স্মরণ-রুদ্র: তোমাকে আজ বেশি প্রয়োজন by সুমেল সারাফাত

আজ ২১ জুন। রুদ্র, ১৯৯১ সালের এই দিনে চমৎকার এক ভোরে তুমি আমাদের সবাইকে রেখে চলে গিয়েছিলে না-ফেরার দেশে। তোমার পরম স্নেহময়ী মা, তোমার বোন তোমার মুখ সাদা কাপড় দিয়ে কিছুতেই ঢাকতে দিচ্ছিলেন না। কারণ, তুমি তো মরতে পারো না। তুমি ঘুমাতে পারো, কিন্তু মৃত্যু যে তোমাকে মানায় না।
এত প্রাণ, এত উদ্দামতা, এত গতিময়তা, এত দ্রোহ নিয়ে তুমি কীভাবে ঘুমিয়ে থাকবে? মাত্র ৩৪ বছর কি চলে যাওয়ার বয়স?
সমাজের সব বৈষম্য, শোষণ, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা আর সব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে আমৃত্যু তোমার কলম চলেছে। যখন কলম রেখে সশরীরে উপস্থিতির প্রয়োজন, তখন তুমি বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে হাজির প্রতিবাদের মঞ্চে। অন্য অনেকের সঙ্গে তোমার পার্থক্য এখানেই। আমার গর্ব হয়, তুমি আমার ভাই বলে।
অন্যায়ের সঙ্গে আপস তোমার ধাতে ছিল না। সেই তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকে তা শুরু। তোমার নানার নামে স্কুলটিতে তোমার বাবা ছিলেন ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি। বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় আবৃত্তিতে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলে তুমি। কিন্তু বাবা তোমার পুরস্কার দ্বিতীয় স্থান অধিকারীকে আর তোমাকে দ্বিতীয় স্থানের পুরস্কার দিলে তুমি পুরস্কার গ্রহণ না করে বাড়ি এসে মাকে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলে, বাবা তোমার প্রতি অবিচার করেছেন। তোমার যোগ্যতা দিয়ে তুমি প্রথম, বাবার সভাপতিত্বের জোরে নয়। পরে বাবা ভুল বুঝতে পেরে তোমাকে প্রথম পুরস্কারের মতো অনুরূপ আরেকটি পুরস্কার এনে দিয়েছিলেন। কিন্তু তুমি আর সেই পুরস্কার গ্রহণ করোনি। সেই শুরু।
ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় তুমি মাত্র ১৩ বছরের কিশোর। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কর্মসূচিতে তুমি নিয়মিতভাবে অংশগ্রহণ করেছ। হরতাল, মিছিল আর মিটিংয়ে তুমি সামনের কাতারে। মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হলো, তখন তুমি নবম শ্রেণীর ছাত্র। যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য তুমি অস্থির হয়ে আছ। সেই সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তার অপরাধে তোমার চিকিৎসক বাবাকে পাকিস্তান নৌবাহিনী তুলে নিয়ে নির্মম অত্যাচার করে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে আটকে রাখল। তার পরও তুমি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য মায়ের কাছে অনেক অনুনয়-বিনয় করলে। কিন্তু এ রকম পরিস্থিতিতে স্নেহময়ী মা তাঁর প্রথম সন্তানকে কিছুতেই যুদ্ধে যেতে দিলেন না।
বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়া, যুদ্ধে যেতে না-পারার বেদনা, সেই সঙ্গে চারপাশের নৃশংস ধ্বংসযজ্ঞ, দেশব্যাপী পৈশাচিক হত্যা-নির্যাতন তোমার ভাবনা-জগৎকে তুমুলভাবে আন্দোলিত করে। বাবার ইচ্ছা ছিল, তুমি চিকিৎসক হবে। তোমারও বাবার স্বপ্নপূরণের ইচ্ছা ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীন বাংলাদেশ তোমার স্বপ্নের পটভূমি বদলে দিল। তুমি হাতে তুলে নিলে স্বপ্নবান অস্ত্র, ‘কবিতা’, নিজেকে চেনালে ‘শব্দ-শ্রমিক’ হিসেবে।
সমাজে বিদ্যমান অসাম্য, শোষণ, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তোমার শিল্পিত উচ্চারণ দিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যে তুমি সাধারণ পাঠকের হূদয়ে স্থান করে নিলে। সিরাজ শিকদার, বঙ্গবন্ধু, কর্নেল তাহের, চার নেতাসহ সব নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তোমার কলম গর্জে উঠল। তুমি লিখলে, ‘থামাও, থামাও এই মর্মঘাতী করুণ বিনাশ,/ এই ঘোর অপচয় রোধ করো হত্যার প্লাবন’। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর সপরিবারের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের পর স্বাধীনতাবিরোধীদের উত্থানে তুমি লিখলে সেই কালজয়ী পঙিক্ত, ‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরনো শকুন’।
স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আবার তোমার কলম গর্জে উঠল। সশস্ত্র বাহিনীকে উদ্দেশ করে তুমি লিখলে, ‘দাঁড়াও নিজেকে প্রশ্ন করো—কোন পক্ষে যাবে?/ একদিকে বিত্তবান, অন্যদিকে বিত্তহীন ক্ষুুধার্ত সমাজ। ইতিহাস সাক্ষী দ্যাখো, অনিবার্য এ-লড়াই—কোন পক্ষে যাবে?’ কবিতার পাশাপাশি তুমি আবারও রাজপথে নেমে এলে। সব মিছিল, মিটিং, সংগ্রামে তুমি সামনের কাতারে। নূর হোসেনের হত্যার পর তুমি লিখলে, ‘হাজার মৃত্যু দিয়ে গড়া ঘরখানির ভিত,/ আজো তবু সব মানুষের রক্তে কেন শীত!/ বুলেট এবং বুটের মুখে খুঁজতে থাকে আপোষের আরাম।/ নূর হোসেনের রক্তে লেখা আন্দোলনের নাম’। ময়মনসিংহে কবিতা পাঠের আসর থেকে তোমাকে গ্রেপ্তারের জন্য গোয়েন্দা পুলিশ পাঠানো হলো। সেদিন সেই কবিতা পাঠের আসরে তোমার ভক্তরা ঘোষণা করল, সাহস থাকলে তাদের সামনে থেকে রুদ্রকে ধরে নিয়ে যাক। পুলিশ সে সাহস দেখাতে পারল না।
সমমনা কবি, শিল্পী, অভিনেতা, আবৃত্তিকার ও ছাত্রনেতাদের সঙ্গে নিয়ে শুরু হলো তোমার সংগ্রামী সাংস্কৃতিক জোট গড়ার উদ্যোগ। তোমরা সফল হলে। পরবর্তী সময়ে যা রূপান্তরিত হলো সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটে। স্বৈরাচার শাসকের এশীয় কবিতা উৎসবের বিরুদ্ধে কবিদের একত্র করে শুরু করলে জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠনের কাজ। ১৯৮৭ সালে তোমার লেখা গান হলো প্রথম জাতীয় কবিতা উৎসবের উদ্বোধনী সংগীত। তুমি লিখলে, ‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্যে কবিতা আজ, ছিঁড়ে ফেলে লাবণ্য লালিমা, হয়ে ওঠে সুতীক্ষ হাতিয়ার’।
তুমি অসীম সাহসী ছিলে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে কোনো শক্তির ভয়ে কখনো তুমি পিছু হটোনি। ১৯৮৬ সালে গ্রিন রোডের একটি রেস্তোরাঁয় কয়েকজন মুক্তিযুদ্ধবিরোধীর সঙ্গে তুমি একা লড়াই করেছিলে। তারা সেখানে একজন কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীর গুণগান করছিল। তুমি সেই টেবিলের সামনে গিয়ে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলে। তারা সংখ্যায় ৮-১০ জনের মতো ছিল। আর তুমি একা। দুদিন পর মাথায় দুইটা সেলাই নিয়ে তুমি বাসায় এসেছিলে। তারা মেরে তোমার মাথা রক্তাক্ত করেছিল। কিন্তু তোমাকে দমাতে পারেনি। এরপর আরেক দিন পশ্চিম রাজাবাজারের রাস্তায় একটি ওয়াজ মাহফিলের প্রচারে আরও একজন কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীর নাম মাইকে প্রচার করতে থাকলে তুমি রাস্তায় নেমে সেই মাইক বন্ধ করে দিয়েছিলে।
আজ আমরা ‘ভুল মানুষের কাছে নতজানু’ হয়ে আছি। ব্যক্তিগত স্বার্থ যেখানে বিপন্ন হতে পারে, সেখানে অন্যায় দেখেও আমরা উটপাখির মতো মুখ ঘুরিয়ে রাখি। আমরা মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়েছি। আমরা যখন চরম অস্থির একটা সময় পার করছি, তখন তোমার কথা বড় বেশি মনে পড়ে।
সুমেল সারাফাত

No comments

Powered by Blogger.