বাবার জন্য ভালোবাসা by মৃন্ময় হক

ইতালির রাস্তায় সার সার মানুষ। তার মধ্যে বাবা আন্তোনিওর হাত ধরে যাচ্ছে ছেলে ব্রুনো। বাবা-ছেলের অভিব্যক্তিতে তখন কান্না ঠেকানোর প্রবল চেষ্টা। ভিত্তোরিও দ্য সিকা পরিচালিত বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র বাইসাইকেল থিভস-এর শেষ দৃশ্য এটি। বাবার হাত ধরে পরম নির্ভরতায় ছেলে চলেছে সামনে।


এরপর তাদের গন্তব্য কোথায়—পরিচালক এ বিষয়ে আর টুঁ শব্দ করেননি। আবার হাল আমলের পারসু অব হ্যাপিনেস চলচ্চিত্রের দৃশ্যগুলোর কথা ভাবুন। বাবা ক্রিস্টোফার গার্নারের পাশে নিশ্চিন্তে হেঁটে যাচ্ছে তার পাঁচ বছর বয়সী ছেলে। অন্যদিকে, বাঙাল মুলুকে পরিচালক সত্যজিৎ রায় অপুর সংসার চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাবা-ছেলের সম্পর্ককে যেভাবে ফ্রেমে ফ্রেমে ধরে রেখেছেন, সেখানেও তো তাদের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে শেষ অবধি ফুটে উঠেছে বাবার জন্য ভালোবাসা।
‘বাবা, তোমায় ভালোবাসি’—এমন সংলাপ না থাকলেও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন চলচ্চিত্রে ‘বাবা’ চরিত্র মানেই পরম নির্ভরতা। মাত্র কদিন আগেই বিশ্বব্যাপী পালিত হলো বাবা দিবস। বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্রে সেই বাবার রূপটি কেমনভাবে ধরা আছে? বাইসাইকেল থিভস-এর আন্তোনিওকে দিয়েই শুরু করা যাক বাবাকাহনের আদ্যোপান্ত।

অপুর সংসার
পথের পাঁচালীতে বাবা হরিহর ও তাঁর ছেলে অপুকে যেভাবে দেখা যায়, সত্যজিৎ রায়ের পরবর্তী চলচ্চিত্র অপরাজিততে সেই অপু এবং হরিহরের মধ্যকার বাবা-পুত্রের সম্পর্ক যেন আরও মর্মস্পর্শী হয়ে উঠেছে। তবে পরের ছবি অপুর সংসারে অপু ও কাজলের সম্পর্কটি যেভাবে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে, তা অনবদ্য। ছেলেকে জন্ম দেওয়ার সময় স্ত্রী অপর্ণার মৃত্যু হলে অপু এই মৃত্যুর জন্য ছেলেকেই দুষতে থাকে। ফলে ছেলের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি। এরপর যখন আবার সে ফিরে আসে ছেলের কাছে, তখনো তাঁর মনে পিতৃত্ববোধ জেগে ওঠে না। সময় বাবা-ছেলেকে নিয়ে আসে কাছাকাছি। অপু আর কাজল একসময় অনুভব করতে থাকে নাড়ির টান।

বাইসাইকেল থিভস
অনেকেই কথায় কথায় বলেন ‘বাপ কা বেটা’। ১৯৪৮-এ মুক্তি পাওয়া বাইসাইকেল থিভস-এর ব্রুনো এমনই—বাবা আন্তোনিও রিচির প্রধান সাঙাত সে। চলচ্চিত্রে দেখা যায়, দরিদ্র ইতালিয়ান নাগরিক আন্তোনিও রিচি একটি কাজের সন্ধান পেয়েছে। কিন্তু কাজের শর্ত এই যে, বাইসাইকেল থাকতে হবে তার। ঘটনাপরম্পরায় আন্তোনিও একটি বাইসাইকেল কিনলেও সেটি চুরি হয়ে যায়। এরপর ছেলে ব্রুনোকে সঙ্গে নিয়ে আন্তোনিও বেরিয়ে পড়ে পথে। একসময় অন্যের বাইসাইকেল চুরি করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে সে। জনগণ শিশুপুত্র ব্রুনোর সামনেই মারধর করে তাকে। বাবার জন্য ছেলের আকুলতা ও ভালোবাসার অসামান্য চলচ্চিত্র এটি, যেখানে ছেলের জন্য বাবা এবং বাবার জন্য পুত্রের আবেগ প্রকাশ পেয়েছে প্রতি মুহূর্তে।

পারসু অব হ্যাপিনেস
ক্রিস্টোফার গার্নার একজন সেলসম্যান। চিকিৎসকদের ব্যবহারোপযোগী একটি যন্ত্র বিক্রি করেই যিনি জীবিকা নির্বাহ করছিলেন। কিন্তু নিজের সমস্ত সঞ্চয় উজাড় করে দিয়েও জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আসেনি তাঁর। এদিকে স্বামীর পাগলামিতে অতিষ্ঠ স্ত্রী লিন্ডাও একসময় তাঁকে ছেড়ে গেলেন। যে বাড়িতে বসবাস করতেন, ভাড়া দিতে না পারায় সেটিও ছাড়তে হলো। পাঁচ বছরের ছেলে ক্রিস্টোফারকে নিয়ে গার্নার তখনো অনবরত জীবনযুদ্ধের মুখোমুখি—কখনো সাবওয়ে স্টেশনের বাথরুমে, কখনো চার্চের বারান্দায় রাত যাপন করছেন। কষ্ট শেষে একসময় তাদের জীবনে ফিরে এল খুশির জোয়ার—শুরু হলো সুখের দিন। ২০০৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত গ্যাব্রিয়েল মুকিনো পরিচালিত এই চলচ্চিত্রে বাবা-ছেলের চরিত্রে অভিনয় করেছেন উইল স্মিথ ও জেড স্মিথ। বাস্তবেও তাদের সম্পর্ক বাবা-ছেলের।

ফাদার
সৎছেলে মেহ্রলাকে হাতকড়া পরিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে আনছেন বাবা। কিন্তু ছেলে সৎবাবার বাড়ি যেতে নারাজ। ইরানি চলচ্চিত্রকার মাজিদ মাজেদীর চলচ্চিত্র ফাদার-এর এক অনবদ্য দৃশ্য এটি। বাবার মৃত্যুর পর তিন বোন আর মায়ের খাবার জোগাড়ের জন্য শহরে পাড়ি জমায় ১৪ বছরের বালক মেহ্রলা। তবে চার মাস পর বাড়ি ফিরে সে দেখে মা তার বিয়ে করেছেন আরেকজনকে, যিনি পেশায় পুলিশ। এ সময় সৎবাবার বাড়িতে না গিয়ে নিজেদের পুরোনো ভাঙা বাড়িতেই থাকতে শুরু করে মেহ্রলা। ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। অসুস্থ মেহ্রলাকে জোর করে নিয়ে আসা হয় সৎবাবার পরিবারে। সুস্থ হয়েই পুলিশ বাবার রিভলবার নিয়ে মেহ্রলা পালিয়ে যায় শহরে। ছবির দ্বিতীয় অংশে দেখা যায়, বাবা কীভাবে অবাধ্য ছেলেকে ফিরিয়ে আনলেন বাড়িতে। ১৯৯৬-এ মুক্তি পাওয়া ফাদার চলচ্চিত্রের দৃশ্যগুলোতে থরে-বিথরে ছড়িয়ে রয়েছে ছেলের জন্য এক বাবার অকাতর ভালোবাসা।

লাইফ ইজ বিউটিফুল
বাবা ও ছেলেকে নিয়ে আরেকটি অসামান্য চলচ্চিত্র লাইফ ইজ বিউটিফুল। যুদ্ধ-বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে ছেলে গুসোর যখন জন্ম হয়, তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সবে শুরু হয়েছে। এর মধ্যে ইহুদি বাবা গুডো এবং তার অ-ইহুদি মা ডোরাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। কিন্তু চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও বিচ্ছেদ ঘটেনি তাঁদের। এমনকি লাইফ ইজ বিউটিফুল চলচ্চিত্রে শত বিপদের মধ্যেও বাবা তাঁর শিশুপুত্রকে আগলে রেখেছেন। ১৯৯৮ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছবির পরিচালক রবার্তো বেনিন নিজেই এখানে অভিনয় করেছেন বাবার চরিত্রে। বাবাই যে সন্তানের নিরাপদ আশ্রয়, এই সত্যটি লাইফ ইজ বিউটিফুল-এর পরতে পরতে লেখা আছে।

No comments

Powered by Blogger.