পারিবারিক সমর্থন ও এভারেস্ট জয় by শম্পা ইফতেখার

প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বেশ ঘটা করে দেখানো হচ্ছে নিশাত আর ওয়াসফিয়ার এভারেস্ট জয়ের কাহিনী। প্রচণ্ড সাহসী আর আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান দুই নারীকে অভিনন্দন। আজও যেখানে ঘর থেকে পা ফেলতেই হাজারো বিধিনিষেধ; প্রতিনিয়ত নানা শঙ্কায় সংকুচিত হয়ে থাকে বঙ্গীয় নারী; সেখানে তাদের এ বিজয় নির্দি্বধায় অনেক বড় মাইলফলক।


এটি নিঃসন্দেহে অনুপ্রাণিত করবে আমাদের ভবিষ্যৎ নারী প্রজন্মকে। তবে এ কথাও স্বীকার করতে হবে_ তাদের দু'জনের পরিবারই অনেক বেশি উদার এবং সহায়ক ছিল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। ধন্যবাদ এবং স্বাগত জানাই পরিবারের এ বন্ধন আর সমর্থনকে।
এরই মধ্যে চোখ চলে যায় নারীদের চিরায়ত বঞ্চনা, লাঞ্ছনা আর নির্বিচারে নিপীড়িত হওয়ার দুর্বিষহ অথচ সাধারণ হয়ে যাওয়া কিছু ঘটনার দিকে। যৌতুকের জন্য অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে গলাটিপে হত্যা, পুলিশ দ্বারা আদালত চত্বরে যৌন নিপীড়ন ও লাঠিপেটা_ সর্বোপরি উনিশ বছরের তরুণীর টুকরো টুকরো লাশ উদ্ধার_ শ্বাসরুদ্ধকর এসব ঘটনা। হয়তো সময়ের পরিক্রমায়, ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে এসব খবর অনেক বেশি সাধারণ। আমরা যেন ধরেই নিয়েছি, দু-চারজন নারী বা মেয়ের এমনই দুর্ভাগ্য হয়। মাঝেমধ্যে চোখেও পড়ে না_ আদতে কী হচ্ছে আমাদের সাধারণ ঘরের সাধারণ মেয়েদের?
আজকাল নারীর বঞ্চনার ছবি পত্রিকার প্রথম পাতায় স্থান হয় না। হাজারো খবর থাকে অপ্রকাশিত। এমপি হোস্টেলে লাশের পরিচয় মেলে না। জানা যায় না কী শাস্তি হয় একজন নারী নির্যাতকের? কী হয়েছিল প্রতারক সুমনের, যে বিভিন্ন কায়দায় বিভিন্ন নারীকে ভুলিয়ে সুবিধা আদায় করেছিল? কী-ইবা হবে সেই পুলিশের, যারা পুলিশ ক্লাবে নিপীড়ন করেছিল বিচারপ্রার্থী এক তরুণীকে? শুধু প্রত্যাহার, নাকি আরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি? সীমা বা ইয়াসমীনের যে দেশ-কাঁপানো ঘটনা; তার পরিপ্রেক্ষিতে কত রাজনৈতিক চড়াই-উৎরাই, অবশেষে শাস্তি বিধান_ সবকিছুই আজ অতীত। বঞ্চনা আর নিপীড়নে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। কিন্তু সচেতন সমাজের উপসংহার_ নির্লিপ্ততা। শহরকেন্দ্রিক চাকরিজীবী মানুষ এত ব্যস্ত, এতই ব্যস্ত যে, সময় কোথায় সম্মিলিতভাবে এসব অনাচারের বিরুদ্ধে কণ্ঠ তোলার! ঘুরেফিরে চিরচেনা কিছু মুখ, যাদের মধ্যে সুলতানা কামাল একজন, নিরন্তর কাজ করছেন নারীর স্বাধীনতার জন্য, সহিংসতা বন্ধের জন্য।
দুঃখজনকভাবে সত্যি_ আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় সর্বোচ্চ ক্ষমতাসীন ব্যক্তি একজন নারী; আগেও যিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বিরোধীদলীয় নেতাও নারী। তিনিও আগে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু তাদের সুদীর্ঘ শাসনামলে নারীর ক্ষমতায়ন হয়তো বেড়েছে, কিন্তু সহিংসতা কমছে না। ক্ষমতার সঙ্গে স্বাধীনতার সংযোগ হয়নি আমাদের সমাজে। তাই গৃহবন্দি নারী চাকরি করতে বাইরে যাচ্ছেন সত্যি; কিন্তু স্বাধীনভাবে চলাচল, মতপ্রকাশ, অর্থব্যয়_ কোনো কোনো ক্ষেত্রে পেশা পছন্দের ক্ষেত্রেও ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় মানতে হয় পরিবারের সিদ্ধান্ত। পরিবারই নির্যাতনের ভিত্তি। আবার সেই পরিবারই স্বাধীনভাবে বিকশিত হওয়ার কেন্দ্রস্থল। তাই পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জানা জরুরি, কেমন আচরণ সুস্থ বিকাশ নিশ্চিত করে। বউ পেটাতে শাশুড়ি যদি ছেলের হাতে লাঠি তুলে দেন_ এই অবক্ষয়, অনাচার রুখতে হবে শাশুড়িকে সংশোধন করে। প্রতিটি পরিবার সংশোধিত হলে সমাজ আরও উন্নত হতে বাধ্য। পরিবারই তো সমাজের ভিত্তি। সংশোধন তাই পরিবারের ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু হোক। অবশেষে আবারও ধন্যবাদ জানাচ্ছি নিশাত আর ওয়াসফিয়ার পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে।

শম্পা ইফতেখার : সিনিয়র লেকচারার, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি
rifta1979@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.