নাগরিক ভাবনা-আমরা অসন্তুষ্ট by শাহদীন মালিক

এ লেখার দায়ভার ৩০ অক্টোবর প্রথম আলোর ১৯ পৃষ্ঠার খবর, যার শিরোনাম ‘শহীদ রুমীর আদর্শ ছড়িয়ে দিতে হবে’। ‘মুক্তিযোদ্ধা রুমীকে নিয়ে প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন’ অনুষ্ঠানের খবররুমীকে মারার আগে কত নির্যাতন করেছে, কত কষ্ট দিয়েছে, সেটা কখনো চিন্তা করতে চাই না—তাই চার দশক ধরে রুমীকে দূরে সরিয়ে রেখেছি।


দুজনেই হাফপ্যান্ট পরা, দুজনের হাতে বিরাট বন্দুক, আমাদের থেকেও বড়। সুন্দরবনের গাছগাছালির মাঝে দাঁড়িয়ে ছবি। আমাদের বয়স তখন বোধহয় ১০ কি ১১। ছোটবেলার অ্যালবাম বহু আগেই পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। ছবিটা নেই, ছোট্ট একটা স্মৃতি আছে।
যত দূর মনে পড়ে, ১৯৬৮ সাল। সবে আবার ঢাকায় এসেছি। রুমী ধরে নিয়ে গেল পুরানা পল্টনের ন্যাশনাল স্পোর্টস ট্রেনিং সেন্টারে। ওখানে কিছুদিন ধরে জুডো ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা হয়েছে। রুমী প্রথম থেকেই ছিল। যখন আমাকে নিয়ে গেল, তত দিনে সে গ্রিনবেল্ট পেয়ে গেছে, অর্থাৎ বেশ পারদর্শী। আমার মতো একেবারে আনকোরা নতুনদের কিছু কিছু প্রশিক্ষণ দেওয়ারও আন-অফিশিয়াল দায়িত্বও ছিল তাঁর।
এর আগে মফস্বল থেকে ঢাকায় এলে দু-এক রাত রুমীদের এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় থেকেছি। তৃতীয় তলায় একটা ‘জিম’ ছিল।
ফাস্ট ফরওয়ার্ড—নব্বইয়ের দশকে জাহানারা চাচি যখন যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি তোলেন, তখন লন্ডনে থাকি। খবর রাখতাম, তবে তখন তো এত ই-মেইল, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন হয়নি। ঢাকার সব পত্রিকা নিয়মিত পাওয়া যেত না। প্রতি রোববার ব্রিকলেন থেকে লন্ডনের দুটি বাংলা সাপ্তাহিক কিনতাম। সাপ্তাহিক দুটি পুরো সপ্তাহের ঢাকার খবরের সারাংশ দিত।
জাহানারা ইমামের আন্দোলনকে আওয়ামী লীগ সমর্থন দিয়েও দেয়নি। যত দূর মনে পড়ে, আবদুর রাজ্জাক ছাড়া আওয়ামী লীগের অন্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের অবস্থান ছিল—ধরি মাছ না ছুঁই পানি।
তখন লন্ডনে বসে মনে হয়েছিল, আওয়ামী লীগ পূর্ণ সমর্থন দিলে আওয়ামী লীগের সমর্থনের ওপর ভর করে দেশের রাজনৈতিকভাবে সচেতন মধ্যবিত্তের নেতৃত্ব চলে যাবে যুদ্ধাপরাধীদের যারা বিচার চাইছে, তাদের হাতে।
২০০৮-এর সাধারণ নির্বাচনে মধ্যবিত্ত বা প্রায় মধ্যবিত্ত তরুণ যুবসমাজের সমর্থন আওয়ামী লীগের বিরাট বিজয়ের অন্যতম প্রধান কারণ। আর এই সমর্থনের পেছনে যুদ্ধাপরাধের বিচারের আকাঙ্ক্ষা ছিল অন্যতম প্রধান নিয়ামক।
২০০৭-০৮ সালে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম যুদ্ধাপরাধের বিচারের যে দাবি তুলেছিল, সেই দাবির প্রতি তরুণসমাজের সমর্থন নৌকার বাক্সে এত বিপুল ভোট পড়ার একটা অন্যতম প্রধান কারণ ছিল।
এই সমর্থনে চিড় ধরেছে। শুধু ‘বিচার হচ্ছে’ ‘বিচার হচ্ছে’ যত বেশি দিন বলা হবে, তত বেশি সমর্থনটা আস্তে আস্তে ম্লান হয়ে যাবে।
দ্রুত বিচার না হলে আগামী জানুয়ারিতে বর্তমান সরকারের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে পত্রিকাগুলো যে জরিপ চালাবে, তাতে সরকারের চেহারার সৌন্দর্য আর ঔজ্জ্বল্যে বিরাট কালো ছায়া পড়বে।

২.
বছর খানেক আগের কথা। ছাত্রীটির আইন পড়া শেষ হয়েছে, অর্থাৎ ডিগ্রি পেয়েছে। ১৫ দিনের মাথায়ই মহা উৎসাহে তার উত্তরার বাসা থেকে পুরান ঢাকার জজকোর্টে যাওয়া শুরু করল। সাড়ে সাতটায় বাসা থেকে বেরিয়ে নয়টা নাগাদ কোর্টে পৌঁছে যায়। কষ্ট হলেও লেগে থাকো—উৎসাহ দিলাম।
ছয় মাস পর—স্যার, সাতটায় বেরিয়ে কোর্টে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ১০টা বেজে যায়। সিনিয়রের জন্য এই কোর্ট, ওই কোর্টে আমাদের যত দৌড়াদৌড়ি, সেটা ১০টার আগেই সারতে হয়। সময়মতো কোর্টে পৌঁছাতে পারি না।
গত সপ্তাহে আবার কথা হলো। জানলাম বেশ কয়েক দিন সকাল সাড়ে ছয়টায় ঘর থেকে বেরিয়ে চেষ্টা করেছে। যাওয়া-আসায় প্রতিদিন ঘণ্টা ছয়েক বা অন্তত পাঁচ ঘণ্টা ব্যয় করে কুলিয়ে উঠতে পারছিল না। ছেড়েছুড়ে এখন কোর্সে ভর্তি হয়েছে।
কথাটা নিঃসন্দেহে নতুন কিছু না। পত্রপত্রিকায় আর সন্ধ্যায় টেলিভিশনের খবরে ঘুরেফিরে খবরগুলো এখন অতি চেনা—যানজট। নতুন যোগ হয়েছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম এখন প্রায় ১০ ঘণ্টার পথ। ষাটের দশকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে মেঘনা-দাউদকান্দিসহ ফেরি বড় দুটি, আর আরও ছোট দুটি—চার ফেরি পার হয়েও সময় লাগত এ রকমই—১০-১১ ঘণ্টা।
বিদ্যুৎ নেই, গ্যাস নেই; আছে হানাহানি, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি আর অনিয়ম।
প্রথম দিকে কথায় কথায় ডিজিটাল। তারপর যা প্রায় একসঙ্গেই ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারির পিলখানা হত্যাযজ্ঞের পর মাস তিনেক চলল—জঙ্গি, জেএমবি। এখন চলছে যুদ্ধাপরাধী। মানব ইতিহাসের ভয়ংকর, বীভৎস ও ভয়াল হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য জনা বিশেক লোকই মনে হচ্ছে যথেষ্ট। তিনজনের একটা ট্রাইব্যুনাল, গোটা ছয়েক আইনজীবী আর ডজন খানেক তদন্তকারী।
এতটাই ত্যক্ত-বিরক্ত যে আজকাল খোঁজখবর রাখার তাগিদও অনুভব করি না। শ দুয়েক দক্ষ লোক কি নিয়োগ করা যায় না? আর সরকার যদি আশঙ্কা করে যে সারা দেশে বিশ্বাস করা ও আস্থা রাখার মতো তার ২০০ লোকও নেই, তাহলে এর থেকে বড় দুর্ভাগ্যজনক আর কী হতে পারে।

৩.
এবার আসল কথায় আসি। এক দলের নেতাদের কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করলে আমাদের নির্ঘাত ভাবতে হবে যে অন্য দলের নেতা-কর্মীরা সব জঘন্য ও ঘৃণ্যতম খুনি-অপরাধী-দুর্নীতিবাজ। তারা হাজার হাজার লোক খুন করেছে ও করছে। যেমন শেখ হাসিনা গত বিএনপি টার্মে ডজন ডজন বক্তৃতায় বলেছিলেন এবং এখনো মাঝে মাঝে বলেন, বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগের ২১ হাজার নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। ২১ হাজার হত্যার জন্য অন্তত ২১ জনের তো বিচার হওয়া উচিত ছিল। বিশেষত, অভিযোগকারী এখন তো প্রধানমন্ত্রী।
অন্যদিকের বক্তব্য, খুন-জখমের সঙ্গে আরও কিছু চমকদার বাড়তি অভিযোগ থাকে। বিদেশি প্রভু, দেশ বিক্রি করে দেওয়া এবং আমাদের ‘অমুসলিম’ বানানো।
টিআইবি দুর্নীতি-ধারণার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান যদি কোনো দেশের দায়িত্বশীল নেতারা সবচেয়ে বেশি দায়িত্বহীন আর আজগুবি কথা বলেন, সে সম্পর্কে একটা জরিপ চালায় তাহলে আমরা জোর-প্রতিযোগিতা করতে পারব। ফার্স্ট না হলেও নির্ঘাত ফার্স্ট ক্লাস পাব।
বাড়ি ছাড়ব না আর ওনারা দুর্নীতি করেননি—এ রাজনীতি শেষ প্রায়। অথবা সব দোষ আগের সরকারের—ধোপে আর টিকবে না। রাজনীতিবিদদের ওপর আমরা আস্থা হারাচ্ছি আর সে কারণে আমরা অসন্তুষ্ট। নতুন রাজনীতির সময় চলে এসেছে।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হচ্ছে না। স্পষ্টতই কোনো বড় রাজনৈতিক দল থেকে নির্বাচন করার চাপ নেই। অন্তত সরকারি দল থেকে তো মোটেও চাপ নেই। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারি দলের আগ্রহ থাকলে ঢাকার ওয়ার্ডগুলোর সীমানা পুনর্নির্ধারণ এক মাসেই সম্ভব। বলে রাখা দরকার যে, সংসদ নির্বাচনে সীমানা নির্ধারণ করা নির্বাচন কমিশনের কাজ। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ঢাকা সিটি করপোরেশন, অর্থাৎ সব স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য সীমানা নির্ধারণের দায়িত্ব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ওপর। মন্ত্রণালয় সীমানা নির্ধারণ না করলে নির্বাচন কমিশনের কিছুই করার নেই—সরকারকে তাগাদা দেওয়া ছাড়া।
স্পষ্টত ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদপ্রার্থী হওয়ার মতো জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো প্রার্থী কোনো বড় দলেরই নেই। থাকলে নির্বাচন অনেক আগেই হয়ে যেত।
দুই দলই জানে, তাদের যাঁরা নেতা অর্থাৎ সম্ভাব্য প্রার্থীরা ভোট পাবেন—এ নিশ্চয়তা তাদের নেই। অর্থাৎ আমরা যে অসন্তুষ্ট, সেটা তারাও জানে।
গত প্রায় ৬০ বছরে এ দেশে যতগুলো নির্বাচন ঠিকঠাকভাবে হয়েছে, তার সব কটির ফলাফলই ছিল অপ্রত্যাশিত। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের ছয় মাস আগেও কেউ ভাবেনি যে যুক্তফ্রন্ট ৯০ শতাংশের বেশি আসন পাবে। ১৯৭০-এর নির্বাচনের তিন মাস আগেও কেউ একইভাবে চিন্তা করেনি যে আওয়ামী লীগ এত বড় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। একইভাবে ২০০৮-এর ডিসেম্বরের প্রথম দিকে কি কেউ ধারণা করতে পেরেছিল যে বর্তমান মহাজোট সরকারের দলগুলো আড়াই শর বেশি আসন পাবে? দিন বদলাচ্ছে। তবে রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে ভাবছে, সেভাবে না। রাজনৈতিক দলগুলো পেছনে পড়ে যাচ্ছে। আমরা ক্রমাগত এবং দ্রুতগতিতে বর্বরতাকে পেছনে ফেলে সভ্য হচ্ছি। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো ক্রমান্বয়ে পিছু হটছে। বর্বরতার দিকে যাচ্ছে। দু-তিন দশক আগে দুর্নীতি এতটা অগ্রহণযোগ্য বিষয় ছিল না। এখন দুর্নীতি, বর্বরতা, অক্টোবরে টিআইবি রিপোর্টের দুর্নীতি-সূচকে বাংলাদেশের স্থান যদি বেশ নিচে নেমে যায়, সরকারের পক্ষে সে ধাক্কা সামলানো কঠিন হবে।
একে অপরের ওপর খুন-খারাবির দোষারোপে আপনাদের প্রতি আমাদের আস্থা বা বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ছে না। অতীত নিয়ে আপনাদের বাড়াবাড়িতে আমরা অসন্তুষ্ট। আর আমরা অসন্তুষ্ট আপনাদের নীতিহীনতায়।
যদি কোনো নীতি থাকে, আদর্শ থাকে তাহলে জোর গলায় বলেন, এ দেশে ধর্মই সবচেয়ে বড় নীতি, এ দেশের ধর্ম থাকবে, আমরা ধর্মের রাজনীতি করি। অথবা বলেন, এ দেশের মানুষ সাম্প্রদায়িক না, সাম্প্রদায়িকতা তারা চায় না, চায় সাম্প্রদায়িকতাহীন ধর্মনিরপেক্ষ দেশ।
‘বাঘ এল, বাঘ এল’-এর রাখাল-রাজনীতিতে আমরা অসন্তুষ্ট। আমরা বদলে যাচ্ছি, আপনারাও বদলান।
এ কথা যেমন সত্য যে, বহু বহু লোক অনেক চেষ্টা করেও গত ৬০ বছরে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক দল দাঁড় করাতে পারেননি। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও সত্য যে, এ দেশেই নতুন দল নতুন নেতা তৈরি হতে বেশি সময় লাগেনি, এই কাদামাটির দেশে পিছলাতে সময় লাগে খুবই কম। আর এই কাদামাটি রুমীদের রক্তেও ভেজা।
ড. শাহ্দীন মালিক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট; শিক্ষক, ব্র্যাক স্কুল অব ল।

No comments

Powered by Blogger.