পাকিস্তান :সংসদ বনাম আদালত by রাজা আসগর

প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিকে মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের অযোগ্য ঘোষণা করাটা সংসদের প্রতি আঘাতস্বরূপ। কারণ সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য গিলানির প্রতি তাদের আস্থা ব্যক্ত করেছিলেন। এটাকে সংসদের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগের এক ধরনের 'ক্যু' বলা চলে।


ফলে পাকিস্তান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ল এবং এ ঘটনা আগামী নির্বাচন পর্যন্ত আরও তিক্ত রাজনৈতিক নাটকের জন্ম দেবে। তবে সংসদের শ্রেষ্ঠত্বের অতীত ঘোষণায় আবদ্ধ না থেকে বাস্তব রাজনীতি বিবেচনা করে ক্ষমতাসীন জোট এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবে বলে আশা করা যায়।
এখন ক্ষমতাসীন পিপলস পার্টি ও তাদের জোট শরিকদের প্রধান কাজ একজন নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করা (যেটা তারা ইতিমধ্যেই করেছে বলে জানা গেছে)। ক্ষমতাসীন জোটের এখন সংসদের উভয় কক্ষেই দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য রয়েছে। গিলানিকে আদালত অবমাননার অভিযোগে প্রতীকী সাজা দেওয়ার কারণে তাকে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের অযোগ্য ঘোষণা ইতিমধ্যেই বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। আগামী দিনগুলোতে সংসদের ভেতরে ও বাইরে রাস্তায় এ ঘটনা নিশ্চয়ই উত্তাপ ছড়াবে।
এক মাসেরও কম সময় আগে জাতীয় সংসদের স্পিকার তার রুলিংয়ের মাধ্যমে সংসদের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করেছিলেন। তিনি তার রুলিংয়ের মাধ্যমে আদালত অবমাননা মামলায় শাস্তি হওয়ার কারণে প্রধানমন্ত্রী গিলানি অযোগ্য হয়ে যাননি বলেছিলেন। মাত্র কয়েকদিন আগে সংসদে নওয়াজ শরিফের মুসলিম লীগের বিরোধিতা সত্ত্বেও স্পিকারের রুলিংকে অপরিবর্তনীয় বলে প্রস্তাব পাস করেছিল। কিন্তু স্পিকারের এই রুলিংকে প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যের বেঞ্চ 'আনডান' করে দিয়েছেন। আদালত এ ব্যাপারে তাদের সংক্ষিপ্ত আদেশে বলেছেন, স্পিকারের ২৫ মের আদেশে 'এর পর্যবেক্ষণ থেকে বিরত রাখা হয়নি' বিধায় বিচারপতিরা একে খারিজ করছেন।
এই আদেশ দেশের আরেকজন প্রসিদ্ধ স্পিকার মৌলভী তমিজউদ্দিন খানের আইনি লড়াইয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। পাকিস্তানের প্রথম দিকে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ১৯৫৪ সালের শাসনতন্ত্র প্রণয়নকারী সংসদ বাতিল করেন। গভর্নর জেনারেলের ওই 'সাংবিধানিক 'ক্যু' তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ মুনীর অনুমোদন করেন। এর মাধ্যমে তখন সংসদের সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করা হয়।
আরও ধারণা করা যায়, এই রায় প্রধান বিচারপতির ছেলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ও একজন 'প্রপার্টি টাইকুন' এবং কতিপয় বেসরকারি টিভি চ্যানেলের ভূমিকার ওপর থেকে জনগণের দৃষ্টিকে সরিয়ে নেবে।
সরকারের আইনি বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো, সংবিধানের অষ্টাদশ সংশোধনীর ফলে এখন আর স্পিকার ও সিনেট চেয়ারম্যান শুধু অতীতের মতো পোস্টবক্সের ভূমিকা পালনকারী মাত্র তা নয়। আদালত রায় দিলেই তারা এ ব্যাপারে নোটিফিকেশনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে বলবেন তাও কিন্তু নয়। তার আগে একজন পদাধিকারীর পদ থাকা উচিত কি উচিত নয় সে প্রশ্ন তো সংসদে আসতে হবে।
ক্ষমতাসীন জোট তাদের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে নতুন মেয়াদের দশ মাস আগে ক্ষমতা ও সংসদ সদস্যপদ থেকে বিদায় নেওয়ায় নিশ্চয়ই হতাশ। তবে তারা এ কারণে নতজানু হবেন তা কিন্তু মনে হচ্ছে না। তারা নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের মাধ্যমে কিছুটা ঝুঁকি নেওয়ার পথ বেছে নিয়েছেন। কারণ, নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর তার ওপরও আদালতের একই আদেশ আসতে পারে। নওয়াজ শরিফের মুসলিম লীগ যেভাবে এ বিষয়টি নিয়ে আদাজল খেয়ে লেগে রয়েছে এবং এ নিয়ে ইতিমধ্যে যে ধরনের রাজনৈতিক উত্তেজনা দেখা দিয়েছে তাতে নতুন প্রধানমন্ত্রীও একই অযোগ্যতার খাড়ায় পড়তে পারেন।
গিলানি গত এপ্রিলে সুপ্রিম কোর্টের সাত সদস্যের বেঞ্চ কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হয়ে প্রতীকী সাজা পেয়েছিলেন। প্রেসিডেন্টের সাংবিধানিক রক্ষাকবচ থাকা অবস্থায় তিনি তা করতে পারেন না বলে যুক্তি দেখান।
নতুন প্রধানমন্ত্রীও গিলানির মতো এ ব্যাপারে একই পন্থা অনুসরণ করবেন বলেই ধারণা করা যায়। ১৯৯০-এর দিকে নওয়াজ শরিফ ও বেনজির ভুট্টো তথা পিপিপি ও মুসলিম লীগের মধ্যে প্রচণ্ড রাজনৈতিক উত্তেজনা বিরাজ করছিল। তখন ক্ষমতায় ছিলেন নওয়াজ। তার আমলে বেনজির ভুট্টো ও তার স্বামী আসিফ আলি জারদারির বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের মামলাটি হয়। অবশ্য পরে ২০০৭ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল মোশাররফ ন্যাশনাল রিকনসিলেশন অর্ডিন্যান্সের আওতায় তাদের মামলা থেকে অব্যাহতির ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ২০০৯ সালে বর্তমান সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিল করে দেন।

ডন থেকে ভাষান্তর সুভাষ সাহা
 

No comments

Powered by Blogger.