গ্যাসের দাম বাড়িয়ে তা বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি হিসেবে দেওয়ার নজিরবিহীন উদ্যোগ-তীব্র অর্থসংকটে বিদ্যুৎ খাত by অরুণ কর্মকার

নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ও বিদ্যমান কেন্দ্রগুলো পরিচালনায় অর্থসংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। সংকট মোকাবিলায় সব শ্রেণীর গ্রাহকের গ্যাসের দাম বাড়িয়ে বাড়তি অর্থের সংস্থান করে তা বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি হিসেবে দেওয়ার এক নজিরবিহীন উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।


এদিকে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র (আইপিপি) স্থাপনে বেসরকারি উদ্যোক্তারা ব্যাংকঋণ পাচ্ছেন না। তাঁরা বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি আনার জন্য ঋণপত্র খুলতে পারছেন না। একক গ্রাহককে দেওয়া ব্যাংকের ঋণসীমা (এক্সপোজার লিমিট) সংক্রান্ত জটিলতার কারণে কোনো ব্যাংক এসব উদ্যোক্তার অনুকূলে ঋণপত্র খুলছে না।
বিদ্যুৎ খাতের এই জটিল সমস্যা নিয়ে আগামী মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের নীতিনির্ধারকদের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে প্রশাসনিক নির্দেশনার মাধ্যমে এসব সমস্যা নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাইবেন নীতিনির্ধারকেরা। সরকারের সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
সূত্রগুলো জানায়, দেশের কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ না পাওয়া এবং ঋণপত্র খুলতে না পারার কারণে ১১টি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের (আইপিপি) নির্মাণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। মোট ৮০৩ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার এই কেন্দ্রগুলো আগামী এক বছরের মধ্যে চালু হওয়ার কথা। বর্তমান সরকারের সময় নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের যে ৫২টি চুক্তি হয়েছে, এগুলোও তার মধ্যেকার।
এ ছাড়া বেসরকারি খাতের তিনটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র—বিবিয়ানা-১ ও ২ এবং মেঘনাঘাট-২ সময়মতো নির্মাণের কাজও অর্থসংকটে অনিশ্চয়তায় পড়েছে। বিশ্বব্যাংক সরকারকে ঋণ দিতে গড়িমসি করায় এই অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। এই তিনটি কেন্দ্রের মোট উৎপাদন ক্ষমতা এক হাজার ১৭ মেগাওয়াট। আগামী বছরের শেষ নাগাদ এই কেন্দ্রগুলো পর্যায়ক্রমে চালু হওয়ার কথা ছিল।
নজিরবিহীন উদ্যোগ: যেখানে গ্যাস খাতের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্যই প্রয়োজনীয় অর্থ এই খাতে নেই, সেখানে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে সেখান থেকে পাওয়া বাড়তি অর্থ বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দেওয়ার মতো উদ্যোগ আগে কখনো দেখা যায়নি। সর্বোপরি এই উদ্যোগ সম্পর্কে জ্বালানি বিভাগ কিছু জানে না বলে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান।
তাঁদের অজান্তে একই মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগ প্রধানমন্ত্রীর জন্য যে কার্যপত্র তৈরি করেছে তাতে বলা হয়েছে, ‘গ্যাস সাধারণ মানুষের সম্পদ। গ্যাসের মূল্য জ্বালানি তেল এবং এলএনজি থেকে অনেক কম। এর মূল্যবৃদ্ধির কারণে গ্যাস কোম্পানিকে লাভ না দিয়ে সাধারণ মানুষের কল্যাণে তা ব্যবহার করা সমীচীন। সে কারণে আবাসিক, শিল্প, বাণিজ্য, যানবাহন ইত্যাদিতে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এই অতিরিক্ত অর্থ বিদ্যুৎ খাতে দেওয়া যেতে পারে।’
কিন্তু গ্যাসের দাম বাড়ানোর ব্যাপারে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের নির্দেশনা হচ্ছে—বাড়তি দাম থেকে অর্থ জমা হবে গ্যাস উন্নয়ন খাতে। ওই খাত থেকে গ্যাস খাত উন্নয়নের কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। ইতিমধ্যে ওই খাতে প্রায় এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা জমা আছে। আর ২০১২-১৩ অর্থবছরে গ্যাস খাতের উন্নয়ন কার্যক্রমে ব্যয় হবে এক হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা।
ওই বছর গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে নতুন জমা হবে ৬০০ কোটি টাকা। আর ২০১৩-১৪ অর্থবছরে গ্যাস খাতের যে উন্নয়ন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে তাতে ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৭২ কোটি টাকা। কাজেই গ্যাসের দাম বাড়িয়ে পাওয়া অর্থ বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি হিসেবে দিলে গ্যাস খাতের উন্নয়ন ব্যাহত হবে।
আগামী বছরের প্রস্তাবিত বাজেটেও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি চলতি বছরের তুলনায় কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। জ্বালানি বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, তেল-গ্যাসের দাম বাড়ানোর সরকারি পরিকল্পনার কারণে এই খাতে ভর্তুকির পরিমাণ কমানো হয়তো ঠিক আছে। কিন্তু এ খাতে উন্নয়নের যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে সে অনুযায়ী উন্নয়ন বরাদ্দও দেওয়া হয়নি। ফলে জ্বালানি খাতের উন্নয়ন কার্যক্রমে অর্থসংকট দেখা দেবে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ঋণ: প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপনের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগের কার্যপত্রে বলা হয়েছে, ‘বেসরকারি খাতে ১৪টি আইপিপি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে বৃহৎ আইপিপি বিবিয়ানা-১ ও ২ এবং মেঘনাঘাট ফেইজ-২-এর উদ্যোক্তা সামিট গ্রুপ এখন পর্যন্ত অর্থের সংস্থান (ফিন্যান্সিয়াল ক্লোজিং) করতে পারেনি। বিশ্বব্যাংক ঋণ প্রদানে গড়িমসি করায় এক হাজার ১৭ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এই প্রকল্পের অর্থের সংস্থান হচ্ছে না।’
কার্যপত্রে আরও বলা হয়, ৮০৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১১টি আইপিপি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্যোক্তারা দীর্ঘদিন চেষ্টা চালিয়েও কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ পাচ্ছেন না। বৈদেশিক মুদ্রার ঋণসীমা-সংক্রান্ত জটিলতার কারণে তাঁরা ঋণপত্রও খুলতে পারছেন না। চুক্তি অনুসারে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ২০১৩ সালের জুন মাসের মধ্যে উৎপাদন শুরুর জন্য নির্ধারিত আছে। ব্যাংকগুলো সাধারণ লেনদেনে তারল্য সংকটে ভুগছে বলে অনুমিত হয়।
তা ছাড়া বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সরকার বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফিন্যান্স ফান্ড (বিআইএফএফ) গঠন করে এবং এই তহবিলে বিগত দুই বছরে এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত এ তহবিল থেকে কোনো ঋণ দেওয়া হয়নি বলেও কার্যপত্রে বলা হয়।
সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেঘনাঘাট কেন্দ্রটির কাজ আমরা নিজস্ব অর্থায়নেই শুরু করেছি। এটি নির্ধারিত সময়ের আগেই, আগামী বছরের আগস্টে উৎপাদনে আসবে।’ তিনি বলেন, ‘তিনটি কেন্দ্রের জন্যই বিআইএফএফ এবং ইডকল থেকে অর্থায়ন আশা করা হয়েছিল। আশা করি অতি সত্বর তারা অর্থায়ন করবে। সেই সঙ্গে অন্য উৎস থেকে সংগ্রহ করা অর্থে সময়মতোই আমরা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কাজ শেষ করতে পারব।’
আগামী এক বছরের মধ্যে যে আইপিপিগুলো উৎপাদনে আসার কথা সেগুলো হচ্ছে: চট্টগ্রাম ৫০ মেগাওয়াট, বসিলা ১০৮ মেগাওয়াট, গাবতলী ১০৮ মেগাওয়াট, পতেঙ্গা ১০৮ মেগাওয়াট, জামালপুর ৯৫ মেগাওয়াট, খুলনা ৯৯ মেগাওয়াট, নাটোর ৫২ মেগাওয়াট, বসিলায় আরেকটি ১০৮ মেগাওয়াট, কুমিল্লার হোমনায় ৫৩ মেগাওয়াট, মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টিতে ১০৮ মেগাওয়াট এবং ময়মনসিংহের ফুলপুরে দেশের প্রথম সোলার থার্মাল বিদ্যুৎকেন্দ্র।

No comments

Powered by Blogger.