শ্রমিকদের মানুষের মর্যাদা দিতে হবে-পোশাক খাতের সমস্যা

আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের অধিকার আন্দোলনের বিষয়টি বহুল আলোচিত। কখনো কখনো এ আন্দোলন সহিংস রূপ নিয়েছে, যা অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তিরও ক্ষতি করেছে। দেশে দেশে শ্রমিকদের ন্যায়ভিত্তিক, যুক্তিপূর্ণ দাবিদাওয়া আদায়ের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে ন্যায্যতার ভিত্তিতেই দেখা হয়;


দমন-পীড়নকে ভালো চোখে দেখা হয় না। বাংলাদেশে অতি সাম্প্রতিক সময়ের শ্রমিক আন্দোলনের জের ধরে শ্রমিকদের ধরপাকড়ের বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভা কংগ্রেসের ১৯ জন সদস্যের একটি চিঠি আমাদের সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁরা এ দেশের পোশাকশ্রমিকদের অধিকারের আন্দোলনকে ‘সরকারিভাবে দমন-পীড়নে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন’ বলে খবরে প্রকাশ। শুধু তা-ই নয়, তাঁরা দেশের শীর্ষস্থানীয় দুটি তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক গ্রুপের শ্রমিকবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ তৈরি পোশাক ক্রেতাদের আহ্বান জানিয়েছেন, তাঁরা যেন আমাদের এই দুটি রপ্তানি গ্রুপের কোনো পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি না করেন। যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক ও জুতা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সমিতি আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনও সরকারের কাছে এক চিঠিতে একই ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের জন্য চিন্তার। কেননা, এতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয় এবং তার নেতিবাচক প্রভাব বিশ্বের অন্যত্র আমাদের তৈরি পোশাকের রপ্তানি-বাজারেও পড়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। অবশ্য এমন নয় যে ১৯ জন কংগ্রেসম্যানের পরামর্শ অনুযায়ী মার্কিন ক্রেতারা আমাদের শীর্ষস্থানীয় দুই প্রতিষ্ঠানের পণ্য কেনা বন্ধ করে দেবেন। আমরা আশা করি, তার আগে তাঁরা বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে দেখবেন এবং যেসব অভিযোগে কংগ্রেসম্যানরা এমন পরামর্শ দিয়েছেন, সে অভিযোগগুলোও খতিয়ে দেখার অবকাশ আছে। এটি গেল একটি দিক, অন্যদিকে যা অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, ১৯ কংগ্রেসম্যান ও আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের অভিযোগে আমাদের পোশাকশিল্পের মালিকদের এবার নড়েচড়ে ওঠা উচিত। আমাদের সরকারের বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে পোশাকশ্রমিকদের দুঃখকষ্টের প্রতি মালিকদের অসংবেদনশীলতার কারণে। শ্রমিক ও শ্রমিকনেতাদের ধরপাকড়, নির্যাতন, তাঁদের পরিবার-পরিজনকে হয়রানি ইত্যাদি দমনমূলক অবিমৃশ্যকারী পদক্ষেপ এড়িয়ে যুক্তিযুক্ত, শান্তিপূর্ণ পন্থায় সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল। এ কথা সব সময়ের জন্যই প্রযোজ্য।
পোশাকশিল্পে সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কিছু বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) নিবন্ধন বাতিল করেছে। মালিকপক্ষের অভিযোগের ভিত্তিতে শ্রমিকনেতার শাস্তি-হয়রানির শিকার না করে বিষয়গুলো ভালোভাবে তদন্ত করে দেখা সরকারের কর্তব্য। শ্রমিকনেতাদের গ্রেপ্তার করে রাখার আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াও যে আছে, তা মনে রাখতে হয়।
আমাদের তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের সঙ্গে মালিকদের সম্পর্ক স্বস্তিকর নয়। এর কারণগুলো আন্তরিকতার সঙ্গে খতিয়ে দেখতে হবে মালিকপক্ষকে। শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান অত্যন্ত নিম্ন; তাঁদের কাজের পরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ নয়। প্রায়ই অগ্নিকাণ্ডে শ্রমিকদের প্রাণহানি ঘটে। শ্রমিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগও কম নয়। সর্বোপরি তাঁদের মজুরি বৃদ্ধি, সময়মতো মজুরি ও বোনাস পরিশোধ করা নিয়ে মালিকপক্ষের গড়িমসি চলে। শ্রমিকদের কেবল শ্রমের হাতিয়ার হিসেবে না দেখে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিতে হবে। তাঁদের অভিযোগগুলো যথেষ্ট সংবেদনশীলতার সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত।

No comments

Powered by Blogger.