নারী মুক্তির সংগ্রাম চলছে by আয়েশা সিদ্দিকা শেলী

বাংলাদেশে নারীর অধঃস্তনতা সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সর্বস্তরে বিদ্যমান। এর প্রধান কারণ পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। রাজনৈতিক টানাপড়েন আমাদের সমাজের বিবর্ণ চিত্র। নারী আন্দোলন সিভিল সমাজের অংশ হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় এটিও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পূর্বশর্ত হিসেবে গণ্য।


রাজনৈতিক টানাপড়েন প্রত্যক্ষভাবে চাপ ফেলে আমাদের সামাজিক জীবনে। এই রাজনৈতিক টানাপড়েন একসময় শেষ হয় সরকার পতন, নতুন সরকার গঠন কিংবা রাজনৈতিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতার পথ ধরে। কিন্তু আমাদের দেশের নারীর আশা ভঙ্গের ইতিহাস শেষ হয় না কোনো দিনও। সাধারণ মানুষের মতো ভাগ্য পরিবর্তনের খোলা হাওয়া নারীর জীবনে কখনো আসে না। সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার অধিকার নারীর কখনো ছিল না, আজও নেই। ভবিষ্যতে কবে আসবে, তাও কেউ বলতে পারে না। বাংলাদেশের সামাজিক আন্দোলনে নারীর অধঃস্তনতা এবং প্রান্তিক অবস্থানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন নারী সংগঠন ও এনজিও কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সমানাধিকার এবং আইনের চোখে মানুষ হিসেবে সুবিচার পাওয়ার আশায় যুগে যুগে নারীরা আন্দোলন করেছে। নারীদের চলমান আন্দোলনের ফলে ঈপ্সিত ফল না পাওয়া গেলেও নারীর অবস্থান উন্নয়নে কিছু কিছু পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। নারীর সপক্ষে বিভিন্ন আইনও বিভিন্ন সময় প্রণীত হয়েছে। কিন্তু এসব আইন সত্যিই কতটা সার্থক হয়ে উঠেছে, আমাদের সমাজে নারীর জীবনে তা দেখার বিষয়। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় আইনে নারীর পক্ষে যেসব আইন তৈরি হয়েছে, বাস্তব ক্ষেত্রে এসব আইনের সুফল এ দেশের নারীরা পায়নি।
এ দেশে বেগম রোকেয়া সর্বপ্রথম বলেছিলেন, 'কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিত করিয়া কার্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও। নিজের অন্ন-বস্ত্র নিজেরাই উপার্জন করুক।' সচেতন নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠা আর সংগ্রামের ইতিহাস অনেক পুরনো। নারীর অর্গল ভাঙার কাহিনী কখনো, কোনোকালেই সহজ ছিল না। বেগম রোকেয়ার সময় এবং বর্তমান সময়ের মধ্যে যদিও অনেক পার্থক্য, এর পরও প্রতিক্রিয়াশীল সমাজের অনড় প্রাচীর, পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর সুকঠিন স্থবিরত্ব যুগে যুগে মেয়েদের হেরে যেতে বাধ্য করেছে। সচেতন নারী কালের পরিক্রমায় এই প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে মাথা উঁচু করে উঠে দাঁড়াতে চেয়েছে। পায়ের নিচের মাটি শক্ত করতে চেয়েছে। লড়াই করে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছে মনুষ্যত্বের স্বীকৃতি। বাংলাদেশের নারীরা আজ সমাজে প্রায় প্রতিটি কর্মক্ষেত্রেই নিজেদের উপস্থিত করেছে। এর পরও দেখা যায়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আইনগত ও সামাজিক অনেক বিষয়েই নারী পশ্চাৎপদ। বাংলাদেশে নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠা এবং আত্মমর্যাদার ইতিহাস খুঁজতে গেলে উল্লেখ করতে হয় সেসব নারীর কথা, যাঁরা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। জীবনযুদ্ধের কষ্টিপাথরে যাচাই করা সেসব নারী মুক্তিযোদ্ধা ছিনিয়ে এনেছিলেন নারীর সম্মানের অধিকার আর নারীর সমান অধিকার।
আমরা আজ সেই গৌরবময় নারীর উত্তরাধিকার। কিন্তু নারীর জীবনে সেই গৌরবময় সত্যের প্রতিফলন আজও ঘটেনি। সংবিধানের অধিকারগুলো কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে, অর্থহীন হয়ে পড়েছে সিভিল সমাজে নারীর একটি অংশ। সিভিল সমাজে নারীর সেই অংশ জানে, স্বাধীনতা মানে আর্থিক স্বাধীনতা, স্বাধীনতা মানে উপার্জনের অধিকার। সংবিধানের চোখে নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এর পরও কি আমাদের সমাজব্যবস্থা নারীদের সেই অধিকার দিয়েছে? নারীর বড় পরিচয়, তিনি একজন নারী। তিনি একজন মানুষ_এই পরিচয়টি নিতান্তই গৌণ হয়ে আছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। নারীকে অপমানিত করা হয় শারীরিকভাবে, মানসিকভাবে। আজ নারীরা যখন মনে করছে, তারা সত্যিই এগিয়ে এসেছে, তখনো আমরা পত্রিকার পাতায় চোখ মেলে দেখি, ইভ টিজিংয়ের মতো যন্ত্রণার ছোবলে নারীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। স্বামীর হাতে স্ত্রী খুনসহ পারিবারিক নানামুখী নির্যাতন চলছে। কর্মক্ষেত্রে প্রতিটি নারী, এমনকি আইনের রক্ষক নারীরাও তাঁর পুরুষ সহকর্মীর কাছে হয়ে উঠেছেন শুধু একজন মেয়েমানুষ। কেন? বাংলাদেশের সমাজে জীবিকার কোনো ক্ষেত্রেই নারীরা পিছিয়ে নেই। এর পরও কি একজন নারী আর একজন পুরুষ একই সুবিধার অধিকারী? আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য, আর্থিক নিরাপত্তা কি মেয়েদের পূর্ণ মানুষের মর্যাদা এনে দিতে পেরেছে? এই দোষ কার? এই দোষ আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর মধ্যে বেড়ে ওঠা আজকের নারীরা এক মানসিক জড়ত্বের বিকলাঙ্গ উত্তরাধিকারী। অনেক নারী আজ একুশ শতকের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়েও পুরুষের হাত ধরে চৌকাঠ পেরোতেই অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। নারীদের এই পরনির্ভরশীলতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোরই দান। অনেক অগ্রগতি সত্ত্বেও আজও তার সত্যিকার মুক্তি ঘটেনি, তার মানসিক জড়ত্বের মুক্তি ঘটেনি। আজকের নারী সাজ-পোশাকে, আচার-বিচারে চূড়ান্ত আধুনিক করতে গিয়ে নিজেকে করে তুলেছে পণ্য, বিজ্ঞাপনের সামগ্রী। খুব দূরের কথা নয়, সেদিন পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে গিয়ে নারী হয়ে উঠেছিল অনেক বেশি প্রতিবাদী। আর একাত্তরে নারী নিজের জীবন তুচ্ছ করে, নিরাপত্তাকে অগ্রাহ্য করে বেছে নিয়েছিল সংগ্রামী-বিপ্লবী জীবন। সেদিন নারী ঘর ছেড়েছিল, প্রতিবাদে মুখর হয়েছিল, ভয় পায়নি জীবনের ঠুনকো সম্মানের। কিন্তু আজকের যুবশক্তি, তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরীরা হারিয়ে ফেলেছে প্রতিবাদের ভাষা। আজকের নারী একবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে নেহাত বিজ্ঞাপনের পণ্য! প্রতিবাদের কথা ভুলে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে, লড়াই করার পরিবর্তে আত্মবলি দিচ্ছে।
এর পরও স্বপ্নমুখর নারীর স্বপ্ন দেখা থেমে থাকে না। নিজস্বতা হারানো, মূল্যবোধ হারানো, কৃত্রিমতার স্রোতে গা ভাসানো, পণ্যমনস্ক নারীর ধ্বংসস্তূপ থেকে হয়তো বা একদিন ফিনিঙ্ পাখির মতো জেগে উঠবে নতুন নারী, নতুন মানুষ। আধুনিক সমাজের গড্ডালিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে সেই নারী মনুষ্যত্বের কথা ভাববে। নিজস্ব ভাবনায় গড়ে তুলবে একটি আলাদা ভুবন। ব্যক্তিত্বশীল নারী এগিয়ে চলেছে একক প্রচেষ্টায়। সমষ্টিগত আন্দোলনের পথে না গেলেও নানাভাবে এগিয়ে আসছে তারা। এক বুক আশায় বুক বাঁধি হয়তো বা একদিন একক থেকে জন্ম হবে সমষ্টির। নারী তার নিজস্ব প্রয়োজনে ঘুণে ধরা সমাজের পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোটিকে বদলে দেবে। প্রতিবাদী নারীরা থেমে থাকবে না। তারা এগিয়ে চলবে। প্রতিটি নারীর আ@ি@@@ক চেতনায় ভবিষ্যতের মুক্তির প্রতিচ্ছবি রচিত হবে।

লেখক : উপ-কর কমিশনার, কর অঞ্চল-৫, ঢাকা

No comments

Powered by Blogger.