অকারণে অনেক ভালো কর্মকর্তাকে ওএসডি করে রাখা হচ্ছে। তাঁদের দপ্তর নেই, কাজ নেই, বেতন দেওয়া হচ্ছে নিয়মিত-৩৮২ কর্মকর্তা ওএসডি, মাসে খরচ আড়াই কোটি টাকা by মোশতাক আহমেদ

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে গুরুত্বপূর্ণ একটি জেলার প্রশাসক ছিলেন; পরে মন্ত্রণালয়ে উপসচিব পদে বদলি হন; বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রশাসন ক্যাডারের এই কর্মকর্তাকে ২০০৯ সালের নভেম্বর থেকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে রাখা হয়।


আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে তাঁর কোনো কাজ নেই। দপ্তরও নেই।
কাজ না থাকলেও তাঁর পেছনে প্রতি মাসে রাষ্ট্রের খরচ হচ্ছে প্রায় ৪২ হাজার টাকা। এ রকম ১৫১ জন উপসচিব বর্তমানে ওএসডি হয়ে আছেন। তাঁদের পেছনে মাসে খরচ হচ্ছে ৬৩ লাখ টাকার বেশি।
শুধু উপসচিব নন, সহকারী সচিব (মাঠপর্যায়ে সহকারী কমিশনার) থেকে সচিব পর্যন্ত ৩৮২ জন কর্মকর্তা বর্তমানে ওএসডি হয়ে আছেন। এসব কর্মকর্তার বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা মিলিয়ে মাসে সরকারের খরচ হচ্ছে আড়াই কোটি টাকার বেশি। এই হিসেবে বছরে খরচ ৩০ কোটি টাকা।
তবে ওএসডি হওয়া কর্মকর্তার সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ে-কমে। এ কারণে এ হিসাবের হেরফের হতে পারে।
একজন যুগ্ম সচিবের বেতন স্কেল ২৯ হাজার থেকে ৩৫ হাজার ৬০০ টাকা পর্যন্ত। এর মধ্যে গাড়ি (চালক, মেরামত খরচসহ), টেলিফোনসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা মিলিয়ে একজন যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তার পেছনে খরচ হয় প্রায় ৯৮ হাজার টাকা। বর্তমানে ওএসডি যুগ্ম সচিব আছেন ১৪৬ জন। এই হিসাবে ওএসডি থাকা যুগ্ম সচিবদের পেছনে খরচ হয় মাসে প্রায় এক কোটি ৪৪ লাখ টাকা।
একজন অতিরিক্ত সচিবের পেছনে সুযোগ-সুবিধা মিলিয়ে মাসে ব্যয় হয় এক লাখ তিন হাজার টাকার মতো। বর্তমানে ওএসডি থাকা ৩৬ জন অতিরিক্ত সচিবের পেছনে মাসে খরচ প্রায় ৩৭ লাখ আট হাজার টাকা।
একজন সচিবের মূল বেতন ৪০ হাজার টাকা। মূল বেতনের সঙ্গে গাড়ি-বাড়ি, টেলিফোনসুবিধাসহ আনুষঙ্গিক মিলিয়ে একজন সচিবের পেছনে সরকারের প্রতি মাসে ব্যয় হয় এক লাখ ১০ হাজার টাকার মতো। বর্তমানে ওএসডি সচিব আছেন তিনজন। এই হিসাবে ওএসডি থাকা তিনজন সচিবের পেছনে মাসে খরচ প্রায় তিন লাখ ৩০ হাজার টাকা।
এই তিন সচিবের মধ্যে একজন গত বছরের ২৩ আগস্ট থেকে, আরেকজন গত বছরের ১০ অক্টোবর থেকে এবং অপরজন ২০১০ সালের ১১ অক্টোবর থেকে ওএসডি হয়ে আছেন।
এ ছাড়া একজন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিবের মূল বেতন সাড়ে ১৮ হাজার থেকে ২৯ হাজার ৭০০ টাকা। সুযোগ-সুবিধা মিলিয়ে তাঁর পেছনে বেতন-ভাতা বাবদ খরচ হয় প্রায় ৪০ হাজার টাকা। বর্তমানে ওএসডি থাকা ৪১ জন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব এবং পাঁচজন সহকারী সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তার পেছনে মাসে খরচ হয় প্রায় ১৭ লাখ টাকা।
কোনো কোনো কর্মকর্তা ছোটখাটো কারণেও ওএসডি হয়ে আছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দায়িত্ব পেয়ে বর্তমান সরকারের আমলের বেশ কিছু সময় ধরে জনপ্রশাসনের একজন অতিরিক্ত সচিব একটি বিভাগে শীর্ষ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেন। সেখান থেকে প্রথমে তাঁকে তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ একটি সংস্থায় বদলি করা হয়। কিন্তু গত বছরের আগস্ট থেকে তিনি ওএসডি। কেন ওএসডি করা হলো, এর কারণ জানানো হয় না।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের সূত্রে জানা যায়, গত ২২ মে পর্যন্ত ওএসডি, সংযুক্ত ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা সংস্থায় ন্যস্ত করে রাখা মোট কর্মকর্তার সংখ্যা ৫৬২। এর মধ্যে শুধু ওএসডি কর্মকর্তার সংখ্যা ৩৮২, যাঁদের বেশির ভাগই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ওএসডি আছেন। কিছু কর্মকর্তাকে অন্য মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করে রাখলেও তাঁদের কোনো দপ্তর নেই, কাজ নেই।
যুগ্ম সচিব ও উপসচিবদের অনেককে ২০০৯ ও ২০১০ সাল থেকেই ওএসডি করে রাখা হয়েছে। ওএসডি থাকা একজন উপসচিব বলেন, ‘সারা জীবন ভালোভাবে চাকরি করেছি। চাকরির আগের শিক্ষাগত (এসএসসি ও এইচএসসি) যোগ্যতাও ভালো। এর পরও মাসের পর মাস ধরে ওএসডি থাকতে হচ্ছে, এটা যে কী যন্ত্রণার, তা আমিই বুঝছি! মাঝে মাঝে মনে হয়, চাকরি ছেড়ে দিই। কিন্তু এই বয়সে হঠাৎ করে কোথায় যাব। পরিবার-পরিজন আছে, সবই চিন্তা করতে হয়।’
উপসচিব পর্যায়ের আরেক কর্মকর্তা বলেন, সচিব পর্যায়ের কোনো কোনো কর্মকর্তার ব্যক্তিগত অপছন্দের কারণেও কাউকে কাউকে ওএসডি করা হয়েছে। নিয়মানুযায়ী কোনো অভিযোগের কারণে ওএসডি করলে সর্বোচ্চ ১৫০ দিনের মধ্যে সেই অভিযোগের নিষ্পত্তি করার কথা। কিন্তু এখন মাস পেরিয়ে বছর গড়ালেও তা সুরাহা হচ্ছে না।
পাঁচ মাস ধরে ওএসডি থাকা উপসচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার যদি আমাদের কোনো কাজ না দিতে চায়, তাহলে চাকরি থেকে বাদ দিলেই পারে। এখন যা হচ্ছে, তাতে সামাজিকভাবেও ক্ষতির মুখে পড়ছি, মনোবলও ভেঙে যাচ্ছে।’
রাজনৈতিক কারণেই বেশি ওএসডি: জনপ্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, জনপ্রশাসনে ওএসডি থাকা ৩৮২ জন কর্মকর্তার মধ্যে বেশির ভাগই বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। একসময় যাঁরা খুব ভালো অবস্থানে ছিলেন, তাঁদের এখন চেয়ার নেই, কাজ নেই, দপ্তর নেই। ঘুরে ঘুরে সময় পার করেন। তবে শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত অপছন্দের কারণেও কোনো কোনো কর্মকর্তাকে ওএসডি করার অভিযোগ আছে।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করা একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয় সাধারণত মেধাবী, দক্ষ ও যোগ্য কর্মকর্তাদের। সেখানে এক সরকারের আমলে জেলা প্রশাসকের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে যদি আরেক সরকারের আমলে ওএসডি থাকতে হয়, তাহলে ভালো কেউ আর এসব পদে যেতে চাইবেন না। ফলে এসব জায়গায় যাবেন তুলনামূলক কম যোগ্য কর্মকর্তারা। এতে দুর্নীতির আশঙ্কা যেমন বাড়বে, তেমনি জনপ্রশাসন দুর্বল হয়ে পড়বে।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাধারণত নতুন পদায়ন, প্রশিক্ষণ বা শিক্ষাছুটির প্রয়োজন পড়লে কাউকে ওএসডি করা হয়। কিন্তু বর্তমানে বিনা কারণে অনেক ভালো কর্মকর্তাকে ওএসডি করে রাখা হচ্ছে। এতে করে এসব কর্মকর্তার অর্জিত অভিজ্ঞতা যেমন কাজে লাগছে না, তেমনি সরকারও তাঁদের বসিয়ে বসিয়ে টাকা দিচ্ছে। এটা বাঞ্ছনীয় নয়। এটা অবশ্যই দূর করতে হবে। এ জন্য দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা।’
জনপ্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাজনৈতিক কারণে সব সরকারের আমলেই কর্মকর্তাদের ওএসডি করে রাখা হয়। এখন পদের তুলনায় পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তার সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় জনপ্রশাসনে ওএসডি-আতঙ্ক বেড়েছে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার দ্বিতীয় বছর পর্যন্ত ওএসডি কর্মকর্তার সংখ্যা ছিল আড়াই শর মতো, যা এখন বেড়েছে। বিএনপির সময় ২০০৫ সালে ৩৭২ জনকে ওএসডি করা হয়েছিল। তবে ওই সরকারের শেষ সময়ে, অর্থাৎ ২০০৬ সালের অক্টোবরে এই সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। বিগত সময়কালে কম ওএসডি ছিল বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে, এই সংখ্যা মাত্র ৫৮ জন।
বর্তমানে সচিব থেকে সহকারী সচিব পর্যন্ত মোট কর্মকর্তা আছেন চার হাজার ৬৫০ জন। এর সঙ্গে ৩ জুন যোগ দেন সহকারী সচিব (সহকারী কমিশনার) পর্যায়ে নিয়োগ পাওয়া আরও ২৭৭ জন।
জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেছেন, ৪০০-এর মতো কর্মকর্তাকে ওএসডি রেখে সরকার একদিকে যেমন অর্থের অপচয় করছে, অন্যদিকে বছরের পর বছর ধরে চাকরি করে তাঁরা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, সেটিও কাজে লাগছে না। তাঁদের অভিজ্ঞতা ও কর্মঘণ্টা অপচয় হচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে গোটা প্রশাসনে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসনসচিব আবদুস সোবহান সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, কর্মকর্তাদের বেশির ভাগই শিক্ষাছুটি ও পরবর্তী পদায়নের জন্য ওএসডিতে আছেন। তবে কিছু কর্মকর্তাকে শাস্তিমূলক ওএসডি করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.