নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতাই প্রত্যাশিত-নতুন সেনাপ্রধান

নতুন সেনাপ্রধান নিয়োগ নিয়ে দুটি বিষয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। প্রথমত, ‘জনস্বার্থে’ বিদায়ী সেনাপ্রধানের চাকরির মেয়াদ ১০ দিন বাড়ানো এবং দ্বিতীয়ত, নতুন সেনাপ্রধান নিয়োগে জ্যেষ্ঠতার বিচ্যুতি। আওয়ামী লীগের বিগত নির্বাচনী ইশতেহারে বলা আছে, প্রতিরক্ষা বাহিনীর নিয়োগ, পদায়ন, পদোন্নতিতে যোগ্যতা,


মেধা, জ্যেষ্ঠতা কঠোরভাবে অনুসরণ ও অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনায় স্বশাসনের অধিকার নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু সাড়ে তিন বছরে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার প্রমাণ মেলেনি। এবার ১০ দিনের বিষয়টি সময় দিয়ে বিচার্য নয়, নীতি হিসেবে অযৌক্তিক। বিদায়ী সেনাপ্রধান যোগ্যতার সঙ্গেই তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর মেয়াদ বাড়ানোর এমন একটি অভাবনীয় সরকারি সিদ্ধান্ত তাঁর ভাবমূর্তির জন্য যেমন ভালো হয়নি, তেমনি সেনাবাহিনীতেও এটি একটি খারাপ নজির হিসেবে বিবেচিত হবে।
সেনাপ্রধানের পদের মেয়াদ ছিল তিন বছর। জিয়াউর রহমান রীতি ভেঙে চার বছর করেছিলেন, যা লে. জেনারেল নূরউদ্দীন পর্যন্ত বহাল ছিল। সেনাপ্রধান পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ কিংবা পদের মেয়াদ বৃদ্ধির সুযোগ কখনো আদর্শিক গণ্য করা হয় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগের সরকারের সময় একটি দৃশ্যমান চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ এবং এবারে কথিত একান্ত ব্যক্তিগত কারণে বিদায়ী সেনাপ্রধানের চাকরির মেয়াদ ১০ দিন বৃদ্ধি করায় দুটি নজিরবিহীন ঘটনার উদ্ভব ঘটেছে। উচ্চতর পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত আবেগ ও বিবেচনার ছায়াপাত ঘটলে তার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া প্রশাসনে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যুদ্ধ ব্যতিরেকে সেনাবাহিনীর প্রচলিত আইনের কোনো ব্যতিক্রম প্রত্যাশিত নয়। নবনিযুক্ত সেনাপ্রধান লে. জে. ইকবাল করিম ভূইয়ার পেশাদারি সুনাম সুবিদিত। তাঁকে আমরা অভিনন্দন জানাই।
সত্য যে জ্যেষ্ঠতার নীতি রাষ্ট্রের কোনো অঙ্গেই সেভাবে প্রতিষ্ঠা পায়নি। অবশ্য জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ বা সশস্ত্র বাহিনীতে শুধু জ্যেষ্ঠতা পদোন্নতির একমাত্র মানদণ্ড হতে পারে না। তা ছাড়া সেনাপ্রধান পদটি পদোন্নতি নয়, নতুন নিয়োগ। বর্তমানে চারজন লেফটেন্যান্ট জেনারেলের মধ্য থেকে একজনকে জেনারেল পদমর্যাদায় উন্নীত করে সেনাপ্রধান নিয়োগ দেওয়া হলো। এই অনুশীলনে পরিবর্তন আনার কথা ভাবা যায়। প্রতিবেশী ভারতে লে. জেনারেল পদমর্যাদার কোনো কর্মকর্তা সেনা সদর দপ্তরে পিএসও কিংবা কোর কমান্ডার হলে, সেনাপ্রধান পদে মেধা বিবেচনায় নিয়োগের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয়ে থাকেন। কারণ, তাঁদের প্রত্যেকেরই যথেষ্ট অভিজ্ঞতা এবং জ্যেষ্ঠতা থাকে। তাই ভারতে এ রকম ডজনের বেশি লে. জেনারেলের মধ্য থেকে সেনাপ্রধান বাছাই করা হয়।
বাংলাদেশেও সেনাপ্রধান বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এ ধরনের রীতি অনুশীলন করা যেতে পারে। ন্যূনতম এক মাস আগে নতুন সেনাপ্রধানের নাম ঘোষণার রেওয়াজ চালু করা উচিত। কারণ, এতে বিদায়ী প্রধান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন বিভাগ থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় নেওয়ার সুযোগ পান।
অতীতে সেনাবাহিনীতে জ্যেষ্ঠতার বিচ্যুতি সুফল বয়ে আনেনি। আইয়ুব-ইয়াহিয়া-জিয়াউল হকের উপাখ্যান থেকে বাংলাদেশের শাসকেরা শিক্ষা নিয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয়নি। প্রতিরক্ষা বাহিনীতে কর্মস্থল নির্ধারণ ও পদোন্নতিতে অনেক সময়ই পেশাগত উৎকর্ষের চেয়ে রাজনৈতিক কিংবা ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের বিবেচনা প্রাধান্য পেয়েছে বলেই প্রতিভাত হয়েছে। এসব নজির একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর নৈতিক ও পেশাগত মনোবলকে ক্ষুণ্ন করতে পারে। সে কারণেই প্রতিরক্ষা বাহিনীর উচ্চতর পদায়ন ও পদোন্নতিতে সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারের যথাযথ অনুশীলনই জরুরি ছিল।

No comments

Powered by Blogger.