালে অসংখ্য যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কয়েকটি যুদ্ধে মতিউর রহমান নিজে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন। এর মধ্যে তিস্তা রেলসেতুর যুদ্ধ, হাতীবান্ধা আক্রমণ, শঠিবাড়ির যুদ্ধ, কাকিনা আক্রমণ উল্লেখযোগ্য।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মতিউর রহমানকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৮।
মতিউর রহমান ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন। তখন তাঁর পদবি ছিল লেফটেন্যান্ট কর্নেল। ৩০ মে চট্টগ্রামে জিয়াউর রহমান হত্যা ঘটনায় ১ বা ২ জুন তিনি নিহত হন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি যশোর জেলায় (গ্রাম-শ্রীপুর, ডাক-সাদুগঞ্জ)। বর্তমান ঠিকানা: বাড়ি ৪, সড়ক ৪, ক্যান্ট মার্কেট এরিয়া, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। তাঁর বাবার নাম রোয়াজেশ আলী জোয়ারদার, মা হাজেরা খাতুন। স্ত্রী ফারহানা সুলতানা। তাঁদের এক মেয়ে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড এবং মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.