রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন-যত দেরি হবে, সংকট তত বাড়বে

২০০৫ সালের পর বাংলাদেশ থেকে একজন রোহিঙ্গা শরণার্থীকেও ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত প্রায় ২৯ হাজার রোহিঙ্গাকে জোর করে ফেরত পাঠানোর সুযোগ বাংলাদেশের যেমন নেই, তেমনি নানা অজুহাতে তারাও স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে চায় না। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে,


প্রত্যাবাসন-প্রক্রিয়া শুরু করতে যত দেরি হবে, বাংলাদেশের জন্য সংকট ততই তীব্র হবে। এমনকি বিভিন্ন সময় নতুন করে শরণার্থী নেওয়ার চাপও আসবে বাংলাদেশের ওপর।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক গতকাল বুধবার কালের কণ্ঠকে জানান, সাড়ে চার লাখ থেকে পাঁচ লাখ মিয়ানমারের নাগরিককে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ এরই মধ্যে অনেক বড় সংকটে পড়েছে। এখন আবার নতুন করে শরণার্থী নেওয়ার জন্য সীমান্ত খুলে দিতে বিভিন্ন মহলের চাপ রয়েছে। নতুন করে শরণার্থী নিলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না।
ওই কূটনীতিক আরো জানান, গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মিয়ানমার সফরের আগে অন্তত ১০ জন শরণার্থী হলেও প্রত্যাবাসনের চেষ্টা চালানো হয়েছিল; কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কয়েক দিন আগেও রোহিঙ্গাদের 'রাষ্ট্রহীন' (স্টেটলেস) বলে অভিহিত করত। তবে বাংলাদেশের তীব্র আপত্তির কারণে তা কিছুটা রোধ করা গেছে।
ওই কূটনীতিক জানান, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিক বলেই স্বীকার করত না। কিন্তু গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের সময় দেশটি স্বীকার করেছে, তারা মিয়ানমার থেকেই বাংলাদেশে গেছে। তবে তাদের প্রত্যাবাসনের জন্য নাগরিকত্ব যাচাই করতে হবে।
ওই কূটনীতিক আরো জানান, শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত নয়, মিয়ানমারের এমন প্রায় তিন থেকে পাঁচ লাখ নাগরিককে চাইলেই সরকার বাংলাদেশ থেকে বের করে দিতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের নীতি নিবর্তনমূলক না হওয়ায় তারা এ দেশে এখনো অবস্থানের সুযোগ পাচ্ছে। আইনের দৃষ্টিতে তারা অনুপ্রবেশকারী। মিয়ানমার থেকে বিপুলসংখ্যক অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ইতিমধ্যে বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্রুত তাদের ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া না হলে বাংলাদেশ আরো বড় সংকটে পড়বে।
রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা হয় না : কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের মানবিক দিকটি তারা বোঝে। সেখানে কাজের সুযোগ নেই, স্বাধীনতাও সীমিত। সে তুলনায় বাংলাদেশ তাদের জন্য অনেক উদার ও স্বাধীন।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো আরো জানায়, রাখাইন রাজ্যে অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেই শরণার্থীরা ফিরে যেতে আগ্রহী হতে পারে। কিন্তু সেখানে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। যেমন- আজ কোনো শরণার্থী স্বেচ্ছায় ফিরে গেলে সেখানে তার বাসস্থানের কোনো নিশ্চয়তা নেই। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো মনে করে, রোহিঙ্গাদের ফিরে যেতে আগ্রহী করতে হলে অবশ্যই সেখানে বাসস্থান ও কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। মিয়ানমার সরকারসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
সহযোগিতায় আগ্রহী বাংলাদেশও : কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে এনে যে সাহায্য-সহযোগিতা করতে চাইছে তা মিয়ানমারের ভেতরে গিয়ে করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে সরকার। বাংলাদেশ প্রয়োজনে এ ব্যাপারে সাহায্য-সহযোগিতা করতেও প্রস্তুত।
সূত্র আরো জানায়, সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের ভেতর অবকাঠামো নির্মাণ থেকে শুরু করে চিকিৎসাসহ যেকোনো মানবিক সহযোগিতা কার্যক্রমে বাংলাদেশের সমর্থন থাকবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে বাংলাদেশ প্রত্যক্ষভাবেও সম্পৃক্ত হতে পারে।
মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের সম্ভাব্য সফরকে ঘিরে আশা : আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠক বাতিল হয়েছে। এখন রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনার জন্য আগামী মাসে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের সম্ভাব্য বাংলাদেশ সফরকে ঘিরে আশাবাদী ঢাকা। তবে ওই সফর নিয়েও সন্দিহান অনেকে।
সংশ্লিষ্ট এক কূটনীতিক গতকাল বুধবার বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, অন্তত দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে আস্থা বৃদ্ধির জন্য হলেও সফরটি প্রয়োজন। কয়েক দিন আগেও মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশে বড় সমস্যা ছিল দুটি। এর একটি সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ, অন্যটি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন। সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিরসনের পর এবার রোহিঙ্গা ইস্যুই দুই দেশের জন্য এককভাবে বড় সমস্যা। বিষয়টিকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
আন্তর্জাতিক মহলের নতুন করে চাপ : বিশ্ব শরণার্থী দিবস উপলক্ষে গতকাল বুধবারও রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত খুলে দিতে বাংলাদেশের কাছে নতুন করে প্রত্যাশা জানানো হয়েছে। অথচ রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে।
নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গতকাল এক বিবৃতিতে নৌকায় করে আসা বাংলাদেশে আশ্রয়প্রার্থীদের ফিরিয়ে না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। অন্যদিকে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) মুখপাত্র অ্যাড্রিন এডওয়ার্ডস গত মঙ্গলবার জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। বাংলাদেশ তার সীমান্ত খুলে না দেওয়ার অবস্থানেই আছে। তবে মিয়ানমারের আশ্রয়প্রার্থীদের ব্যাপারে ইউএনএইচসিআর বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রতিক দাঙ্গায় সরকারি হিসাবে কমপক্ষে ৪৮ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। গত মঙ্গলবার থেকে রাখাইন রাজ্যের ছয়টি শহরে সরকার ৪০টি অস্থায়ী ত্রাণশিবির খুলেছে। বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের মংডু শহরে খাদ্য ও মানবিক সহায়তা প্রয়োজন বলে ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.