ওদের জাগরণেই আমাদের মঙ্গল by ড. মুহাম্মদ আশকার ইবনে শাইখ

এ প্রজন্মের যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, তাঁদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এখন আর অজানা নয়। দুঃখজনক কিন্তু সত্য, হীনস্বার্থবাদী মহল এ প্রজন্মকে নানাভাবে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে, তাঁদের সামনে ভুল তথ্য উপস্থাপন করেছে, নানাভাবে তাঁদের অচেতন করে রাখার চেষ্টা হয়েছে।


কিন্তু এত কিছুর পরও বলা যায়, তাঁদের শেষ পর্যন্ত বিভ্রান্ত করা যায়নি, তাঁরা অত্যন্ত ঘৃণাভরেই ওই হীনস্বার্থবাদী ও স্বাধীনতার শত্রুদের প্রত্যাখ্যান করেছেন। এ বিষয় নিশ্চয়ই আমাদের কাছে অনেক বড় এবং জাতি হিসেবে দেশপ্রেমবোধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ ধারণ করে এগিয়ে যাওয়ার বড় শক্তি। যদি আমাদের প্রগতিশীল রাজনীতিকরা এ শক্তি কাজে লাগাতে পারেন, তবে আমাদের এগিয়ে যাওয়া দুরূহ নয়। স্বাধীনতা-উত্তর এই চার দশকে স্বাধীন-সার্বভৌম রক্তস্নাত বাংলাদেশে একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা দেশটিকে আবার পাকিস্তানি মোড়কে মুড়ে ফেলার কম অপচেষ্টা করেনি। তবে আশার কথা, এই প্রজন্মের বলিষ্ঠ অংশগ্রহণে তা প্রতিহত করা গেছে অনেকাংশে।
দেশে বিলম্বে হলেও শুরু হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া। কাজটি অত্যন্ত কঠিন, কথাটা সমস্যাসংকুল। তবুও আমরা আশাবাদী প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে সরকার প্রগতিবাদী শক্তির সহায়তায় আইনি পন্থায় দীর্ঘদিনের জনদাবির অবসান ঘটাতে সক্ষম হবে। বিএনপিতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন, এটা সত্য। কিন্তু তাঁদের আজকের কর্মকাণ্ড কি কোনোভাবেই সাক্ষ্য বহন করে যে তাঁরা একদিন এ দেশের মুক্তির জন্য যুদ্ধ করেছেন! বড় দুঃখ হয় তাঁদের নৈতিকতার পতন দেখে। এত স্ববিরোধিতা নিয়ে রাজনীতি মনে হয় একমাত্র বাংলাদেশেই সম্ভব। কয়েক দিন আগে এই প্রবাসে একজন তরুণের সঙ্গে আমার পরিচয় হলো একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে। তিনি এখানে পড়াশোনার পাশাপাশি কিছু আয়-রোজগারও করছেন। অত্যন্ত বিনয়ী ও দৃঢ়চেতা এই তরুণের কথা আমার চিরদিন মনে থাকবে। তিনি একপর্যায়ে আমাকে বললেন, 'আমি যখন বড় হয়ে শুনেছি, আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শিবিরে ছিলেন, সেদিন থেকেই তাঁর প্রতি আমার ঘৃণা জন্মে গেছে। আমি মনে মনে বহু চেষ্টা করেছি আমার জন্মদাতাকে ক্ষমা করে দিতে, কিন্তু পারিনি। আমার এও ইচ্ছা, তাঁর সঙ্গে যেন আমাকে বাকি জীবন কাটাতে না হয়। আমি এই তরুণের ছলছল প্রতিবাদী দুটো চোখে যে দ্যুতি দেখেছি, তা আমৃত্যু স্মরণ রাখতে বাধ্য।' সংগত কারণেই তাঁর নাম-পরিচয় এখানে তুলে ধরতে পারিনি, কিন্তু পাঠক এঁরাই তো প্রজন্মের যোগ্য প্রতিনিধি। আমি বিশ্বাস করি, এঁদের সংখ্যা এ সমাজে আজ কম নয়। আমার কাছে এ তরুণটি স্বাধীনতার ৪০ বছরের বড় একটি প্রাপ্তি। ওঁদের জাগরণেই আমাদের মুক্তি ও মঙ্গল।
স্বাধীনতার ৪০ বছর পর খুব জোর নিয়েই বলতে চাই, আমরা হেরে যাইনি। সে অর্থে আমাদের মুক্তি হয়তো আসেনি; কিন্তু আমরা তো যুদ্ধজয়ী জাতি। মুক্তি বলতে অর্থনৈতিকসহ সামাজিক নানা উৎপীড়ন-সমস্যা থেকে আমরা এখনো মুক্তি পাইনি; কিন্তু তাই বলে আমাদের স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধ তো ব্যর্থ হয়ে যায়নি। যেটুকু হওয়ার, পাওয়ার কথা ছিল তা না হলে, না পেলেও হতাশ হওয়ার কিছু নেই।
প্রজন্ম জেগেছে নবপ্রত্যয়ে_এটিই বড় কথা, বড় প্রাপ্তি। এই প্রজন্মই আমাদের সব ব্যর্থতার দাগ মুছে দেবে_এমন আশা অবশ্যই দুরাশা নয়। আমি সামান্য একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সংগত কারণেই বিষয়টি অনেক বড় করে দেখি। স্বাধীনতা অর্জনের চার দশক পর যখন প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব অনেকেই মেলাতে যাবেন, তাঁদের কাছে সবিনয় অনুরোধ, হতাশ হয়ে অপশক্তিকে উৎসাহী করবেন না। এ দেশ আমাদের রক্তমূল্যে অর্জিত। গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি স্বাধীনতার সব শহীদ ও বীর সৈনিককে, যাঁদের ত্যাগে-রক্তে, দিকনির্দেশনায় বিশ্ব মানচিত্রে আমাদের এ জাতিরাষ্ট্র জায়গা জুড়ে আছে।

লেখক : লন্ডনপ্রবাসী গণমাধ্যম গবেষক

No comments

Powered by Blogger.