শেকড়ের ডাক-অন্ধ হলেও প্রলয় বন্ধ থাকে না by ফরহাদ মাহমুদ

না, কোনো জলোচ্ছ্বাস হয়নি। কোনো বিপদসংকেতও ছিল না। নিত্যদিনের মতোই ঘুমিয়েছিল ভোলার উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষকরা। হঠাৎই তারা দেখল, ঘরের ভেতর থৈথৈ করছে পানি। জোয়ারের পানিতেই সেখানে প্লাবিত হয়েছে ১২টি গ্রামের শত শত ঘরবাড়ি। ভেঙে গেছে উপকূল রক্ষা বাঁধের অংশবিশেষ।


হাজার হাজার একর ফসলি জমি লোনা পানিতে ভেসে গেছে। একই অবস্থা দেখা গেছে পটুয়াখালী ও বরগুনাসহ উপকূলীয় অন্যান্য অঞ্চলেও। পূর্ণিমার টানে আন্ধারমানিক, রামনাবাদ, আগুনমুখা, সোনাতলা নদীসহ অন্যান্য নদীতে পানির উচ্চতা স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে পাঁচ-ছয় ফুট বেড়ে গিয়েছিল। কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের নওয়াপাড়া ও মুন্সীপাড়ায় সিডরবিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ দিয়ে প্রবল বেগে জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ে। সেখানেও বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলি জমি লোনা পানিতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বরগুনার মাঝেরচরসহ বেশ কিছু গ্রামে এবার তরমুজের বাম্পার ফলন হয়েছিল। চাষিরা আশায় বুক বেঁধেছিল। কিন্তু তাদের তরমুজ খেত এখন দুই-তিন ফুট লোনা পানির নিচে। একটি তরমুজও ঘরে তুলতে পারবে না তারা। এসব আশাহত কৃষকের এখন বুক চাপড়ে কাঁদা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। একই অবস্থা ঘটেছে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায়। মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়নের সিংহড়তলীতে বাঁধের ১০০ মিটারের বেশি এলাকা ভেঙে গেছে। ফলে মালঞ্চ নদী দিয়ে জোয়ারের পানি পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে ঢুকে যাচ্ছে। গত এক সপ্তাহের পত্রিকা দেখলে এ রকম আরো অনেক খবরই আপনার চোখে পড়বে। এই যদি হয় স্বাভাবিক অবস্থা, তাহলে যখন বড় বিপদসংকেত থাকবে, সমুদ্র উত্তাল থাকবে, জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানবে, তখন এসব উপকূলবাসীর কী হবে? বালুর বাঁধের মতো উড়ে যাবে উপকূল রক্ষা বাঁধ। বহু মানুষের প্রাণ তো যাবেই, সেই সঙ্গে সমুদ্র গ্রাস করবে বাড়িঘর, সহায়-সম্পদ, জমির ফসল_এক কথায় সব কিছু। এ কারণেই আজ উপকূলীয় এলাকার দুই কোটির বেশি মানুষের জীবন চরমভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
এর আগে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আইলায় সাতক্ষীরা অঞ্চল ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আইলায় ভেঙে যাওয়া সেখানকার উপকূল রক্ষা বাঁধটি এখনো মেরামত করা যায়নি। তারও আগে সিডর বিস্তীর্ণ উপকূলে আঘাত হেনেছিল এবং উপকূল রক্ষা বাঁধের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। সেই বাঁধ আজ পর্যন্ত সম্পূর্ণ মেরামত করা যায়নি। তদুপরি এই উপকূল রক্ষা বাঁধ করা হয়েছিল পাকিস্তান আমলে, স্বাভাবিক জোয়ারের পানি আটকানোর জন্য। তখনকার পরিবেশে এই বাঁধের উচ্চতা ঠিক থাকলেও প্রায় পাঁচ দশক পর এর উচ্চতা স্বাভাবিক জোয়ারের পানি ঠেকানোর জন্যও যথেষ্ট নয়। কারণ, ইতিমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা অনেক বেড়েছে। সেই তুলনায় বাঁধের উচ্চতা বাড়েনি। ফলে তা স্বাভাবিক জোয়ারের পানি ঠেকাতেও ব্যর্থ হচ্ছে। গত পূর্ণিমার সময় ভোলা, পটুয়াখালীসহ উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হওয়ার ঘটনা তারই প্রমাণ। শুধু ভোলা, পটুয়াখালী বা সাতক্ষীরা কেন, বাগেরহাটের সর্ব-উত্তরের উপজেলা চিতলমারীতেও এখন হাজার হাজার একর জমি পতিত থাকে লোনা পানি অনুপ্রবেশের কারণে। অথচ এক দশক আগেও এসব মাঠ ভরে থাকত সোনালি ধানে। গোপালগঞ্জ সদরেরও কোনো কোনো এলাকায় জোয়ারের সময় লোনা পানির অনুপ্রবেশ ঘটছে। ক্রমেই এই অনুপ্রবেশ বাড়তে থাকবে। আর এ কারণেই বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া না গেলে উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় দুই কোটি মানুষ আগামী এক-দেড় দশকের মধ্যে জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হতে পারে। অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে উপকূলীয় এলাকার বিশাল পরিমাণ আবাদি জমি আবাদযোগ্যতা হারাবে। লোকসংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও দেশের খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে। এর ফলে দেশে খাদ্য সংকট ক্রমেই তীব্র হতে থাকবে, যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হবে দেশব্যাপী চরম নৈরাজ্যকর অবস্থা।
গত ২১ মার্চ কালের কণ্ঠে একদিকে যখন উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর ছাপা হয়েছে, তার একদিন পর একই পত্রিকায় চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ফসলের মাঠ ফেটে চৌচির হয়ে থাকার একটি বিশাল ছবি ছাপা হয়েছে। সেখানেও আবাদ সম্ভব নয়। এমনই অবস্থা দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের অনেক স্থানেই। বরেন্দ্র অঞ্চলের অনেক স্থানে এখন গভীর নলকূপ দিয়েও পানি ওঠে না। কারণ, পানির স্তর অনেক নেমে গেছে। বাংলাদেশ পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম ধান উৎপাদনকারী দেশ। আর সেই ধানের বেশির ভাগই হচ্ছে বোরো ধান, যে ধান উৎপাদন করতে প্রচুর সেচ প্রয়োজন হয়। একসময় আমনের প্রাধান্য থাকলেও এখন আউশ ও আমন উৎপাদনের পরিমাণ খুবই কম। তার প্রধান কারণ বন্যা সমস্যা। শুধু আউশ-আমন নয়, গত মৌসুমে আগাম বন্যায় হাওরাঞ্চলে বোরো ধানেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমাদের অনেক নদী নাব্যতা হারিয়ে মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে। অনেক নদী মৃতপ্রায়। ফলে উজান থেকে যখন পাহাড়ি ঢল নেমে আসে, তখন নদীগুলো সেই পানি ধারণ করতে পারে না। সৃষ্টি হয় বন্যা। নদীর ভাঙনও এতে তীব্রতর হয়। ফলে প্রতিবছর ফসল হারিয়ে, ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে মানুষ।
এসব কারণে বোরো চাষাবাদই একমাত্র বিকল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর বোরো জমিতে সেচ দিতে গিয়ে প্রচুর গভীর-অগভীর নলকূপ বসাতে হচ্ছে। আশির দশকের শুরুতেও যেখানে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের মাধ্যমে সেচের পরিমাণ ছিল মাত্র ৬ শতাংশ, তা এখন ৭৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ফলে ভূগর্ভে পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। এর ফলে বর্তমান গভীর নলকূপেও পানি উঠবে না। তখন মাটির আরো গভীরে নলকূপ স্থাপন করতে হবে। রাজধানীতে দৈনিক ২০০ কোটি লিটারের মতো পানি সরবরাহ করে ওয়াসা, কিন্তু তার পরও পানির জন্য হাহাকার লেগেই থাকে। এখানেও ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হয় প্রায় ৮৫ শতাংশ। কিন্তু নদী-খাল, বিল-ঝিল ইত্যাদি ভরাট বা শুকিয়ে যাওয়ায় ভূগর্ভে পর্যাপ্ত পানি প্রবেশ করতে পারে না। রাজধানীর উপরিভাগ ইট-সিমেন্ট দিয়ে ঢেকে ফেলায় এখানে পানি প্রবেশের তো কোনো সুযোগই নেই। ফলে এখানে প্রতিবছর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর তিন মিটারের বেশি নিচে নেমে যাচ্ছে। আর তার ওপর তৈরি হচ্ছে শূন্যস্থান। ফলে ভূমিকম্পের সময় উপরিভাগের মাটি ধসে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। মাটি যদি ধসে যায়, তাহলে তার ওপরের স্থাপনা যত মজবুতই হোক, তার টিকে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম।
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মৎস্যবহুল এলাকা হিসেবে বাংলাদেশের একসময় যথেষ্ট সুনাম ছিল। আজ এর উল্টো চিত্রই আমরা দেখতে পাই। মাছে-ভাতে বাঙালির পাতে এখন মাছ খুব কমই জোটে। জীব ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের দিক থেকেও বাংলাদেশের যথেষ্ট সুনাম ছিল। সে সুনামও অনেক আগেই নষ্ট হয়েছে। বনাঞ্চল প্রায় উজাড় হয়ে এসেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশের মানুষ একসময় নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অঙ্েিজনের অভাবেই মারা যাবে। এখনই তার কিছু নমুনা বড় শহরগুলোয় লক্ষ করা যায়।
এমনিভাবে নানা দিক দিয়ে কী ভয়ংকর বিপদ যে ধেয়ে আসছে_দেশের বেশির ভাগ মানুষই তা নিয়ে ভাবিত নয়। ভাবনার অভাব আছে রাষ্ট্রযন্ত্রেরও। উপকূলীয় এলাকার দুই কোটি মানুষ কোথায় যাবে? রাজধানীসহ বড় শহরগুলোয় এসে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করবে। তখন সেই শহরগুলোয় যে কী ধরনের মানবিক বিপর্যয় ঘটবে তা এখন কল্পনা করাও দুরূহ। অথচ সেই বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি আমরা নিচ্ছি না বললেই চলে। জলবায়ু পরিবর্তন বা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কোনোটাকেই আমরা ঠেকাতে পারব না। কিন্তু আমাদের উপকূলীয় জনপদগুলো যাতে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার ব্যবস্থা আমরা করতে পারি। আবাদি জমিগুলোকে লোনা পানির গ্রাস থেকে রক্ষা করার উদ্যোগ নিতে পারি। লোনা পানিসহিষ্ণু চাষাবাদ উদ্ভাবনে আমাদের গবেষকদের আরো বেশি করে কাজে লাগাতে পারি। আমাদের চিংড়ি চাষ এখনো মান্ধাতা আমলের। ফলে একরপ্রতি যে উৎপাদন, তা আশপাশের দেশগুলো থেকেও অনেক কম। সেখানে আমরা নিবিড় চিংড়ি চাষের ব্যবস্থা করতে পারি। বড় জলোচ্ছ্বাসের সময় মানুষ যাতে জীবন রক্ষা করতে পারে, তাদের গবাদি পশু, সহায়-সম্পদ রক্ষা করতে পারে, তার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। যথেষ্ট পরিমাণে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে। এ ছাড়া ভাসমান শাকসবজি চাষ, কৃষির বিকল্প হিসেবে হাঁসের খামার গড়ে তোলা_অর্থাৎ জীবনযাত্রার বিকল্প উপায় তাদের কাছে তুলে ধরতে হবে। লোনা পানিসহিষ্ণু উদ্ভিদ দিয়ে পুরো উপকূলে রক্ষা বেষ্টনী গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু সেসবের প্রায় কিছুই হচ্ছে না।
যে মানুষ বা যে জাতি একটু দূরবর্তী চিন্তা করতে পারে, ভবিষ্যৎ বিবেচনায় নিয়ে উন্নয়ন করতে পারে_তারাই টিকে থাকতে পারে। কিন্তু আমরা তা পারছি বলে মনে হয় না। অথচ টিকে থাকতে হলে ২০, ৩০ কিংবা ৫০ বছর পরের চিন্তা থেকে এখনই কাজ শুরু করা দরকার।

লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.