মিয়ানমার থেকে ফিরে by গৌতম লাহিড়ী

গত এপ্রিলে মিয়ানমারের পার্লামেন্টের ৪৪টি আসনে জয়ের পর সু চি মন্তব্য করেছিলেন_ 'নবযুগের সূচনা হলো'। কিন্তু মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচন হবে সঠিক সময়ে, অর্থাৎ ২০১৫ সালে। পার্লামেন্টের মোট আসন ৪৪০। এর মধ্যে ১১০টি সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত।


অবশিষ্ট আসনে রয়েছে বর্তমান সেনা মদদপুষ্ট রাজনৈতিক দল ইউনিয়ন সলিডারিটি এবং ডেমোক্রেটিক পার্টি (ইউএসডিপি)। সুতরাং বিশ্বজুড়ে সু চিকে নিয়ে যে উচ্ছ্বাস, তার প্রকৃত ক্ষমতায়ন হবে কী করে?



২৫ বছর পর মিয়ানমারে এসে 'পরিবর্তনের' হাওয়া উপলব্ধি করলাম। ইয়াঙ্গুন শহরের ইনিয়া হ্রদের বিপরীতে অং সান সু চির বাড়ির সামনে জনতা সমাগত নিস্তরঙ্গ জীবনপ্রবাহে চাঞ্চল্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে, যা আগে দেখিনি। কয়েক ফার্লং দূরে শহরের ছোট মনিহারি দোকানেও ঝুলছে সু চি এবং তার বাবা অং সানের যুগ্ম প্রতিকৃতিসহ টি-শার্ট। মিয়ানমারিদের কাছে তিনি সবার 'চাচি'। তাই তার নামের আগে ডাও। ডাও শব্দের অর্থ চাচি। নামের প্রথম দুই অক্ষর বাবার নাম_ অং সান। আর সু হলো দাদির নাম। মা কিন চির 'চি'_ সব মিলিয়ে 'ডাও অং সান সু চি' এখন মিয়ানমারের ভবিষ্যৎরূপে প্রচারিত। দীর্ঘকাল সেনাশাসিত মিয়ানমারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাণ্ডারি তিনি। কিন্তু সেনা-প্রভাবিত অচলায়তনের ভিত্তি কতটা তিনি ভাংতে পারবেন_ তাই নিয়ে চলছে মিয়ানমারে জল্পনা। কিছুদিন আগেও সু চির প্রতিকৃতি নিয়ে শহরের জগদ্বিখ্যাত সোনার প্যাগোডা 'স্বেডাগন প্যাগোডা'য় প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। আজ আর নয়। দেয়াল লিখন স্পষ্ট বলেই সেনা মদদপুষ্ট জাতীয় সরকার এখন শহরে অনেক নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেছে। এই প্যাডোগা মিয়ানমারের রাজনৈতিক বহু উত্থান-পতনের সাক্ষী। ১৯৮৮ সালের ৮ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই সু চির মিয়ানমারের রাজনীতিতে উত্থান, যা এখানে '৮৮৮৮' অভ্যুত্থানরূপে খ্যাত। মিয়ানমারিদের কাছে আট অত্যন্ত শুভ সংখ্যা। কিন্তু সেই শুভ সূচনার পর ২৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে সু চিকে নূ্যনতম গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জন করতে। প্রশ্ন_ আরও কি অপেক্ষা করতে হবে?
গত এপ্রিলে মিয়ানমারের পার্লামেন্টের ৪৪টি আসনে উপনির্বাচনে অং সান সু চিসহ তার দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ৪৩টি আসনে জয়ী হয়। জয়ের পর সু চি মন্তব্য করেছিলেন_ 'নবযুগের সূচনা হলো'। কিন্তু মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচন হবে সঠিক সময়ে, অর্থাৎ ২০১৫ সালে। পার্লামেন্টের মোট আসন ৪৪০। এর মধ্যে ১১০টি সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত। অবশিষ্ট আসনে রয়েছে বর্তমান সেনা মদদপুষ্ট রাজনৈতিক দল ইউনিয়ন সলিডারিটি এবং ডেমোক্রেটিক পার্টি (ইউএসডিপি)। সুতরাং বিশ্বজুড়ে সু চিকে নিয়ে যে উচ্ছ্বাস, তার প্রকৃত ক্ষমতায়ন হবে কী করে? এটাই এখন প্রধান আলোচ্য বিষয়। দ্বিতীয়ত, মিয়ানমারের সংবিধান সেনা শাসক দ্বারা লিখিত। যেখানে সাবেক সেনা অফিসার না হলে রাষ্ট্রপতি বা মন্ত্রী হওয়া যাবে না। আবার মন্ত্রী হলে সাংসদ পদ ছাড়তে হবে। আদতে সেনা সাংসদরা মন্ত্রী হবেন বলেই পদত্যাগ করায় উপনির্বাচন হয়। এ উপনির্বাচনে সু চি এবং তার সঙ্গীরা জয়ী হন। এ কারণে অং সান সু চিকে ক্ষমতায় আসীন হতে হলে প্রথম সেনা রচিত সংবিধানের আমূল সংস্কার করতে হবে। তাই মিয়ানমারে এখন প্রধান সংগ্রাম সংবিধান সংশোধন। এর জন্যই সু চি জনমত তৈরি করছেন। পশ্চিমা দুনিয়াসহ প্রায় গোটা বিশ্ব এ লক্ষ্যেই সেনা সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছে। এর আগে মিয়ানমারের সংবিধানে বলা ছিল, সাজাপ্রাপ্ত আসামি হলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা যাবে না। সু চি যাতে অংশ নিতে পারেন, তার জন্য বর্তমান সরকার সে নিয়মের সংশোধন করে গোটা বিশ্বের প্রশংসা কুড়িয়েছে। তারা গণতন্ত্রের দাবি মেনে একনায়কতন্ত্র থেকে শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তন করছে। ফলে বর্তমান সরকার সেনা মদদপুষ্ট হলেও সময়ের দাবি মেনে নিজেদেরও পরিবর্তন করছে। তাই পশ্চিমা দুনিয়া আরোপিত নিষেধাজ্ঞা কিঞ্চিৎ শিথিল করেছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন কিন্তু বিরোধী নেত্রী অং সান সু চির সঙ্গে পরামর্শ করেই সংস্কারযজ্ঞ শুরু করেছেন। যার জন্য ৫০ বছর পর মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব হিলারি ক্লিনটন ছুটে এলেন মিয়ানমারে। এখন প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান আসছেন মিয়ানমারে। ২৫ বছর পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংও এলেন। একে তো ভৌগোলিক দিক থেকে মিয়ানমারের অবস্থান স্ট্র্যাটেজিক। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সিংহদুয়ার। তার ওপর মণি-মুক্তা-পান্নার মতো দামি খনিজসম্পদসহ 'তরল সোনা' গ্যাসের ভাণ্ডার। মিয়ানমার যখন পরিবর্তনের হাওয়ায় নিজেদের জানালা খুলে দিতে চাইছে, তখন সুযোগের ভিড় বাড়বেই।
এই উদার আর্থিক সংস্কার কখনোই জনপ্রিয় হয় না। তাই প্রয়োজন রাজনৈতিক সর্বসম্মতির। এরই প্রয়াস শুরু হয়েছে এখানে। বর্তমান সরকার যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে বিরোধী নেত্রীকে সঙ্গে নিয়েই চলার ইঙ্গিত দিচ্ছে বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানদের। কিন্তু এ নিয়ে রাজনৈতিক বিরোধ রয়েছে অং সান সু চির। এ কথা তিনি গোপন করেননি প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের কাছে। প্রধানমন্ত্রীও ইয়াঙ্গুনের সভায় সে কথা বলেছেন। সু চি তার কাছে মিয়ানমার সরকারের সংস্কার কর্মসূচি নিয়ে নালিশও জানিয়েছেন। মরিয়া বর্তমান সরকার যেমন করেই হোক মিয়ানমারের আর্থিক সংস্কারে অং সান সু চিকে শামিল করতে চায়। এমন প্রস্তাব অত্যাধুনিক রাজধানী নেপিডোতে কান পাতলেই শোনা যাবে। অদূর ভবিষ্যতে সাংবিধানিক জটিলতার কারণে অং সান সু চিকে মন্ত্রিসভায় না নেওয়া গেলেও পার্লামেন্টের স্পিকার পদ দিয়ে 'জাতীয় সরকার' গড়া যায় কি-না তা ভাবা হচ্ছে। এ কথা এখনই প্রকাশ্যে স্বীকার করা হচ্ছে না; কিন্তু পশ্চিমা দুনিয়া নিজেদের বাণিজ্যিক ও রণনীতির স্বার্থে শেষ পর্যন্ত অং সান সু চিকে রাজি করানোর উদ্যোগ নিতে পারে। কিন্তু দোলাচলে রয়েছেন সু চি নিজে। আংশিক ক্ষমতার সুযোগ নেওয়ার কারণে তার বৈপ্লবিক চরিত্রে পাছে কোনো আঁচ পড়ে যায়! নাকি ফের রাজপথে নেমে সার্বিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বেন? আগামী দিনগুলো ইরাবতী উপত্যকা আকর্ষণীয় রাজনৈতিক পালাবদলের সাক্ষী হয়ে উঠবে। ক'দিনের সফরে এমন এক চিন্তা নিয়েই ফিরলাম রাজধানী দিলি্লতে।

গৌতম লাহিড়ী :সমকাল প্রতিনিধি
নয়াদিলি্ল
 

No comments

Powered by Blogger.