বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জাতিসংঘের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা by সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী

বাংলাদেশ মিশন ওয়াশিংটন থেকে আমি আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে জাতিসংঘের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছি। এত বড় গণহত্যা হলো, ৩০ লাখ লোক প্রাণ দিল, এক কোটি লোক ভারতে আশ্রয় নিল, কোটি কোটি লোক গৃহহারা হয়ে পালাল, লাখো নারী সম্ভ্রম হারাল, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন করল;


অথচ জাতিসংঘ তাদের প্রতিহত করার কোনো প্রচেষ্টাও নিল না। কেন এ নিষ্ক্রিয়তা? সোজা কথায় তার উত্তর জাতিসংঘের সদস্য, বিশেষ করে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যরা যেভাবে চাইবেন ঠিক সেভাবেই জাতিসংঘ কাজ করবে। আজকের বিশ্বায়নের যুগে গণহত্যা, মানবাধিকার অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়। সাম্প্রতিককালে পূর্ব তিমুর, কসোভো, বসনিয়া জাতিসংঘের সহায়তায় স্বাধীনতা অর্জন করেছে। কিন্তু চার দশক আগে আমাদের জনগণ যখন ভোটের মাধ্যমে তাদের সেই মৌলিক অধিকার স্থাপন করতে চাইল, তখন কেন তাদের এত বড় মূল্য দিতে হলো?
আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন পূর্ব-পশ্চিম ঠাণ্ডা লড়াই তুঙ্গে। আজকের 'গণতন্ত্রের হোতারা' তখন 'ঠাণ্ডা যুদ্ধের' বলয়ে আমাদের সংগ্রাম দেখেছে। পাঁচ স্থায়ী সদস্যদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নিঙ্ন প্রশাসন তখন মস্কোকে কোণঠাসা করতে পাকিস্তান মারফত চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে ব্যস্ত। তাই পাকিস্তানকে পূর্ণ সমর্থন দিল। চীন তার পরম বন্ধু পাকিস্তানের পক্ষে 'জান কোরবান' করতে প্রস্তুত। ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের আমাদের প্রতি সমবেদনা ছিল কিন্তু ওয়াশিংটনের সরাসরি বিরোধিতা করার সাহস ছিল না। কাজেই তারা নিষ্ক্রিয়ভাবে বসে রইল। আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের যুদ্ধে সমর্থন দিল, সাহায্য করল তদানীন্তন কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন। যা হোক, এই পাঁচ স্থায়ী সদস্যের বিভক্তির কারণে নিরাপত্তা পরিষদ সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে পড়ল। ৯ মাসের মধ্যে একবার আমাদের বিষয়টি বিবেচনা করারও উদ্যোগ নিল না।
বলতে দ্বিধা নেই, এ বিভক্তি কিন্তু সাধারণ পরিষদের সদস্যদের মধ্যেও ছিল। বেশির ভাগ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো যখন সদ্য স্বাধীনতা অর্জন করেছে, তারা তখন তাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রাখতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিল। আমাদের সমর্থন দিলে যদি তাদের দেশেও বিচ্ছিন্নতাবাদীরা প্রশ্রয় পায় সেই ভয়ে তারা কম্পিত। বিচ্ছিন্নতা ও বিদেশি হস্তক্ষেপ তারা প্রত্যাখ্যান করছিল। কেউ কেউ আবার 'বায়েফ্রা' যুদ্ধের সঙ্গে আমাদের তুলনা করছিল। সোজা কথায়, তারা এগিয়ে আসেনি। জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষার্থে নিরাপত্তা ও সাধারণ পরিষদ বিবেচনা করতে পারত। কিন্তু পাকিস্তানের দোসররা 'অভ্যন্তরীণ' বিষয়ে হস্তক্ষেপের জিকির তুলে জাতিসংঘকে নিষ্ক্রিয় করে রাখল। কিন্তু মানবাধিকার লঙ্ঘন বিবেচনার জন্য যে পদ্ধতি ও প্রতিষ্ঠানগুলো গড়া হয়েছিল তা সম্পূর্ণ অবহেলিত ও অব্যবহৃত রয়ে গেল। জাতিসংঘের মহাসচিব ছিলেন মিয়ানমারের নাগরিক উথান্ট। পূর্বসূরি ডাগ হ্যামারশোল্ডের মতো স্থায়ী সদস্যদের ওপর তার সেই প্রভাব ছিল না। কিন্তু স্বল্প ক্ষমতার মধ্যে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দিলেন ৩০ মার্চ ১৯৭১। পাকিস্তান তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অজুহাত দেখিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করল। তিনি সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান বরাবর প্রস্তাব পাঠালেন। তারা কোনো উত্তরই দিল না।
মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও ইসলামিক সম্মেলন সংস্থার তদানীন্তন মহাসচিব টুংকুু আবদুর রহমানকে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ও আমাদের নেতৃবর্গের মধ্যে দূতিয়ালি করার অনুরোধ জানালেন, যাতে একটা রাজনৈতিক সমাধান করা যায়। কিন্তু তা ফলপ্রসূ হলো না পাকিস্তানিদের একগুঁয়েমির কারণে। শরণার্থীদের সাহায্যকল্পে উথান্ট সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় একটা 'রিলিফ তহবিল' গঠন করলেন ১৯ মে ১৯৭১। তদানীন্তন জাতিসংঘের টঘঐঈজ-এর প্রধান সদরুদ্দীন আগা খানকে সরেজমিন তদন্তের জন্য ভারত-পাকিস্তানে পাঠালেন ১২ জুন ১৯৭১। আগা খান সফর শেষে স্বীকার করলেন, রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া শরণার্থীরা স্বদেশে ফিরতে আস্থা পাবেন না।
কিছুটা পাকিস্তান ও তার দোসরদের প্ররোচনায় ভারত ও পাকিস্তানে টঘঐঈজ-এর পর্যবেক্ষক স্থাপনের প্রস্তাব করলেন। কিন্তু তা অত্যন্ত অবাস্তব ও অপ্রাসঙ্গিক ছিল। শরণার্থীরা তখন আরো অধিক সংখ্যায় ভারতে আশ্রয় নিচ্ছিল, তাদের ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। যা হোক, বিফল উথান্ট স্বীকার করলেন, রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের বিষয় আলাদাভাবে বিবেচনা করা যাবে না। কিন্তু সেই রাজনৈতিক সমাধানের জন্য জাতিসংঘ কোনো উদ্যোগ নিল না। পাকিস্তানি শাসকরা যখন বঙ্গবন্ধুর বিচার শুরু করার ঘোষণা দিল ১৯ জুলাই ১৯৭১, তখন উথান্ট বেশ শক্ত ভাষায় তাদের হুঁশিয়ার করে এক বার্তা পাঠালেন। বললেন, এই বিচার একটা ব্যতিক্রমী স্পর্শকাতর বিষয়, যার প্রভাব সারা অঞ্চলে পড়বে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অন্য রাষ্ট্রপ্রধানদের অনুরোধে তারা বিচার স্থগিত করতে বাধ্য হলো।
বাংলাদেশ সরকার বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটা দল পাঠালেন জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে। বাংলাদেশ সদস্য না হওয়ায় তাদের সরকারিভাবে কোনো আলোচনায় অংশ নিতে দেওয়া হলো না। তবে তারা অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিদলগুলোর সঙ্গে দেখা করে আমাদের বক্তব্য জানালেন। কিন্তু সাধারণ পরিষদ আমাদের বিষয়টা তাদের কার্যসূচির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করল না। ২০ অক্টোবর ১৯৭১ মহাসচিব উথান্ট আবার মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব পাঠালেন। তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলো ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১। তার পরের দিনই নিরাপত্তা পরিষদের সভা ডাকা হলে বাংলাদেশের প্রতিনিধি আবু সাঈদ চৌধুরী লিখিতভাবে আমাদের বক্তব্য পেশ করতে অনুমতি চাইলেন। ভারত ও রুশ সমর্থন দিল, কিন্তু অন্যান্য সদস্য দেশের আপত্তির কারণে তাঁর আবেদন স্থগিত করা হলো। যা হোক, পাকিস্তান ও ভারতের প্রতিনিধিদের বক্তৃতার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি ভাষণ দিলেন এবং তাঁদের খসড়া প্রস্তাব পেশ করলেন। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও আন্তর্জাতিক সীমানায় নিজ নিজ সৈন্য প্রত্যাহারের কথা বলা হলো কিন্তু আমাদের সংগ্রামের শান্তিপূর্ণ সমাধানের ব্যাপারে অর্থাৎ আসল বিষয়ে কিছুই বলা হলো না। সোভিয়েত স্থায়ী প্রতিনিধি ইয়াকুব মালিক মূল ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়ার কারণ দেখিয়ে ভেটো দিলেন। তাঁরা তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী অনতিবিলম্বে আলোচনার মাধ্যমে মূল ব্যাপারটার সমাধানের ওপর গুরুত্ব দিয়ে প্রস্তাব দিলেন। চীন ভেটো প্রয়োগ করল।
আর্জেন্টিনা মার্কিন প্রস্তাবের আদলে দ্বিতীয় প্রস্তাব পেশ করল। আবার সোভিয়েত প্রতিনিধি ভেটো দিলেন। মোট কথা, ভেটো-পাল্টা ভেটোর কারণে কোনো প্রস্তাব পাস করা গেল না। ওয়াশিংটন-বেইজিং আশা করেছিল, যুদ্ধবিরতি দিয়ে পাকিস্তানিদের বাঁচানোর শেষ চেষ্টা চালাবে_তা ব্যর্থ হলো। যা হোক, আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হলো_ব্যাপারটা সাধারণ পরিষদের বিবেচনার জন্য পাঠানো হবে। ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাধারণ পরিষদ বসল_আমাদের প্রতিনিধিকে যোগদান করতে দেওয়া হলো না। ১০৪ পক্ষে, ১১ বিপক্ষে ও ১০ সদস্য বিরত ভোটে প্রস্তাব পাস হলো। আবার আমাদের মূল বিষয়টি পাস কাটিয়ে শুধু যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের কথা বলা হলো। সদ্য স্বাধীন অন্য দেশগুলো তাদের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য এবং নিজেদের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতিহত করতে আমাদের পক্ষে ভোট দিল না। ১২ ডিসেম্বর ১৯৭১ নিরাপত্তা পরিষদ আবার ডাকা হলো। কিন্তু তত দিনে যুদ্ধের ফল ঠিক হয়ে গেছে। পাকিস্তানিরা পালাচ্ছিল আর তাদের আত্মসমর্পণ শুধু সময়ের ব্যাপার ছিল। কাজেই এসব আলোচনা কোনো কাজে এল না। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারা আমাদের যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করল। বাংলাদেশ অবমুক্ত হলো। পাকিস্তান তার দোসরদের সমর্থন সত্ত্বেও দুই সপ্তাহ যুদ্ধ চালাতে পারল না।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সাহায্য ও পুনর্গঠনের জন্য জাতিসংঘের সর্ববৃহৎ প্রকল্প টঘজঙউ গ্রহণ করল। তাদের আবেদন অনুযায়ী সব দেশ সাহায্যের হাত বাড়াল। জাতিসংঘ ও তার বিভিন্ন সংস্থা আমাদের পুনর্গঠন কাজে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা রাখল। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য পদের জন্য আবেদন করল কিন্তু চীনের ভেটোর কারণে তা বিফল হলো। সিমলা চুক্তির পর চীন তাদের আপত্তি উঠিয়ে নিল, বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সদস্য হলো। বঙ্গবন্ধু ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ সাধারণ পরিষদে প্রথম বাংলা ভাষণ দিলেন। সেদিন ছিল আমাদের গর্বের ও অতি আনন্দের।

লেখক : সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও একজন মুক্তিযোদ্ধা কূটনীতিক

No comments

Powered by Blogger.