চারদিক-আঁধারের মাঝেও আলোর দিশা by শারমিন নাহার

যাত্রাবাড়ী থেকে খুব বেশি পথ নয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ধারে শনির আখড়ার বাঁশপট্টি পর্যন্ত গেলেই চলবে। রাস্তার পাশে সারিবদ্ধ করে রাখা বাঁশগুলো। আর এই বাঁশপট্টিতেই গড়ে উঠেছে স্কুলটি। দিনের মতো রাতের বেলায়ও জমে ওঠে অগ্রদূত বিদ্যানিকেতন নামের স্কুলটি।


দিনের বেলা সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সেখানে রাতে পড়াশোনা করে কর্মজীবী আর দরিদ্র শিশুরা। কিন্তু এই নৈশ স্কুলে দিতে হয় না আলাদা কোনো বেতন।
সন্ধ্যা সাতটা বাজতেই কচি মুখগুলো হাজির হতে থাকে স্কুলে। এ বছরের গোড়া থেকে যাত্রা শুরু করেছে স্কুলটি। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমি নিজে বেশি দূর লেহাপড়া করতে পারি নাই। তাই, আমি চাই, কেউ যেন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয়। আমার সামর্থ্য কম, কিন্তু এর পরও ইচ্ছেটারে বাঁচায় রাখছি।’ আর সেই ইচ্ছাটাকে বাস্তবে রূপ দিতে যাত্রা শুরু করেছে স্কুলটি। বাইরের কোনো সহায়তা ছাড়াই প্রতিষ্ঠানটি চলছে বলে জানান তিনি। শিশুরা যখন স্কুলের মূল গেট-লাগোয়া ছোট্ট গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে, তখন তাদের হাতে থাকে আদর্শলিপি, স্লেট আর লেখার চক। কেননা, ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে বিদ্যালয়ের মূল গেট। অবশ্য তাতে কোনো ক্ষোভ নেই শিক্ষার্থীদের।
সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত কোমলমতি এই শিশুরা এত কিছুর পরও যে পড়তে পারছে, এটাই ওদের কাছে অনেক বড় পাওয়া। এত দিনে শিক্ষার্থীরাও বুঝে গেছে, তাদের এই স্কুলটি অন্যান্য স্কুলের মতো নয়। অগ্রদূত বিদ্যানিকেতন স্কুলের একটা ক্লাসরুম ছেড়ে দেওয়া হয়েছে রাতের বেলায় দরিদ্র ও কর্মজীবী শিশুদের পড়াশোনার জন্য।
এই স্কুলের শিক্ষার্থী তানিয়া বলে, পাশের একটি বাসায় কাজ করে সে। এর আগে সে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে। নতুন করে আবার পড়ালেখা শুরু করতে পেরে যারপরনাই খুশি সে। এরই মধ্যে খানিকটা অন্ধকারাচ্ছন্ন মাঝারি আকারের শ্রেণীকক্ষটিতে ঢোকে মোহাম্মাদ রসুল। সারা শরীর তার ঘামে ভেজা। ঘর্মক্লান্ত মুখটি বলে দেয়, সারা দিন কত পরিশ্রম করেছে সে। রাস্তার উল্টো পাশে একটা ফ্যান তৈরির কারখানায় কাজ করে সে। কিন্তু তাতেও কষ্ট বোধ হয় না রসুলের। কেন এত কষ্ট করে পড়তে আসে সে? রসুলের সোজাসাপ্টা জবাব, ‘ফড়া-লেহা করার দরকার আছে, তাই আসি।’ বয়স অন্যান্য শিক্ষার্থীর চেয়ে কিছুটা বেশি তার। কিন্তু এর পরও ছোট্ট মান্না আর রুবেলের সঙ্গে দিব্যি খাতির জমিয়ে ফেলেছে রসুল।
মাথায় কাপড় পেঁচানো ছোট্ট মেয়ে খাদিজা। সবে দুই দিন হলো এখানে ক্লাস করছে। একটুকরো চক দিয়ে ‘আম’ লেখার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। বারবার লিখছে আর মুছে ফেলছে। যতক্ষণ না শব্দটি লিখতে পারছে, ততক্ষণ যেন বিরাম নেই তার। পাশে বসে থাকা সেয়াম বলল, ‘আমি পারি আম লেখতি।’ সঙ্গে সঙ্গেই লিখে দেখিয়ে দিল সে। লামিয়ার বিষয়টা একটু ভিন্ন। স্থানীয় একটা স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে সে। এর পরও রাতের বেলা এই স্কুল তার ভালো লাগে। অন্যদিকে কেয়ার মা বাসাবাড়িতে কাজ করে। রাতে কাজে যাওয়ার সময় কেয়াকে দিয়ে যায় এই স্কুলে। এখানে সময়টা মন্দ কাটে না কেয়ার। তার পাশেই বসে আছে ক্লাসের সবচেয়ে ছোট্ট মেয়েটি। প্রশ্ন করি, নাম কী তোমার? সে উত্তর দেওয়ার আগেই, সবাই একসঙ্গে বলে ওঠে, ‘ওর নাম সাথী। সাথী তো কথা কয় না।’ সাথী কথা বলতে পারে না, এমনকি পায় না শুনতেও। কিন্তু তাতে কী! হাতের ওপর হাত দিয়ে কলম ঘুরিয়ে প্রতিটি বর্ণই হুবহু লিখে যাচ্ছে সাথী।
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় শুরু হয়ে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে স্কুলটি। তবে শুধু লেখাপড়া শেখানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি এই নৈশ স্কুলের কার্যক্রম। প্রতিদিন ক্লাস শেষে নিজেদের মতো করে আনন্দ করে শিক্ষার্থীরা। রাত নয়টা বাজার পর থেকে তাই তারা প্রতীক্ষা করতে থাকে, কখন আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সেখানে যার যা ইচ্ছা—গান, নাচ, কবিতা, ছড়া আর মজার সব ধাঁধা চলে একের পর এক। সবশেষে রবিঠাকুরের ছড়া ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি, আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি।’ রাত বাড়তে থাকে। অন্ধকার ঘনিয়ে আসে চারদিকে। কিন্তু তার পরও কোথায় যেন আলোর দেখা পায় ওরা। যে আলো দূর করে দেয় সব অন্ধকার আর অমানিশা।

No comments

Powered by Blogger.