কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতায় বুয়েট by মোহাম্মদ কায়কোবাদ

কম্পিউটার প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্রয়োদশতম অংশগ্রহণ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা; বিশেষ করে, যখন সরকার ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সংকল্পবদ্ধ। এই প্রতিযোগিতা দুটি ধাপে সম্পন্ন হয়।


প্রথম ধাপে নানা আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের দল অংশগ্রহণ করে থাকে। তারপর বিজয়ী দলগুলো নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ‘মস্তিষ্কের যুদ্ধ’ নামের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ। এশিয়ার ১৪-১৫টি আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার একটি অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায় এবং সেই সুবাদে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারে। এই প্রতিযোগিতার সুবাদেই বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ছাত্ররা তাদের প্রোগ্রামিং-শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার সুযোগ পেল অনেক নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়কে পেছনে ফেলে। বুয়েটের ছাত্ররা পৃথিবীর চার-পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষুদ্র তালিকায় ইতিমধ্যেই নাম লিখে ফেলেছে। শুধু তা-ই নয়, প্রকৃতপক্ষে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণে বুয়েটের দল ব্যর্থ হয়নি এ পর্যন্ত।
এবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ দলে রয়েছে তানায়েম মো. মুছা, মুনতাসির মাশুক এবং তাসনীম ইমরান সানি। এদের মধ্যে তানায়েম ছিল গত বছর স্টকহোমে অংশগ্রহণ করা দলের সদস্য। তাসনীম ইমরান বুয়েটের পুরকৌশলের ছাত্র। বাংলাদেশ থেকে প্রথম যে তিনজন ছাত্র ২০০৫ সালে মেক্সিকোয় ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিয়াড ইন ইনফরমেটিকে অংশগ্রহণ করেছিল, তাদের একজন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে কম্পিউটার বিভাগে ভর্তির সুযোগ পায়নি। সাংহাইতে এ বিষয়টি নিয়ে ন্যাশনাল তাইওয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফুংয়ের সঙ্গে কথা হলো। তিনি বলেন, অলিম্পিয়াডে যারা ভালো করে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ছেলেমেয়েরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভর্তি হওয়ার আমন্ত্রণ পায়, আলাদা ভর্তিপরীক্ষা দিতে হয় না। অর্থাৎ কেউ যদি আন্তর্জাতিক পদার্থবিদ্যা অলিম্পিয়াডে ভালো করে, তাহলে পদার্থবিদ্যায় তার ভর্তি হয় সরাসরি। সত্যিই তো, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যারা বিভিন্ন বিষয়ে দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করছে, তাদের তো এই সুযোগ দেওয়া যেতেই পারে। ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের কোচ অধ্যাপক উ জানালেন, ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াডে যারা ভালো করে তারা সরাসরি সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ও এ রকম ছাত্রদের সরাসরি ভর্তি করে থাকে এবং সেই ছাত্রদের দলই আমাদের দেশের এসিএম আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় এসে নিয়মিত বিজয়ী হয়। বাংলাদেশের ৪০ বছরের ইতিহাসে অলিম্পিয়াড কিংবা অলিম্পিক থেকে রৌপ্য পদক বিজয়ী হয়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিভাগে ভর্তি হতে পারেনি।
দুর্ভাগ্য শুধু আবিরের নয়, আমাদেরও। কম্পিউটার দক্ষতায় বিশ্বমানের মেধা থাকতেও আমরা তাকে বিভাগে পেলাম না। ব্যতিক্রম কিছু আমরা সহজে মেনে নিতে পারি না। ব্যতিক্রম না করেই বুয়েট এখনো দেশের ভেতরে তার অনন্য অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছে, তবে যেহেতু আঞ্চলিক অলিম্পিয়াডের ফলাফল আমরা কোনোভাবেই প্রভাবিত করতে পারব না, বোর্ডের পরীক্ষার ফলাফলে এ ধরনের ব্যতিক্রম করলে ক্ষতির সম্ভাবনা খুব কম হতো এবং সাধারণ ভর্তি পরীক্ষায় যথাযথ বুৎপত্তি দেখাতে ব্যর্থ হলেও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের দক্ষতা ও মেধার বলে এ ধরনের ছাত্র অনেক বেশি সুনাম নিয়ে আসতে পারত।
যা হোক, পুরকৌশলের ছাত্র সানিকে নিয়ে কথা হচ্ছিল। পুরকৌশলের ছাত্র হয়ে কিন্তু সে শুধু কম্পিউটার প্রোগ্রামিংই যে করে, তা-ই নয়; কম্পিউটারের ছাত্রদের পেছনে ফেলে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণের গৌরব অর্জন করেছে। এর আগে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বেশ কয়েকজন ছাত্র অনুরূপ সাফল্য অর্জন করে।
এবারের প্রতিযোগিতা চীনের উত্তর-পূর্ব এলাকার শহর হারবিনে। অসম্ভব শীত, শূন্যের নিচে ২০-৩০ ডিগ্রি। তাই আইসিপিসির হোমপেজে নিয়মিতভাবে জানানো হচ্ছে, আসার সঙ্গে সঙ্গেই শীতের হেভিওয়েট পোশাক দেওয়া হবে। হারবিন শহর আইস কিংবা স্লো স্ক্রাম্পচারের জন্য বিখ্যাত। বরফ দিয়ে সুন্দর বড় বড় ভবন কিংবা বড় বড় মূর্তি তৈরি করে শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হয়। সারা বিশ্বের খুদে কম্পিউটার জাদুকরদের এটা দেখাতেই ফেব্রুয়ারির শুরুতে এই প্রতিযোগিতার আয়োজন। আমরা জানুয়ারি মাসের ২৯ তারিখ রওনা হলাম। আবার গভ. ল্যাবরেটরি স্কুলে বিভাগীয় গণিত অলিম্পিয়াড থাকায় সেখানেও একটু উপস্থিত হয়ে সবাইকে নিয়ে বিমানবন্দরে পৌঁছাতে ১২টা বেজে গেল। ইমিগ্রেশন পার হতে বেশ কিছুক্ষণ পর জানা গেল, কুনমিং থেকে চায়না ইস্টার্নের ফ্লাইট এসে ছাড়তে ঘণ্টা তিনেক দেরি হবে। আমাদের মাথায় বজ্রপাত। কুনমিং থেকে সাংহাইয়ে আমাদের ফ্লাইট নয়টায় আর আমরা নাকি পৌঁছাবও কাছাকাছি সময়ে। তারপর বাংলাদেশের সবুজ পাসপোর্টকে কবুল করতে কমপক্ষে ৪০ মিনিট লাগবে। এর মধ্যে লাইনে দাঁড়ানো পেছনের লোকজনও ফাঁকা হয়ে যাবে। থাকবে শুধু বাংলাদেশের পাসপোর্টধারীরা। আমাদের নেতা-নেত্রীদের সুযোগ্য নেতৃত্বে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি বিদেশ-বিভুঁইয়ে এতই খারাপ।
যা হোক, ঢাকায় বিমানবন্দরে বসে-হেঁটে সময় পার করছিলাম। একটি ঘটনা ভালো লাগছিল। যখন বিদেশ যাই, তখন বিমানবন্দরে একটি-দুটি বিমানকে এতিমের মতো দেখি। এবার দেখলাম ১০-১২টা। আবার স্ক্রিনে যে আগমন-বহির্গমনের বার্তা দিচ্ছিল, তাও কিন্তু এক স্ক্রিনে হচ্ছিল না। বাংলা-ইংরেজি আলাদা দেখাতে বেশ কয়েকটি স্ক্রিন লেগে যাচ্ছিল। আমাদের জনসংখ্যা সিঙ্গাপুরের ৪০ গুণ বেশি হতে পারে, ফ্লাইট নিশ্চয়ই ৪০ ভাগের এক ভাগ। একই কথা থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া কিংবা কোরিয়ার তুলনায় বলা যাবে। এটার অর্থ হলো, আমরা এখনো ধর্তব্যের মধ্যে কোনো অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে উঠিনি। যার ফলে দেখা যায়, বিদেশি পত্রিকায় আবহাওয়ার বার্তা যখন দেখায় তখন কুয়ালালামপুর, ব্যাংকক, কলকাতা, দিল্লি, করাচির আছে কিন্তু ঢাকার নেই। স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকায়ও ব্যাংকক, ভারত আছে, বাংলাদেশ নেই। এভাবে পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম জনবহুল দেশ নানা গণনায় শুধু বিশ্বেই নয়, আমাদের অঞ্চলেও অবহেলিত। ঢাকা থেকে কলম্বো যাওয়ার সহজ পথ হলো ব্যাংকক কিংবা সিঙ্গাপুর হয়ে। ঢাকা থেকে সরাসরি যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
যা হোক, রাত পৌনে নয়টায় যখন কুনমিং শহরে পৌঁছলাম, তখন তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রি, তাই যথেষ্ট শীত শীত করছিল। উপরন্তু রয়েছে পরবর্তী ফ্লাইটের অনিশ্চয়তা। সানির ছবি মাত্রাতিরিক্ত বাচ্চা বয়সের জন্য নানা দ্বিধাদ্বন্দ্ব। তারপর আবার বাংলাদেশি পাসপোর্ট। পরিশেষে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার হাত থেকে পরিত্রাণ যদিও পেয়েছি, ভাইয়ের কাছে কোরিয়া বেড়াতে যাওয়া অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো। সৌভাগ্যবশত কুনমিংয়ে বসবাসকারী ব্যবসায়ী বাংলাদেশি নাগরিকদের সাহায্যে চায়না ইস্টার্নের সৌজন্যে একটি হোটেলে থাকা, চায়নিজ নুডলস খাওয়া এবং সকাল নয়টায় সাংহাইয়ের ফ্লাইট এবং আবার এয়ারপোর্টে ফেরা। এর মধ্যে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের আমন্ত্রণকারী ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উকে কিছুই জানাতে পারিনি। ২০০৩ সাল থেকে নিয়মিতভাবে তাঁর দল বাংলাদেশে এসে একবার ছাড়া প্রতিবারই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, সারা বছর নানা উদ্যোগ নেওয়ার জন্য নিয়মিত ই-মেইল করেন। কখন ইনফরমেটিকসের প্রস্তুতি নিতে হবে, কোন সাইটে ভালো ভালো সমস্যা রয়েছে। মোটের ওপর, বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা আরও কীভাবে প্রোগ্রামিং-ক্ষমতা অর্জন করতে পারবে, তা নিয়ে তাঁর চিন্তার শেষ নেই। প্রতিবছর নানা সুভেনির নিয়ে আসেন আমাদের জন্য। আমরা যখন প্রায় ১২টার সময় সাংহাই বিমানবন্দরের বাইরে যাওয়ার গেটে এসেছি, কিঞ্চিৎ উদ্বেগ নিয়ে লক্ষ করলাম, দুই হাত আকাশে তুলে আমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা যে করছেন, ১৯ বছরের তরুণের মতো, তিনিই হলেন আমাদের আমন্ত্রণকারী, ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারের অধ্যাপক, যাঁর ছাত্ররা একাধিকবার আইসিপিসির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে মেডেল পেয়েছে। আমাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য আগের দিন রাতেও এসেছিলেন। আমাদের থাকার যাতে অসুবিধা না হয়, কাজাখস্তানের কাছাকাছি চীনের বাসিন্দা সদ্য স্কুল শেষ করা ইংরেজিতে দক্ষ আরাফাতকে নিয়ে এসেছেন। আরাফাতের চমৎকার ইংরেজিতে আমরা আশ্বস্ত বোধ করলাম, যা বোঝাতে চাইব আরাফাত তা-ই বুঝবে। অধ্যাপক উর আতিথেয়তার আন্তরিকতার মাত্রা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এই আপ্যায়নে সর্বক্ষণই নিজেকে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর মনে হবে। ভাষার বাঁধ ডিঙিয়ে তাঁর আন্তরিকতা যে ছাপ রাখে তা চিরদিন মনে থাকবে। আমাদের সামান্য আরাম-আয়েশের জন্য ১২-১৩ বছর বয়সী ছেলের মতো দৌড়ঝাঁপ দিতেও তাঁর আগ্রহের কমতি নেই। আমাদের আবীর, যে এবার ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াডে রৌপ্য পদক পেল, তার জন্য নানা উদ্যোগের কথা অধ্যাপক উ আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, আবীর পুরস্কার পাওয়ার পর আমি না জানালেও তিনি প্রথম অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট সবাইকে। অধ্যাপক উর মতো সফল মানুষ হয়তো বাংলাদেশেই রয়েছেন, যাঁদের মূল্যায়ন সাধারণত যথাযথ হয় না। কারণ যারা দৌড়ঝাঁপ করে, যেকোনো সমস্যায়ই মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাদের বড় মাপের ভাবি কী করে? অথচ বৃক্ষ তোমার নাম কী, ফলে পরিচয়—আমরা কি এ কথায় বিশ্বাস করি? আমাদের দেশকে উন্নত করতে হলে, অগ্রগতির পথে নিয়ে যেতে হলে যারা কাজ করে তাদের এগিয়ে রাখতে হবে, কথাসর্বস্বদের না দিলেও চলবে। যত দিন আমরা তা করতে পারব না তত দিন অগ্রগতি মরীচিকার মতো থেকে যাবে।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।

No comments

Powered by Blogger.