গ্রন্থজগৎ-নতুন ধরনের বই, নতুন পাঠক by সৈয়দ আলী আহসান

সামনের দিনগুলোতে শরীরী স্পর্শে বইয়ের স্বাদ কেমন করে নেওয়া সম্ভব হবে? প্রযুক্তির দৌরাত্ম্যে মিউজিক অ্যালবাম যেমন গ্রন্থিমুক্ত হয়েছে, প্রযুক্তি কি একইভাবে বইকে বাঁধনমুক্ত করবে? বই বলতে আর কী বোঝাবে? এ সবকিছুই কি পাঠাভ্যাসকে পাল্টে ফেলবে?


আমেরিকা-ইউরোপজুড়ে কিন্ডল, সনি রিডার, নোক, আইপ্যাডসহ প্রায় ৩০ রকমের ই-রিডার বা বৈদ্যুতিন পঠনযন্ত্রের জয়জয়কার। বিষয়টা ভাবনার; বইপোকারা কোথায় ঠাঁই নেবে তবে? তাদের আয়েশি ভোজনের দিন কি তবে শেষ? নাকি নতুন কোনো আয়েশের সন্ধান পাওয়া গেল?
মানসভোজীদের জন্য এখন দার্শনিক ও বাণিজ্যিক বিষয় বিবেচনায় কিছু প্রশ্ন সংগত কারণেই সামনে চলে আসছে। সামনের দিনগুলোতে শরীরী স্পর্শে বইয়ের স্বাদ কেমন করে নেওয়া সম্ভব হবে? প্রযুক্তির দৌরাত্ম্যে মিউজিক অ্যালবাম যেমন গ্রন্থিমুক্ত হয়েছে, প্রযুক্তি কি একইভাবে বইকে বাঁধনমুক্ত করবে? বই বলতে আর কী বোঝাবে? এ সবকিছুই কি পাঠাভ্যাসকে পাল্টে ফেলবে? পরিবর্তনের এ সুড়ঙ্গপথের অপর প্রান্তে কি সূর্যের আলোকরেখা, নাকি ধেয়ে আসা মূর্তিমান কোনো রেলগাড়ি? প্রচলিত বইয়ের সঙ্গে ডিজিটাল বইয়ের পার্থক্য কোথায়? পল লেভিন নামের এক মার্কিন সাহিত্যিক একটা সাদৃশ্য টেনেছেন_ ঘোড়ার গাড়ির সঙ্গে আধুনিক রহঃবৎহধষ পড়সনঁংঃরড়হ বহমরহব-এর তুলনা করলে যেমন মনে হয়, সনাতন ধারার প্রকাশনার সঙ্গে বৈদ্যুতিন বই বা ই-বুকের অবস্থাটাও ঠিক তেমনই।
বিশ্বে এ মুহূর্তে সবচেয়ে শক্তিশালী সার্চ ইঞ্জিন গুগলের জন্য পৃথিবীর নানা জায়গায় গোপনে-গহনে নানা মানুষ নানা প্রক্রিয়া-পদ্ধতি প্রয়োগ করে ই-বুক রূপান্তরের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ইয়াহু বা মাইক্রোসফটের মতো ইন্টারনেট জায়ান্টরা এ কাজে গুগলের চেয়ে অনেক পেছনে। গুগলের ব্যাপারটা কেউ খোলসা না করলেও তথ্যসূত্রভিত্তিক অনুমিতি বলছে, ফেলে-ছুড়ে দিলেও বছরে প্রায় ১ কোটি বই শুধু গুগলই বৈদ্যুতিন মাধ্যমে রূপান্তর করছে। এসব প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, অনেক প্রকাশনা সংস্থাও এ কাজে সমান উৎসাহে নেমেছে। কথা হলো, এত বইয়ের চেহারা পরিবর্তন হচ্ছে, কে আর এর স্বাদ নিতে বসে আছে?
বিশ্বকোষের ছাপা বইয়ের বাজার ইতিমধ্যে উইকিপিডিয়া দখল করেছে। যেসব বই মানুষ জীবনে পড়ে না বললেই চলে কিংবা যেসব বইয়ের তথ্য সচরাচর হালনাগাদ করতে হয় সেগুলোর অস্তিত্ব আর থাকবে কি-না সন্দেহ! টেলিফোন নির্দেশিকা, অভিধান, রন্ধন-প্রণালির বই, এমনকি পাঠ্যপুস্তকও তাদের চিরাচরিত অবয়বমুক্ত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পেঁৗছেছে। গবেষণা সহায়ক বিধায় চিন্তাশীল বইয়ের ভবিতব্যও ওই পথে। কল্প-কাহিনী বা উপন্যাস, কবিতা প্রাতিস্বিক উপভোগ্য বিধায় নতুন ধারার পাশাপাশি সনাতন ধারায় টিকে থাকার একটা ক্ষীণ আশা তবু থেকে যায়।
এই দোলাচলের মধ্যে গত বছর অনুষ্ঠিত হয়েছিল লন্ডন বইমেলা। বইয়ের ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব, মেলার স্থান ইত্যাদি নিয়ে ছিল আশঙ্কা। এ আশঙ্কার পেছনে কারণ ছিল দুটি 'ব' শব্দের (ব-ঢ়ঁনষরংযরহম, ব-ৎবঃধরষরহম) ঝনঝনানি। নতুন সম্ভাবনা আর সুযোগের কথা বলে অভিজ্ঞজন আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন উপস্থিত অন্য সবাইকে। কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন সেমিনারের আলোচ্য বিষয় ছিল ছাপা বই আর স্বাধীন পুস্তক ব্যবসায়ীদের ভবিতব্য নিয়ে। অবশেষে ই-বুকের অস্তিত্ব এখন বাস্তবতা। মেলায় অংশ নেওয়া তিন ভাগের এক ভাগ প্রকাশক জানিয়েছেন, আগামী বছর তাদের বই থেকে যে আয় হবে তার শতকরা ১০ ভাগ আসবে ই-বুক থেকে। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে এর মধ্যে আমেরিকায় শতকরা ১০ ভাগ বাজার ই-বুকের দখলে চলে এসেছে। দেশটির ই-বুক পাঠকের সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৪ কোটি। যাদের মধ্যে এমনসব খোট্টা পাঠক আছেন যারা বছরে অন্তত গড়ে ১২টির বেশি বই কেনেন। ব্রিটেনে ছাপা বইয়ের পড়তির কথা কেউ কেউ বললেও এখনও ই-বুক বিক্রির পরিমাণ শতকরা পাঁচ ভাগের ওপরে ওঠেনি। তবে অবস্থাগতিকে মনে হয়, ই-বুকের বাজার অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। কেননা আমেরিকা আজ যা করে অন্যান্য অনেক দেশ আগামীকাল তা করতে বাধ্য হয়। ছাপা বইয়ের কারবারে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে তাতে বলা হচ্ছে, ব্রিটেনের অনেক শহরেই বইয়ের কোনো দোকান খুঁজে পাওয়া যাবে না।
লন্ডন বইমেলায় যারা হাজির হয়েছিলেন, থিম কান্ট্রি রাশিয়ার থেকেও তাদের আগ্রহ ছিল ডিজিটাল প্যাভিলিয়নের দিকে। মাল্টিমিডিয়ার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে লাখ লাখ পাঠক বাড়ানোর স্বপ্ন দেখছে বৈদ্যুতিন মাধ্যমের প্রকাশকরা। অসধুড়হ.পড়স বলছে, গত বছরে দ্বিতীয় তিন মাসে প্রতি ১০০ হার্ড-কভার বইয়ের বিপরীতে তারা ১৪৩টি ই-বুক বিক্রি করেছে, অ্যাপল আইপড বিক্রি করেছে বিশ্বব্যাপী ৩.২৫ মিলিয়নের বেশি। ধারণা করা হচ্ছে, ২০১৫ সালের মধ্যে রূপান্তরিত বই পাঠকের সংখ্যা চারগুণ বৃদ্ধি পাবে। লক্ষণ সুস্পষ্ট, ইউনিভার্সিটি অব এনএসডবি্লউ, স্টানফোর্ড ইউনিভার্সিটি তাদের লাইব্রেরি থেকে সব জার্নাল, বিশ্বকোষ, অভিধান ইত্যাদি ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে শুরু করেছে। স্থান সংকুলান, বহনযোগ্যতা, অর্থ সাশ্রয় ইত্যাদি সুবিধা থাকা সত্ত্বেও মেধাস্বত্ব চুরি হওয়ার আশঙ্কায় কতটুকু লাভজনক হবে এ রূপান্তরিত মাধ্যম, তাও বিবেচনায় আনতে হচ্ছে। ছাপা বই আর রূপান্তরিত বইয়ের মূল্যগত পার্থক্য পাইরেসির কারণে শেষ পর্যন্ত রূপান্তরিত বইয়ের দাম শূন্যে নেমে এলে অবাক হওয়ার মতো কিছু থাকবে না। কিন্ডল শব্দের আভিধানিক অর্থ জাগ্রত করা, উজ্জীবিত করা। ই-রিডারের মধ্যে কিন্ডলের নামটাই সার্থক। দৌড়ে কিন্ডলই এগিয়ে। তবে যারা সাধারণ পাঠক, তারা চাইবে তাড়াবিহীন সুখপাঠ। প্রচলিত ধারায় বিচ্ছেদ হলেও বই টিকে থাকবে। বইয়ের শত্রুর কোনো কমতি নেই। বই বরাবরই কারও কাছে দ্যুতিময় হীরা, কারও কাছে প্রভাহীন নুড়ি। বই কোনো হাতিয়ার নয়, চিন্তাধারা প্রকাশের কোনো আবশ্যিক উপায় নয়। বই হলো আমরা যা অনুভব করি তার স্মারক।

সৈয়দ আলী আহসান : সিনিয়র সহকারী সচিব
ahsan.ex@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.