চেয়ারম্যান নির্বাচনের খবর নেই, দ্বন্দ্ব প্রকট-সময়সীমা শেষ হলেও জেলা পরিষদ চলছে প্রশাসক দিয়ে by অমিতোষ পাল ও পাভেল হায়দার চৌধুরী

জনপ্রতিনিধিদের প্রত্যক্ষ ভোটে ১৮০ দিনের মধ্যে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হবে- এই কথা বলে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর ৬১ জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও সচিবের বক্তব্য অনুযায়ী ছয় মাসের এই সময়সীমা এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু চেয়ারম্যান নির্বাচনের কোনো উদ্যোগই এখনো নেয়নি


সরকার। সরকার মনোনীত প্রশাসকদের আর কত দিন দায়িত্ব পালন করতে হবে, সেটাও কেউ জানেন না।
এদিকে জেলা পরিষদের প্রশাসক নিয়োগ করায় অনেক এলাকায় স্থানীয় সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র এমনকি আওয়ামী লীগের স্থানীয় অনেক নেতা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। সেই ক্ষোভ থেকে দেখা দেওয়া দ্বন্দ্ব এখন কোথাও কোথাও প্রকাশ্যে রূপ নিচ্ছে। আর নির্ধারিত সময়সীমার পরও নির্বাচনের কোনো আলামত না থাকায় এই দ্বন্দ্ব-বিরোধ আরো প্রকট হয়ে উঠছে।
জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচন কবে হবে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সব কিছু দিনক্ষণ ঠিক করে হয় না।' তিনি বলেন, নির্বাচন কবে হবে সেটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তবে বর্তমান সরকারের মেয়াদের মধ্যেই হবে। শুরুতে যে ১৮০ দিনের কথা বলা হয়েছিল, সে বিষয়টি উল্লেখ করলে তিনি প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যান।
প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার সময় সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, ছয় মাসের মধ্যে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচন করা হবে। নির্বাচিত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকে উপমন্ত্রীর পদমর্যাদা দেওয়া হবে। এর আগে গত বছরের ২৩ মার্চ সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, নির্বাচিত জেলা পরিষদে একজন চেয়ারম্যান, ১৫ জন সদস্য ও পাঁচজন সংরক্ষিত আসনের মহিলা সদস্য থাকবেন।
কিন্তু এসবের কোনো কিছুই চূড়ান্ত হয়নি। জানা গেছে, জেলা পরিষদ আইনের খসড়া চূড়ান্ত করার পর সংসদে বিল আকারে তোলা হবে। বিল পাস হওয়ার পর হবে নির্বাচন। এ কাজেরও কোনো অগ্রগতি নেই বলে জানা গেছে।
তিন পার্বত্য জেলা ছাড়া দেশের বাকি ৬১টি জেলা পরিষদে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর প্রশাসক নিয়োগ দেয় মহাজোট সরকার। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা দায়িত্ব পান। জানা গেছে, এ নিয়ে বিভিন্ন জেলায় ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের অনেকের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দেয়। তবে সবাই আশা করেছিলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভোটের মাধ্যমে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচন করা হবে। এতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী হবে। কিন্তু সেটা না হওয়ায় অবস্থার আরো অবনতি হয়েছে।
ফেনী জেলা পরিষদের প্রশাসক আজিজ আহমেদ চৌধুরী। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ডিসেম্বরের ২০ তারিখে আমি চিঠি পেয়েছিলাম। তখন ছয় মাসের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ভোটের মাধ্যমে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নিয়োগ করার কথা শুনেছিলাম। কিন্তু চিঠিতে এ ধরনের কিছু লেখা ছিল না। আমার মেয়াদ কত দিন তারও উল্লেখ ছিল না। তাই কবে নির্বাচন হবে সেটা বলতে পারছি না।'
সরকারদলীয় এমপি-নেতারা ক্ষুব্ধ : অভিযোগ রয়েছে, যাঁদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাঁদের অনেকেই বয়সে জ্যেষ্ঠ হওয়ায় এলাকার এমপি বা পৌর মেয়রদের ওপর খবরদারি করছেন তাঁরা। এ ছাড়া তাঁদের কর্মপরিধির কোনো পরিপত্র এখনো ঠিক না হওয়ায় তাঁরা নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করছেন। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, অনেক জেলায়ই আওয়ামী লীগের এমপি থেকে শুরু করে নেতারা মনঃক্ষুণ্ন সরকার মনোনীত প্রশাসকের ওপর। সংসদ সদস্যদের অভিযোগ, প্রশাসকরা জনপ্রিয় নন বলেই বিগত সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাননি। আবার আওয়ামী লীগেরই অনেকে মনে করেন, জেলা পরিষদের প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে দলের কিছু বঞ্চিত ও ত্যাগী নেতাকে পুনর্বাসন করা হলেও এর ফলে জেলায় দলীয় রাজনীতিতে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। মনোনীত প্রশাসকদের খবরদারি কমাতে এখনই কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপ এবং জেলা প্রশাসকদের কর্মপরিধি নির্ধারণ করা উচিত। কারণ এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী নির্বাচনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
দ্বন্দ্ব চরমে : জানা যায়, প্রশাসক নিয়োগের পর অনেক জেলায় ক্ষমতাসীন দলে মর্যাদার লড়াই শুরু হয়। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, ফেনী, মেহেরপুর, যশোর, সিলেট, সুনামগঞ্জসহ প্রায় দুই ডজন জেলা শহরে এ ধরনের বিরোধের খবর পাওয়া গেছে। কোথাও সংসদ সদস্যরা জেলা প্রশাসকদের ওপর, কোথাও জেলা প্রশাসকরা সংসদ সদস্যদের ওপর খবরদারি ফলানোর চেষ্টা করছেন। আবার কোথাও রয়েছে উপজেলা চেয়ারম্যান বা পৌর মেয়রদের আধিপত্য ও খবরদারি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। কয়েকটি জেলায় এই বিশৃঙ্খলা প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে।
মেহেরপুরে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের স্থানীয় রাজনীতি আগে থেকেই দ্বিধাবিভক্ত জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ঘিরে। সভাপতি জয়নাল আবেদিন বর্তমানে সংসদ সদস্য। সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিয়াজান আলী নিয়োগ পেয়েছেন জেলা পরিষদের প্রশাসক হিসেবে। এ নিয়োগ পাওয়ার পর তাঁর পক্ষও চাঙ্গা হয়ে ওঠে। গত মাসে গাংনীতে সাবরেজিস্ট্রি অফিস উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের সামনেই মিয়াজান আলী ও জয়নাল আবেদিনের মধ্যে হাতাহাতি হয়। ঘটনার জন্য একে অপরকে দায়ী করেন। এ প্রসঙ্গে সংসদ সদস্য জয়নাল আবেদিন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মিয়াজান আলী জেলা পরিষদ প্রশাসক পদ পেয়েছেন। তাই প্রভাব বিস্তারের জন্য এসব ঘটনা ঘটাচ্ছেন। আসলে তাঁদের কর্মপরিধি এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। পদ পেয়েছেন, কিছু একটা করা দরকার, সেটাই করছেন।'
সুনামগঞ্জ : জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক ব্যারিস্টার এনামুল কবীর ইমনকে জেলা পরিষদের প্রশাসক করার পরপরই ক্ষোভে ফেটে পড়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। শহরে তাঁর বিরুদ্ধে মিছিল ও সমাবেশ হয়। সুনামগঞ্জে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয় এনামুলকে। শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উভয় পক্ষকে ডেকে মিলেমিশে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানা গেছে। তারপরও যেকোনো সময় বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা স্থানীয় নেতা-কর্মীদের।
সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদ প্রশাসক ব্যারিস্টার এনামুল কবীর ইমন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে হলেও দায়িত্ব অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি। সংসদ সদস্য ও নেতৃস্থানীয় কারো সঙ্গে এখনো বসা হয়নি। খুব শিগগিরই তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হবে।'
খুলনা : জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হারুনুর রশীদকে জেলা পরিষদের প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, জনগণের কাছে কার্যত অজনপ্রিয় কাউকে প্রশাসকের পদে চাপিয়ে দেওয়ার বিষয়টি দলের নেতা-কর্মীরা কতখানি গ্রহণ করেছেন, তা শিগগিরই পরিষ্কার হয়ে যাবে। আরেক নেতা বলেন, স্থানীয় রাজনীতিতে মোস্তফা রশিদী সুজার বড় প্রভাব রয়েছে। তাঁকে কিভাবে দল ম্যানেজ করবে তার ওপরই নির্ভর করছে সেখানে আওয়ামী লীগের রাজনীতির ভবিষ্যৎ কী।
ভোলা : ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মমিন টুলু বিগত পৌর নির্বাচনে অংশ নিয়ে ভোট পেয়েছিলেন মাত্র এক হাজার ১৭৭টি। জেলা বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচন করেও হেরে গিয়েছিলেন তিনি। এমন ব্যক্তিকে জেলা পরিষদের প্রশাসক নিয়োগ করায় স্থানীয় আওয়ামী লীগে শুরু থেকেই চলছে ক্ষোভ ও অসন্তোষ। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীবিহীন ভোলায় এখন তিনিই সর্বোচ্চ মর্যাদাভোগী ব্যক্তি।
ফেনী : ফেনীর প্রশাসক আজিজ আহমেদ চৌধুরী স্থানীয়ভাবে জয়নাল হাজারীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। জেলায় আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতা এবং উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়রদের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য। তাঁকে জেলা পরিষদ প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার পর থেকে জেলায় দলের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা বিরাজ করছে বলে জানা গেছে।
যশোর : একাধিকবার সংসদ সদস্য ছিলেন শাহ হাদীউজ্জামান। ২০০১ সালের নির্বাচনে ভরাডুবির পর গত সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নও পাননি। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ, জেলার রাজনীতিতে হাদীউজ্জামান সক্রিয় ছিলেন না। হারিয়ে যাওয়া এই নেতাকে যশোর জেলা পরিষদের প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে। এ নিয়ে আরেকটি বিরোধ-বলয় সৃষ্টি হয়েছে।
হবিগঞ্জ, পঞ্চগড়, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, কক্সবাজার, মৌলভীবাজার, গোপালগঞ্জেও এ ধরনের জটিলতা দেখা দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.