বাজেট বিশ্লেষণ-আমানত নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হবে ব্যাংকগুলোয় by রাজীব আহমেদ

ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়া কমাতে সঞ্চয়পত্রে সুদের হার বাড়ানোর পরামর্শ ছিল অনেকের। কিন্তু অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সে পথে হাঁটলেন না। কিছুটা ঘুরিয়ে কাজটি করলেন তিনি। মানুষকে সঞ্চয়পত্রমুখী করতে ব্যাংকে টাকা রাখা নিরুৎসাহ করার পথ ধরেছেন তিনি।


ব্যাংকের আমানতের সুদের ওপর উৎসে কর ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হলো। আর এটা করা হলো করের আওতার বাইরে থাকা সঞ্চয়নির্ভর মানুষের জন্য।
বিশ্লেষকদের মতে, ব্যাংকে রাখা আমানতের ওপর উৎসে করের হার বাড়ানোর পরস্পর সংযুক্ত প্রভাব (চেইন ইফেক্ট) পড়বে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও অর্থনীতিতে। কর বেড়ে যাওয়ায় মানুষ ব্যাংকবিমুখ হবে। এতে ব্যাংকের তারল্য সংকট আরো বাড়বে। পাশাপাশি সম্প্রতি অনুমোদন দেওয়া ৯টি ব্যাংক কার্যক্রম শুরু করলে আমানত নিয়ে কাড়াকাড়িও শুরু হতে পারে। এর ফলে প্রতিযোগিতা বেড়ে গিয়ে ব্যাংকের আমানতের সুদের হার আরো বাড়ানোর প্রয়োজন হতে পারে। সব মিলিয়ে বেড়ে যাবে ঋণের সুদের হার।
ব্যাংকের তারল্য সংকটে আরো নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা সরকারের ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনার কারণে। আগামী অর্থবছর সরকার ২৩ হাজার কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ নেবে। এতে ব্যাংকের তারল্য সংকট আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। আর বিনিয়োগের জন্য ঋণও ব্যয়বহুল হবে বলে মনে করেন তাঁরা।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকও নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়ায় তারল্য সংকট বাড়বে বলে সরকারকে সতর্ক করে দিয়েছে।
আগামী জুলাইয়ে শেষ হতে যাওয়া অর্থবছরে ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ বেড়েছে। কিন্তু এর চেয়েও বেশি হারে বেড়েছে ঋণ। সরকারি ব্যাংকগুলো অন্য ব্যাংকগুলোকে ধার দিত (কলমানি বাজারের ঋণ)। এখন সেই সরকারি ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট তীব্র। আর সাম্প্রতিক আমানত বাড়ার কারণ সুদের হার অনেকখানি বেড়ে যাওয়া। বর্তমানে টাকা নিয়ে গেলে ব্যাংকগুলো ১০ শতাংশের বেশি সুদ দিচ্ছে। বড় অঙ্কের টাকা দীর্ঘ মেয়াদে রাখতে গেলে সুদ আরো বেশি মিলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত মার্চ মাসে ব্যাংকগুলোতে মোট আমানত (ডিমান্ড ও টাইম ডিপোজিট) ছিল চার লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকার মতো, যা আগের বছরের মার্চ মাসের তুলনায় ১৮.৪১ শতাংশ বেশি। বাড়ার হার অনেক বেশি হলেও ঋণ বিতরণ বেড়ে যাওয়ায় সংকট থেকেই যাচ্ছে। আগের বছরের মার্চের তুলনায় ঋণ বিতরণ বেড়েছে ২০.২৩ শতাংশ।
তারল্য সংকটের কারণে কলমানি (ব্যাংক থেকে ব্যাংকের ঋণ) বাজারে সুদের হার বাড়ছে। ২০১১ ও ২০১২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তা গড়ে দুই অঙ্কে ছিল। কিন্তু ২০১০ সালে ছিল ৫ শতাংশের নিচে। বর্তমানে আমানতের সুদের হারও বেশি। গত বছর ব্যাংকগুলোর আমানতের ওপর দেওয়া সুদের হার ৮ শতাংশের নিচে ছিল। এখন সেটা ৮ শতাংশের ওপরে। বাস্তব অবস্থা হলো, ব্যাংকগুলো ১২-১৩ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে। আর ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ১৬ শতাংশ পর্যন্ত সুদ আদায় করছে।
কর শনাক্তকরণ নম্বরহীন (টিআইএন) আমানতকারীদের ওপর উৎসে আয়কর ১০ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন না বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'অর্থমন্ত্রী এটা কেন যে করলেন, তা বুঝতে পারছি না। নিম্ন আয়ের মানুষ ব্যাংকে টাকা রেখে কিছুটা সুদ পেত। এর ওপর কর বাড়ানোর কোনো যুক্তি নেই। এর ফলে মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখতে চাইবে না।'
নতুন ব্যাংক, মানুষের ব্যাংকবিমুখতা এবং সরকারের বিপুল অঙ্কের ঋণ- এই তিন কারণে ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর চাপ বাড়বে বলে মনে করেন সাবেক গভর্নর। তিনি বলেন, 'টাকা আয়ের সহজ উপায় হিসেবে উৎসে কর বাড়ানোকে বেছে নেওয়া হয়েছে। এর কারণে তারল্য সংকট যেমন বাড়তে পারে, তেমনি সরকারের ব্যাংক ঋণও তারল্য সংকট বাড়ায়। সরকারের ব্যাংক ঋণ ২৩ হাজার কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে।' এসবের চূড়ান্ত প্রভাব মানুষের জীবনযাত্রার ওপরে পড়বে বলে মনে করেন তিনি। তাঁর মতে, সার্বিক প্রভাবে তারল্য সংকট বাড়লে ব্যাংকের নতুন ক্ষমতা কমে যাবে। এর প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থানে। সরকারের ঋণ ও সুদের হারের ঊর্ধ্বগতির কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে মানুষের সঞ্চয়ের ক্ষমতাও কমে। এটার প্রভাব আবার ব্যাংকিং খাতে পড়বে।
ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ মনে করেন, সরকার যেখানে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির কথা বলছে, সেখানে উৎসে কর বাড়িয়ে মানুষকে ব্যাংকবিমুখ করা স্ববিরোধিতা। তিনি বলেন, সঞ্চয়পত্রে উৎসে কর আরোপের ফলে মানুষ সেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে শেয়ারবাজারে যায়। একসময় শেয়ারবাজারে ধস নামে। পরে উৎসে কর কমিয়েও বিনিয়োগ বাড়ানো যায়নি। সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকারের আমানতের সুদে উৎসে কর প্রত্যাহার করা উচিত।
চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করতে পেরেছে মাত্র ৩৮০ কোটি টাকার। আগের বছর একই সময়ে যা ছিল দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ বাজেট নিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, এখনো ব্যাংক ঋণের সুদের হার ১৬ শতাংশের বেশি নেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় সরকারের ব্যাংক ঋণ আরো বাড়লে ব্যবসায়ীরা রক্ষা পাবেন না। এ জন্য অন্যান্য খাতে সরকারের ব্যয় কমিয়ে ঋণ কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও কৃষি ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান ড. খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদও মনে করেন ত্রিমুখী প্রভাবে তারল্য সংকট আরো বাড়তে পারে। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, '১০০ টাকা আয়ের ওপর ১৫ টাকা উৎসে কর- এটা একটু বড় অঙ্ক। এর ফলে মানুষের ব্যাংকমুখী হওয়ার ওপর প্রভাব পড়তে পারে। আর যাঁরা অবস্থাপন্ন, তাঁরা টিআইএনধারী। তাঁদের ১০ শতাংশ রেখে বাকিদের, যাঁরা কর দেওয়ার যোগ্য নন, তাঁদের ওপর ১৫ শতাংশ আরোপ অনৈতিক।' তিনি বলেন, বর্তমান সরকার নিজেকে দরিদ্রবান্ধব বলে দাবি করে। তাহলে গরিব শ্রেণীর ওপর কেন কর আরোপ করা হলো?

No comments

Powered by Blogger.