পাকিস্তান-আগাম নির্বাচন, না সেনাশাসন? by সোহরাব হাসান

পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের রায়ে প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি পদচ্যুত হওয়ার পর দেশটির রাজনীতি কোন দিকে মোড় নেয়, সেটাই এখন আলোচনার বিষয়। পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) এ মুহূর্তে আদালতের সঙ্গে বিরোধে না গিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যই যে প্রাণপণ চেষ্টা চালাবে, তা নিশ্চিত।


ইতিমধ্যে দলটি নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মখদুম শাহাবুদ্দিনকে মনোনয়ন দিয়েছে। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের আগামীকাল আহূত অধিবেশনে তাঁর প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হওয়া হয়তো কঠিন হবে না; কিন্তু তাতে সংকট কাটবে কি?
গিলানি সর্বোচ্চ আদালতের যে আদেশ অমান্য করেছেন, সে আদেশ নতুন প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে মান্য করা সম্ভব না হলে তাঁকেও পদচ্যুতির ঝুঁকি নিতে হবে কিংবা গিলানিকে সরিয়ে যদি সুপ্রিম কোর্ট চুপচাপ বসে থাকেন, তাহলে প্রতিষ্ঠানটি গ্রহণযোগ্যতা হারাবেন।
প্রধান বিরোধী দল নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগ ইতিমধ্যে সরকারের পদত্যাগ ও আগাম নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। তার সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন ক্রিকেট তারকা তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টির নেতা ইমরান খান। মূলত তাঁদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্ট ইউসুফ রাজা গিলানিকে পদচ্যুত করেন। পাকিস্তানে সুপ্রিম কোর্ট ও সরকারের মধ্যকার দ্বন্দ্বের আপাতসমাধান হলো গিলানির বিদায়ের মধ্য দিয়ে। এর আগে গত ২৬ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে ৩০ সেকেন্ডের প্রতীকী কারাদণ্ড দিলে তিনি আপিল করা থেকে বিরত থাকেন এ যুক্তিতে যে, তাতে আদালতকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করা হবে। তাঁর সেই আইনি পদক্ষেপ না নেওয়াই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে, না পাকিস্তান আরও বড় সংকটে পড়তে যাচ্ছে—তা কিছুদিনের মধ্যেই পরিষ্কার হবে। মাঝখানে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার ফাহমিদা মির্জা রুলিং দিয়েছিলেন, সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে পদচ্যুত করতে পারেন না।
এখন প্রশ্ন হলো, কয়েক মাস ধরে চলে আসা পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট, সেনাবাহিনী এবং সরকারের মধ্যকার বিরোধ কি গিলানির অপসারণের মধ্য দিয়েই শেষ হবে, নাকি এ বিরোধ আরও বহুদিন চলতে থাকবে? তিন শক্তির মধ্যে সেনাবাহিনী আপাতত পেছনে থাকলেও সুপ্রিম কোর্টের রায় তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করবে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বরাবর দুর্বল সিভিল সরকার চায় এবং সুযোগ পেলেই ক্ষমতা কেড়ে নেয়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী পাকিস্তানি পণ্ডিত আহমেদ রশিদ বলেছেন, এ মুহূর্তে সেনাশাসন জারির সম্ভাবনা নেই। তবে দেশে রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হলে সেনাবাহিনীর ভূমিকাও বিস্তৃত হবে।
বিরোধী দল নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়ে বলেছে, সুপ্রিম কোর্ট প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিকে অযোগ্য ঘোষণা করায় পিপিপি দেশ শাসনের নৈতিক অধিকার হারিয়েছে। তাদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন জোটের যেকোনো শরিক হাত মেলালে পিপিপি সরকারের পতন অনিবার্য।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে গিলানি প্রধানমন্ত্রিত্ব হারালেও তাঁদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু তিনি নন—দেশটির প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি। দুই দশক আগের দুর্নীতির মামলা তাঁকে এখনো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ১৯৯০-এর দশকে জারদারি ও তাঁর প্রয়াত স্ত্রী বেনজির ভুট্টো কিছু কোম্পানিকে কনট্রাক্ট দেওয়ার বিনিময়ে এক কোটি ২০ লাখ ডলার ঘুষ নেওয়ার জন্য সুইস ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেছিলেন বলে অভিযোগ আছে। এ জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে সুইস আদালতে দুর্নীতির মামলাও হয়। যে কারণে বেনজিরকে দীর্ঘদিন নির্বাসনে থাকতে এবং জারদারিকে জেল খাটতে হয়েছিল। ২০০৭ সালে সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফ আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে বেনজিরের সঙ্গে সমঝোতা করেন এবং জাতীয় রিকন্সিলেশনের নামে তাঁদের বিরুদ্ধে আনা সব মামলা প্রত্যাহার করে নেন। একদা মিস্টার টেন পার্সেন্ট হিসেবে পরিচিত জারদারি প্রেসিডেন্ট হয়ে নিজে ফৌজদারি মামলা থেকে দায়মুক্তি নিলেও পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট তা মেনে নেননি। বরং তাঁরা প্রধানমন্ত্রী গিলানিকে নির্দেশ দেন যে, তিনি যেন সুইস আদালতে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার অনুরোধ জানান। কিন্তু গিলানি কীভাবে নিজ দলের নেতা ও নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে এ নির্দেশ মান্য করবেন? ফলে সুপ্রিম কোর্ট তাঁর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ এনে ৩০ সেকেন্ডের প্রতীকী কারাদণ্ড দেন। এই রায়কে অনেকেই জুডিশিয়াল ক্যু বলে অভিহিত করেছেন। ডেইলি টাইমস-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সুইস কর্তৃপক্ষের কাছে মামলা পুনরুজ্জীবিত করার অনুরোধ জানালেও তা রক্ষা করা সম্ভব হতো না; কেননা, সুইস আইন অনুযায়ীই ক্ষমতাসীন কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের বিষয়ে তদন্ত করার সুযোগ নেই।
গতকাল ডেইলি টাইমস-এ সাংবাদিক মুহাম্মদ আকরম এ রায়ের বিরোধিতা করে বলেছেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রটি কীভাবে চলবে তা ঠিক করবে পাকিস্তান পার্লামেন্ট নয়, সুপ্রিম কোর্ট!
প্রশ্ন হলো, আদালত ও সংসদের এই বিরোধ পাকিস্তানকে কোথায় নিয়ে যাবে?
এ মুহূর্তে পাকিস্তান চতুর্মুখী সমস্যায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তালেবান ও আল-কায়েদার আত্মঘাতী হামলা, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিরোধ, জাতিগত দাঙ্গার পাশাপাশি বেলুচিস্তানে গৃহযুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জঙ্গি-তৎপরতা এবং জ্বালানিসংকট দেশটিকে সর্বনাশের কিনারে ঠেলে দিয়েছে। এ অবস্থায় বিরোধী দলের দাবি অনুযায়ী আগাম নির্বাচনের ঝুঁকি জারদারির পক্ষে নেওয়া সম্ভব হবে না বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন।
পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের জারদারির দুর্নীতি তদন্তের জন্য ক্রমাগত চাপ দেওয়ার পেছনে যে মনস্তত্ত্ব কাজ করেছে তা হলো, জারদারিকে দেশবাসী দুর্নীতিবাজ হিসেবেই জানে। আদালতের এ পদক্ষেপে সেনাবাহিনী খুশি হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরে তালেবানি তৎপরতার কারণে সেনাবাহিনী যে চাপের মুখে আছে, তার পাল্টা চাপ দেওয়ার একটা সুযোগ তাদের হাতে এল। এখন জারদারি বা পিপিপি কীভাবে সেই চাপ সামাল দেবে, সেটাই দেখার বিষয়।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.