লক্ষ্য ভোল্টের বিদ্যুৎ

উসাইন বোল্টের দিকে তাকিয়ে লন্ডন অলিম্পিক। বোল্টও তাকিয়ে লন্ডনের দিকে। লিখেছেন ইফতেখার আহমেদ
ছিটকে বেরুলেন ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মতো! ১০০ মিটার স্প্রিন্টের অ্যাথলেটদের নিয়ে বলা হতো এমনটাই। এ জন্যই কিনা, স্প্রিন্ট শেষে ধনুকের ভঙ্গিটা ‘ট্রেডমার্ক’ হয়ে গেছে উসাইন বোল্টের।


ভঙ্গিটা পছন্দ হলেও ধনুক উপমাটা মান্ধাতার আমলের বানিয়ে ‘বজ্রবিদ্যুৎ’ হয়ে গেছেন ১০০ ও ২০০ মিটারের বিশ্ব রেকর্ডের মালিক। বিদ্যুতের গতিতেই ছড়িয়ে পড়েছে যশ, সুনাম, খ্যাতি আর প্রতিপত্তি। এ জন্যই বোল্ট এখন টাইগার উডস আর ডেভিড বেকহামের পর গুগল সার্চে ক্রীড়াঙ্গনের তারকাদের মধ্যে তৃতীয় পছন্দের নাম।
তিন থেকে এক-এ আসার উপলক্ষটা সামনেই। বেইজিংয়ের পর লন্ডন অলিম্পিকটা মাতাতে পারলে হয়তো সর্বকালের সেরা স্প্রিন্টারের স্বীকৃতিটা পেয়েই যাবেন এই জ্যামাইকান। অনেকে এখনই সর্বকালের সেরা বলেন তাঁকে। কিন্তু ২৫ বছর বয়সী এই তারকা কিংবদন্তি হতে অতিক্রম করতে চান আরেকটা ধাপ, ‘কিংবদন্তি হতে হলে ধরে রাখতে হবে বেইজিংয়ের তিনটি সোনা।’ সম্ভব সেটা? কেন নয়। বেইজিং অলিম্পিকের সেই ছবিটা মনে আছে। কালো পাথুরে ঘাম গড়িয়ে নামতে থাকা মানুষটার হাতে ঝকঝকে দুটো জুতো। তাতে চুম্বন এঁকে যাচ্ছেন ক্রমাগত। আর চোখে পড়ছে জুতো প্রস্তুতকারী পিউমার সেই সংলাপ, ‘ইউ ক্যান ওনলি গেট দিস ফার বাই বিলিভিং ইউ ক্যান গেট ফারদার।’
নিজের ওপর বিশ্বাস রেখেছিলেন বোল্ট। তাই তো বেইজিংয়ে ১০০ ও ২০০ মিটারের পর বিশ্ব রেকর্ড গড়েছিলেন ৪–১০০ মিটার রিলেতেও। ১৯৮৪ লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকে কার্ল লুইসের পর এক আসরে এই তিনটি ইভেন্টে একজনের সোনা জয়ের কৃতিত্ব এটাই প্রথম। তবে বোল্টের মতো তিনটিতেই বিশ্ব রেকর্ড গড়ে সোনা জিততে পারেননি লুইস। বার্ডস নেস্ট তাই পেয়ে গিয়েছিল তার ডানা মেলা পাখি। ওয়াটার কিউবে জলোচ্ছ্বাস তুলে ফেল্প্স ৮টি সোনা জিতেছিলেন ঠিকই। তবে ফেল্প্স নয়, অনেকেই বেইজিংয়ের সেরা অ্যাথলেটের মর্যাদা দেন বোল্টকেই।
বেইজিংয়ে তিনটি রেকর্ড গড়ার পরই বুক চাপড়ে যে হুংকার দিয়েছিলেন বোল্ট, এক বছর পর বার্লিনে সেটা পৃথিবীর গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল মহাকাশে। ৬ ফুট ৫ ইঞ্চির শরীরটা চকিত বিদ্যুতের ঝলসানি তুলে ১০০-এর পর ২০০ মিটারেও বিশ্ব রেকর্ড গড়েছিল বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে। আগের রেকর্ড ভেঙে ১০০ মিটারের টাইমিংটা ছিল ৯.৫৮ আর ২০০ মিটারে ১৯.১৯ সেকেন্ড!
সৌন্দর্য আর ক্ষিপ্রতার মিশেলে বোল্টের দৌড় মানেই অন্যদের পেছনে পড়ে থাকা—ধারণাটা বদলে যায় ২০১১ দেগুর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে। ফলস স্টার্ট করে হারান ১০০ মিটারের সোনা। বোল্টের জন্য যা ছেলেখেলা সেই ৯.৯২ সেকেন্ড টাইমিং করে সোনা জেতেন তাঁরই অনুশীলন-সঙ্গী ইয়োহান ব্লেক। বোল্টের ছায়ায় থাকা সেই ব্লেক ১০০ মিটারের পাশাপাশি ২০০ মিটারেও উন্নতি করেছেন চোখে পড়ার মতো। ২০০ মিটারে ব্লেকের ১৯.২৬ সেকেন্ড টাইমিংটা এই ইভেন্টেরই দ্বিতীয় দ্রুততম। তাই লন্ডনে স্প্রিন্টের সবটুকু আলো এখন একই কোচের দুই ছাত্র বোল্ট ও ব্লেকের ওপর।
তবে নানা বিচারে ব্লেকের চেয়ে অনেকে এগিয়ে রাখছেন বোল্টকেই। কেননা ১০০ মিটারে ব্লেকের সেরা টাইমিং ৯.৮২। জ্যামাইকার একটি প্রতিযোগিতায় এ বছরই ৯.৮২ সেকেন্ড সময় নিয়ে সোনা জিতেছেন বোল্ট। অস্ত্রাভায় অপ্রত্যাশিতভাবে ১০.০৪ সেকেন্ড সময় নেওয়ায় টাইম মেশিনে করে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিন বছর আগে! কেননা গত তিন বছরে এত খারাপ টাইমিং আর ছিল না বোল্টের। তবে রোমে ৯.৭৬ সেকেন্ডে ১০০ মিটার শেষ করে উড়িয়ে দিয়েছেন হঠাৎ করে জমা হওয়া কালো মেঘটা। এটা এ বছরের তো বটেই, রোমেরই সেরা টাইমিং। এভাবে বজ্রবিদ্যুতে রোম ঝলসে দেওয়াটাই বলছে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে খুব বেশি উঁচুতে না হওয়ায় লন্ডনে আরও বেশি স্বাচ্ছন্দ্য থাকবেন বোল্ট। যে কারণে একজন গবেষক তো হিসাব কষেই দেখিয়েছেন বোল্টের পক্ষে লন্ডনে ৯.৫০ সেকেন্ডের নিচে স্প্রিন্ট শেষ করা সম্ভব!
লন্ডন অলিম্পিককে ঘিরে মনোযোগ যাতে ট্র্যাকেই থাকে, সে জন্য ব্যক্তিগত জীবনের ‘উটকো’ ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকতে চাইছেন বোল্ট। এরই মধ্যে ইতি টেনেছেন স্লোভাকিয়ান ফ্যাশন ডিজাইনার লুবিচা স্লোভাকের সঙ্গে সম্পর্কের। কেননা বোল্ট-লুবিচার প্রেম নিয়ে সাদা-কালো দ্বন্দ্বই শুরু হয়ে গিয়েছিল জ্যামাইকায়। ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইটে দুজনের সম্পর্কটা মেনে নিতে না পেরে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছিলেন সমর্থকেরা। মাথাব্যথার ওষুধ হিসেবে বোল্ট কেটে ফেলেছেন মাথাটাই!
করপোরেট দুনিয়াও ঘুরিয়ে দিতে পারে মাথাটা। ট্র্যাকে যেমন তাঁর দাপট, তেমনি সিংহাসন দখল করেছেন করপোরেট-জগতেও। প্রথম অ্যাথলেট হিসেবে বোল্ট কেবল স্পনসরশিপ থেকেই বছরে আয় করেন এক কোটি পাউন্ডের বেশি। তাঁর সঙ্গে বার্ষিক ২ কোটি ৫০ লাখ পাউন্ডে পাঁচ বছরের চুক্তি রয়েছে পুমার। স্পোর্টস ড্রিংকস গাতোরাদের সঙ্গে চুক্তিটা বার্ষিক ২০-৩০ লাখ পাউন্ডের মতো, ব্রডব্যান্ড ভার্জিন মিডিয়ার সঙ্গে ২০ লাখ, ক্রেডিট কার্ড ভিসার সঙ্গে ১০ লাখ আর ঘড়ি কোম্পানি হুবলোটও প্রতিবছর ১০ লাখ পাউন্ডের বেশি দেয় বোল্টকে। এ ছাড়া মোটা অঙ্কের চুক্তি রয়েছে জার্মান ট্র্যাক কোম্পানি রেগুপল, মোবাইল ফোন ডিজিসেল আর হেডফোন সোলের সঙ্গেও। এর পরও পা মাটিতে রাখতে পারাটা বড় কৃতিত্ব বোল্টের জন্য।
১৫ বছর বয়সে কোচের পরামর্শে ওয়াকার ইউনুসের এই ভক্ত ক্রিকেট ছেড়ে ট্র্যাকে না নামলে রেকর্ডের মালা গাঁথা হতো না। লন্ডন অলিম্পিকের আগে আকাশ থেকে মহাকাশ ফুঁড়ে বের হতে পারবেন কি না, তা নিয়েও হতো না কল্পনার জাল বোনা। দেখা যাক লন্ডন অলিম্পিক কোথায় পৌঁছে দেয় বোল্টকে?

No comments

Powered by Blogger.