ফিলিস্তিন-যুক্তরাষ্ট্রের অদ্ভুত মধ্যপ্রাচ্য সম্মেলন by আলেকজান্ডার ককবার্ন

ওবামার মধ্যস্থতায় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট আব্বাসের মধ্যকার বৈঠকের আলোচ্যসূচি দেখে না হেসে পারা যায় না। মার্কিন পরিকল্পনা হলো, ওবামা নেতানিয়াহু ও আব্বাসকে জানিয়ে দেবেন যে শান্তির বন্দোবস্তের জন্য এটাই শেষ সময়।
যুক্তরাষ্ট্র এক বছরের মধ্যে দুই শত্রুর মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হতে দেখতে চায়।
এবারের আলোচ্য বিষয় ছিল: অবৈধ ইহুদি বসতি নির্মাণ, পূর্ব জেরুজালেমের ভবিষ্যৎ, ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবাসন এবং ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের সীমান্ত চূড়ান্তকরণ।
নেতানিয়াহু ও আব্বাসকে অভ্যর্থনা করেছেন যিনি, তিনি আর পরিবর্তনের ধ্বজাধারী নন। কায়রোয় মুসলমানদের উদ্দেশে বক্তৃতা দিয়ে তিনি সাড়া তুলেছিলেন এবং শত বছর ধরে চলা মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতের ন্যায্য মীমাংসার মঞ্চ তৈরির ভার দিয়েছিলেন জর্জ মিটসেলের ওপর। সেই ওবামার বর্তমান রাজনৈতিক হাল শোচনীয়। অর্থনীতির মন্দা আরও গভীর হচ্ছে। মধ্যবর্তী নির্বাচনে তাঁর দল সম্ভবত কংগ্রেসের দুটি কক্ষ না হলেও অন্তত একটি হারাতে যাচ্ছে। ইসরায়েল লবিও ভালো করেই জানে, ওবামার ডেমোক্রেটিক পার্টির ইহুদি অর্থ ও ভোট খুবই প্রয়োজন। ইসরায়েলের স্বার্থ বিষয়ে মার্কিন কংগ্রেস সর্বদাই ওই লবির আদেশে চলে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন নেতানিয়াহুকে যেসব প্রশংসাসূচক সম্ভাষণ করেছেন, তাতে মনে হয়, ভবিষ্যতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য ইসরায়েল লবির কাছে চাঁদার জন্য তদবির করছেন।
অথচ চার মাস আগে এ মার্কিন প্রশাসনই ইসরায়েলের অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনের সমালোচনা করেছিল, মার্কিন উপরাষ্ট্রপতি বাইডেনও তেল আবিবকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ইসরায়েলের একগুঁয়েমিপনার জন্য ওই অঞ্চলে মার্কিন নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। নেতানিয়াহুকে সেসব কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার কথা এবার কেউ ভাবল না।
ইসরায়েল লবিও পাল্টা আঘাত করেছিল। জুলাই মাসে ওয়াশিংটন পোস্ট-এ ডানা মিলবানকে লেখেন, ‘ব্লেয়ার হাউসে (প্রেসিডেন্টের অতিথি ভবন) নীল-সাদা ইসরায়েলি পতাকা ঝুলছে। হোয়াইট হাউসে তারা ও ডোরা-আঁকা মার্কিন পতাকা যেখানে থাকার কথা, সেখানেই আছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ওবামার সঙ্গে বৈঠকের সত্যিকার তাৎপর্য বোঝাতে হোয়াইট হাউস কর্মকর্তাদের উচিত ছিল, সেখানে আত্মসমর্পণের সাদা পতাকা ঝোলানো।’
এবং এ ত্রিপক্ষীয় সম্মেলনে ওবামা সত্যি সত্যিই ফিলিস্তিনি ভূমিতে অবৈধ ইসরায়েলি বসতি স্থাপন বিষয়ে আগে বলা ‘বন্ধ করা’ শব্দের জায়গায় ‘বিরত থাকা’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। নেতানিয়াহুর মুখপত্র গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী খুশি। কারণ, তাঁর কথামতো আলোচনা নিঃশর্তভাবেই হয়েছে।’ মাহমুদ আব্বাস এর আগে শান্তি আলোচনার আগে শর্ত হিসেবে অবৈধ বসতি স্থাপন বন্ধ করার দাবি করেছিলেন। নেতানিয়াহু এ দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি সংবাদপত্রে বলেছেন, ‘আমি ইংরেজি বুঝি—restraint আর freez দুটি ভিন্ন শব্দ।’
তাহলে বাকি রইল আলোচনার অন্য দুটি বিষয়: জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী করা এবং ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন। নেতানিয়াহু স্পষ্টভাবে এসব বিষয়ে আলোচনায় আপত্তি জানান। তিন নেতার করমর্দনের কয়েক ঘণ্টা আগে ইসরায়েলের ইহুদি বসতকারেরা বলেছে, ২৬ সেপ্টেম্বর সরকারি নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হওয়া মাত্রই তারা নতুন আরও ৮০টি বসতিতে ভবন নির্মাণ শুরু করবে।
আজকের ইসরায়েলি রাজনীতি সরাসরি বসতি স্থাপন বন্ধ কিংবা সীমান্ত নির্ধারণে ছাড় দেওয়ার বিষয়ে একদম কঠোর। ইতিমধ্যে ফিলিস্তিনকে টুকরা টুকরা করে দেয়াল ও হাইওয়ে দিয়ে ঘিরে ফেলা সারা। ছিন্নবিচ্ছিন্ন ফিলিস্তিনের বিভিন্ন অংশের মধ্যে যোগাযোগের পথগুলো ইসরায়েলিদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে। সব চেক পয়েন্ট আসলে ফিলিস্তিনিদের হয়রানির কেন্দ্র। আর যে পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের সম্ভাব্য রাজধানী করার কথা, সেটি অব্যাহত বসতি স্থাপনে বেদখল হওয়ার পথে। ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আভিগদর লিবারম্যান সম্মেলনে থাকতে রাজি হননি। তিনি চান, নেতানিয়াহু সরাসরি ওবামাকে বলে দিন যেকোনো বাধানিষেধ না মেনে ফিলিস্তিনি ভূমিতে বসতি স্থাপন অব্যাহতই থাকবে।
এদিকে শান্তি আলোচনার অপর পক্ষ আব্বাস নিজেই আর ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট নন। তাঁর পক্ষে ফিলিস্তিনি জনগণের থেকে কোনো গণতান্ত্রিক সমর্থন নেই। নির্বাচনে আব্বাসের দল পরাজিত হয়েছে এবং জয়ী হয়েছে হামাস। অথচ হামাস নেতৃত্বাধীন সরকারকে উচ্ছেদ করে আমেরিকা ও ইসরায়েল আব্বাসকে ক্ষমতায় বসিয়ে রেখেছে অর্থ আর গায়ের জোরে। চার ইসরায়েলি বসতকারীকে হত্যার মাধ্যমে শান্তি আলোচনা বিষয়ে হামাস তার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দিয়েছে।
বসতি স্থাপনে বর্তমান নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ ফুরানো মাত্রই ইসরায়েল আবার ঘরবাড়ি বানানো শুরু করবে। এবং তখন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, আব্বাসকেও শান্তি আলোচনা থেকে সরে আসতে হবে। ফলে আগের সব শান্তি উদ্যোগের মতোই এ শান্তি আলোচনাও ভেস্তে যাবে। তাহলে কেন ওবামা এমন উদ্যোগ নিতে গেলেন? এ বিষয়ে ব্লানকফোর্ট লিখেছেন, ‘নিক্সনের সময় থেকে যে যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কৌশলগত কারণে ইসরায়েলি দখলদারির অবসানের চেষ্টা করেছেন, তাঁদের সবাই-ই প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলি লবির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, কিন্তু পরিণামে সবাই ইসরায়েলি চাপের কাছে নতি স্বীকার করেছেন। নিজেদের রাজনৈতিক পুঁজি ব্যবহারে তাঁরা ব্যর্থ অথবা অনিচ্ছুক হয়েছেন। প্রতিবারই কংগ্রেস ইসরায়েলের পক্ষে দাঁড়িয়েছে, ওবামার সময়েও তাই দাঁড়াবে। যে তিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইসরায়েলকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, ফোর্ড, কার্টার ও সিনিয়র বুশ, তাঁরা তিনজনই বাধ্য হয়েছেন পিছু হটতে এবং নির্বাচনে হয়েছেন পরাজিত।’
এসব জেনেও ওবামা কেন এ পথে পা বাড়ালেন? ধারণা করা হয় যে আমেরিকার ইউরোপীয় মিত্রদের থেকে এবার চাপ ছিল। ব্লানকফোর্ট লিখেছেন, ‘ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত ইউরোপীয় সমাজগুলোর নিরাপত্তায় গোলমাল লাগিয়ে দিয়েছে, যেটা মার্কিন সমাজে হয়নি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বহুদিন থেকেই নিজস্ব ‘শান্তি উদ্যোগ’ শুরু করতে চাইছে। তার আগে তারা চায়, আমেরিকা মাঠ ছেড়ে দিক। ইসরায়েলি লবি এটাকেই সবচেয়ে ভয় পায়। সে জন্যই তারা ওবামাকে দিয়ে শান্তির উদ্যোগ শুরু করিয়েছে, যদিও তারা জানে, এটা ব্যর্থ হতে বাধ্য।’
এভাবেই তারা ইসরায়েলকে অনন্ত ছাড় দিয়ে চলেছে, আর ফিলিস্তিনিদের প্রতি মশকরা করে বলছে, আশা ছেড়ো না। আসলে তারা বলতে চাইছে, ‘হোয়াইট হাউসে তোমাদের কোনো আশা নেই।’
কাউন্টারপাঞ্চ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
আলেকজান্ডার ককবার্ন: মার্কিন সাময়িকী কাউন্টারপাঞ্চ-এর সম্পাদক।

No comments

Powered by Blogger.