শ্রদ্ধাঞ্জলি-সেবা দিবস ও ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম by অরূপ রতন চৌধুরী

ইতিহাসের পাতায় যেসব বিরল ব্যক্তিত্ব তাঁদের কর্মপ্রচেষ্টায় বাংলাদেশের জনগণের মাঝে অমর হয়ে আছেন, ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম তাঁদের অন্যতম। ৬ সেপ্টেম্বর ডায়াবেটিস সেবা দিবস এবং বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিমের ২১তম মৃত্যুদিবস।


ডায়াবেটিক সমিতির সিদ্ধান্তে প্রতিবছর তাঁর মৃত্যুদিবসকে সেবা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
১৯৫৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সেগুনবাগিচায় একটি টিনশেড ঘরে কয়েকজনকে সঙ্গে করে অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। তখনো কেউ ভাবতে পারেনি এই সমিতির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বারডেম একটি বিশাল হাসপাতাল ও গবেষণাকেন্দ্রে পরিণত হবে। বারডেম হাসপাতালে ডায়াবেটিসের রোগীর বিভিন্ন জটিল চিকিৎসার পাশাপাশি নন-ডায়াবেটিস রোগীদের চিকিৎসাসেবাও প্রদান করা হচ্ছে। আজ এই বারডেম জায়গা করে নিয়েছে ঢাকার কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ এলাকার বিশাল অট্টালিকায়, যেখানে প্রতিদিন প্রায় তিন হাজারের বেশি রোগীর বিস্তারিত তথ্য নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। বারডেম হাসপাতাল আজ আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত ও স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানই শুধু নয়, ডায়াবেটিস চিকিৎসার ক্ষেত্রে সারা বিশ্বে এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত বা মডেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। বর্তমানে বারডেম হাসপাতালে নিবন্ধনকৃত রোগীর সংখ্যা প্রায় তিন লাখ ৩৫ হাজার, যার বিস্তারিত তথ্য ও চিকিৎসা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ১৯৮২ সাল থেকে বারডেম হাসপাতাল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবেও কাজ করে যাচ্ছে।
চিকিৎসক মোহাম্মদ ইব্রাহিমের ব্যক্তিগত জীবন ছিল সাধারণ একজন মানুষের মতো। তাঁর ছিল না অহংকারী মনোভব, ছিল না প্রতিপত্তির আভিজাত্য। তাঁর বেশি আগ্রহ ছিল বিশ্বের নতুন গবেষণালব্ধ তথ্য সংগ্রহ করা। চিকিৎসক মোহাম্মদ ইব্রাহিম সব সময় রোগীদের বলতেন, ডায়াবেটিস একটি জীবনব্যাপী রোগ। কিন্তু একে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি হলো খাদ্যনিয়ন্ত্রণ, ব্যায়াম আর ওষুধ। মোহাম্মদ ইব্রাহিম এই চাবিকাঠি সব ডায়াবেটিসের রোগীর মধ্যে প্রচার করে গেছেন, তাদের সেবা প্রদান করার জন্য তৈরি করে গেছেন বারডেম।
বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রায় ১৩ কোটি ডায়াবেটিসের রোগী আছে এবং আগামী ২০২৫ সালে তা হবে প্রায় ৩০ কোটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বে ডায়াবেটিসের রোগীর সংখ্যার দিক থেকে দশম স্থান থেকে সপ্তম স্থানে উন্নীত হয়েছে অর্থাৎ ডায়াবেটিসের রোগীর সংখ্যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও অধিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের দেশে ইনসুলিন-নির্ভরশীল নয় এ রকম ডায়াবেটিসের রোগীর সংখ্যা প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর মধ্যে, এমনকি উন্নত বিশ্বেও ২০ শতাংশ ডায়াবেটিসের রোগী অচিহ্নিত আছে এবং আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে অচিহ্নিত ডায়াবেটিসের রোগীর সংখ্যা ৫০ শতাংশের বেশি।
অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম সব সময় বলতেন, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হচ্ছে ‘ডায়াবেটিস সম্পর্কে শিক্ষা’। একজন ডায়াবেটিস রোগীকে তার দেহের বিপাকীয় অবস্থা সম্পর্কে সঠিকভাবে জানতে হবে। চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং তথ্যবিদ একজন রোগীকে কেবল তার লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে সাহায্য করেন। কিন্তু একজন ডায়াবেটিসের রোগী তার রোগ সম্পর্কে না জানলে, না বুঝলে, নিয়ম না মানলে কখনোই এই রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকে না, থাকতে পারে না। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ১৯৮৬ সালে জাতীয় অধ্যাপক ডা. মো. ইব্রাহিমের মতো মহান ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে আসার। তখন আমি আইপিজিএমঅ্যান্ডআরে ডেন্টিস্ট্রি বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। তাঁর দাঁতের চিকিৎসার সুবাদে তাঁর সঙ্গে পরিচয়। পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতা। সেই বছরই তিনি আমাকে বারডেমে নিয়ে এলেন এবং বললেন, ‘তুমি এখন থেকে বারডেমে কাজ করবে।’ সব সরকারি আদেশও তিনি করিয়ে নিলেন আমার জন্য। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ডায়াবেটিস রোগীদের মুখ ও দাঁতের স্বাস্থ্য রক্ষায় বারডেমে ডেন্টিস্ট্রি বিভাগ চালু করা। এখনো ভাবতে অবাক লাগে, আজ থেকে ২০ বছর আগে তিনি কীভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে ডায়াবেটিস রোগীদের মুখের প্রদাহ বা অসুখ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। সাম্প্রতিক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণায় এখন বলা হচ্ছে, মাঢ়ির রোগ বা পেরিওডেন্টাল ডিজিজ অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ষষ্ঠ বা ৬ নম্বর জটিলতা (অন্যান্য জটিলতা হূদরোগ, কিডনি রোগ, চক্ষুরোগ, স্নায়ুরোগ ও পায়ের পচনশীল রোগ)। এত দিন অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে সাধারণত পাঁচটি জটিলতার কথা বলা হতো। তাঁর এই দূরদৃষ্টি ছিল বলেই তিনি দিকনির্দেশক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাত ছিলেন। তাঁর মধ্যে আরও ছিল মানবিক মূল্যবোধের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। ডা. ইব্রাহিম স্যারের অনুপ্রেরণায় ১৯৮৭ সালে বারডেমে ডেন্টাল বিভাগ শুরু করার পর আমি ডায়াবেটিস ও মুখের রোগসংক্রান্ত গবেষণাকাজ নিয়ে ইতিমধ্যে প্রায় ১৭টি দেশে ডেন্টাল ও ডায়াবেটিস-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ২৮টি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছি। সেই সঙ্গে আমি ডায়াবেটিস ও মুখের রোগসংক্রান্ত গবেষণাকাজ ১৯৮৭ সাল থেকেই শুরু করি। এখন মনে হয়, আমি এই ডায়াবেটিক পরিবারের একজন সদস্য, যেমন থাকে একটি পরিবারের বিভিন্ন সদস্য।
অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম এই ডায়াবেটিক সমিতি ও হাসপাতালকে মনে করতেন একটি পরিবার। এখানে সবার সঙ্গে সম্প্রীতি রেখেই তিনি কাজ করতেন। সেই সঙ্গে তাঁর মধ্যে ছিল Empathy বা সহমর্মিতা, রোগীর দুঃখ-কষ্টকে নিজের মনে করে সেবা দিতেন। এই আদর্শ সামনে রেখেই আমি কাজ করে যাচ্ছি এবং আমার এই ডায়াবেটিক সেবায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার পেছনে সব কৃতিত্বই মোহাম্মদ ইব্রাহিম স্যারের। কারণ, তিনি তাঁর আদর্শ আমাদের সামনে কাজের মাধ্যমে শিখিয়ে দিয়ে গেছেন, যা অনুসরণ করে আজও রোগীদের সেবা দিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছি।
১৯৮৭ সালের প্রথম দিকে একদম ভোরবেলা তিনি যখন ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন ওয়ার্ড ও কেবিনে রোগী দেখতে আসতেন, তখন আমি মাঝেমধ্যে তাঁর সঙ্গে থাকতাম। দেখতাম, তিনি কীভাবে রোগীদের সঙ্গে কথা বলেন, কত আদর, সোহাগ আর ভালোবাসা দিয়ে তাদের কষ্টের সঙ্গে একাত্ম হতেন, বোঝাতেন ডায়াবেটিস রোগ কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সেই সঙ্গে তিনি খবর নিতেন এই হাসপাতালে চিকিৎসক এবং নার্স বা স্বাস্থ্যকর্মীরা ঠিকমতো তাঁদের দেখাশোনা করছেন কি না, অন্য কোনো অসুবিধা আছে কি না। এসব বিস্তারিত শুনে রোগীর ফাইল পরীক্ষা করে ওষুধপত্র খাওয়ানো হচ্ছে কি না, এ ছাড়া রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট—সব দেখে সবকিছুর সমাধান করে দিয়ে তবেই নিশ্চিত হতেন। চলার পথে ফ্লোরে কোনো তুলা বা গজ পড়ে থাকতে দেখলে নিজ হাতে তুলে সেটা ডাস্টবিনে ফেলতেন। এমন আদর্শবান মহৎ লোকের সান্নিধ্যে আসা নিতান্তই ভাগ্যের ব্যাপার, তাই আমি একজন ভাগ্যবান ব্যক্তি।
বর্তমানে সারা বাংলাদেশে ডায়াবেটিক সমিতি অধিভুক্ত সমিতি ৫৩টি জেলায় মোট ৫৪টিতে বিস্তৃতি লাভ করেছে এবং প্রতিটি কেন্দ্রেই ডায়াবেটিসের রোগীদের সেবা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে। ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম আজ আমাদের মধ্যে নেই, কিন্তু তিনি অমর হয়ে আছেন তাঁর কর্ম ও কীর্তির মধ্য দিয়ে। তাঁর মানবসেবার আদর্শ যুগ যুগ ধরে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাবে অনাগত দিনের মানুষকে।

No comments

Powered by Blogger.