কালের আয়নায়-সার্ধশত জন্মবার্ষিকীতে আমাদের রবীন্দ্র-ভাবনা by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

ভারতীয় আদি আধ্যাত্মিক সভ্যতা এবং ইউরোপের আধুনিক বাস্তুবাদী সভ্যতার মিশ্রিত চেতনার মানবতাবাদী প্রকাশ ঘটেছে রবীন্দ্রনাথের কাব্য, গান ও সমগ্র সাহিত্যে। বাংলাভাষায় তিনি এই সাহিত্য রচনা করেছেন এবং বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে দিয়েছেন বিশ্বসভায় সম্মানিত আসন।


বিশ্বকবি হয়েও তিনি তাই প্রতিটি বাঙালির কাছে তাদের ঘরের কবি। তাদের সব ইচ্ছা-অনিচ্ছা, সব অনুভূতির মূর্ত প্রকাশ এবং তাদের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গীত



এবার উপমহাদেশজুড়ে সার্ধশত রবীন্দ্রজন্মবার্ষিকী পালিত হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, এবার এই জন্মবার্ষিকী পালিত হচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বারা যুক্তভাবেও। এ উৎসবে পাকিস্তানও যুক্ত হলে গত অর্ধশতকেরও বেশি সময়ের রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক সব বিভাজন ও বিরোধ-সংঘাতের ঊধর্ে্ব যে সাংস্কৃতিক ঐক্য এবং মিলনের মোহন বাঁশিটি বেজে উঠত, সেটাই হয়তো উপমহাদেশকে আবার শান্তি ও সমৃদ্ধির মহাতীর্থে পরিণত করত।
এমনিতেই বলা হয় অবিভক্ত উপমহাদেশের দুই মহাকবি : একজন রবীন্দ্রনাথ, অন্যজন কবি ইকবাল। চলি্লশের দশকে রেড ক্লিফের ছুরিতে এই উপমহাদেশের সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে। কিন্তু এই দুই কবিকে ভাগ করা সম্ভব হয়নি। রবীন্দ্রনাথের দুটি গান এখন বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সঙ্গীত। অন্যদিকে ইকবালের গান ভারতে প্রায় দ্বিতীয় জাতীয় সঙ্গীত। মহাজাতীয়তার প্রতীক হিসেবে ভারত-বন্দনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ ও ইকবাল দুই কবিই। একজন গেয়েছেন 'এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরের' গান। অন্যজন গেয়েছেন 'সারে জাঁহাসে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হামারা।' ভারত ভাগ হয়েছে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ও ইকবাল ভাগ হননি।
কল্পনা করছি যদি এমন হতো, রাজনৈতিকভাবে ভারত ভাগের ফলে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান তিনটি রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে; কিন্তু ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতার ছুরিতে সাংস্কৃতিক ভারতীয় মহাজাতীয়তা ও সভ্যতা ভাগ হয়নি। যেমন হয়নি ইউরোপে বহু নেশন-স্টেটের জন্ম সত্ত্বেও ইউরোপীয় মহাজাতীয়তা ও ইউরোপিয়ান সমাজ-সংস্কৃতির বিভক্তি। শেকসপিয়র যেমন জার্মানিতে আদৃত এবং গ্যাঁটে ইংল্যান্ডে; মহাসাগর আটলান্টিক যেমন ইউরোপ ও আমেরিকার মধ্যে শেকসপিয়রকে ভাগ করে ফেলতে পারেনি, তেমনি রবীন্দ্রনাথ ও ইকবালও যদি বিবেচিত হতেন, উপমহাদেশের মহাজাতীয়তা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির ঐক্যদূত, উপমহাদেশের তিনটি দেশেই যুক্তভাবে স্মরণ করা হতো রবীন্দ্রনাথ ও ইকবালকে, তিনটি দেশ সম্মিলিতভাবে পালন করত এই দুই সাংস্কৃতিক পুরুষের দুটি জন্মদিবস, তাহলে এই উপমহাদেশের আধ্যাত্মিক সভ্যতা কি ইউরোপের যান্ত্রিক সভ্যতাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারত না?
অবশ্য এজন্য প্রয়োজন ছিল গোটা উপমহাদেশেই একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বাতাবরণের। উপমহাদেশ ভাগ হওয়ার সময় ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতার ছুরি ব্যবহৃত হলেও নতুন রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেওয়া দুটি রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানে প্রবর্তন করা হয়েছিল একই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এর আড়াই দশক পর তো বাংলাদেশের জন্ম হয় গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতেই। দু'দুটি মহাযুদ্ধে ইউরোপের গণতান্ত্রিক দেশগুলো যেমন লড়াই করেছে তাদের মহাদেশে ফ্যাসিবাদের উত্থানের বিরুদ্ধে, তেমনি স্বাধীনতা লাভের পর ভারত উপমহাদেশের বা ভারতবর্ষের তিনটি দেশই যদি একই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তিতে রাজনৈতিক ভাগের ঊধর্ে্ব উঠে তাদের সমাজ-সভ্যতার ঐক্যের সেতুবন্ধটি অভগ্ন রাখতে পারত, তাহলে গোটা উপমহাদেশ আজ রবীন্দ্রনাথের কাঙ্ক্ষিত ভারত-তীর্থ হয়ে উঠত। ইকবালও হতেন এই মহাতীর্থের বুলবুল। তার নিজের ভাষায়_ 'সারা জাঁহাসে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হামারা, হাম উসকি বুলবুল, ইয়ে গুলিস্তা হামারা' (সারা দুনিয়ার চেয়ে হিন্দুস্তান শ্রেষ্ঠ। সে আমার ফুলের বাগান, আমি তার বুলবুল পাখি)।
সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের পৃষ্ঠপোষকতায় মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা এবং পশ্চাৎমুখী হিংস্র মৌলবাদের উত্থান উপমহাদেশে এই শান্তি, সমৃদ্ধি, প্রেম ও মিলনের মহাতীর্থটি গড়ে উঠতে দেয়নি এবং এখনও দিচ্ছে না। উপমহাদেশের যে তিনটি রাষ্ট্রের কমন ভিত্তি ছিল গণতন্ত্র, পাকিস্তানে প্রথম তা ধ্বংস হয় 'মিলিটারি অ্যান্ড মক্স' অপশক্তির হাতে। বাংলাদেশেও একই অপশক্তি তা ধ্বংস করার জন্য বারবার হিংস্র হামলা চালিয়েছে। ভারতে ট্রাডিশনাল ডেমোক্রেসি টিকে আছে বটে, কিন্তু সে দেশেও হিন্দুত্ববাদী এবং সাম্প্রদায়িক দল বিজেপি দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশে সক্ষম হয়েছে।
উপমহাদেশে এই পশ্চাৎমুখিতা, ধর্মান্ধতা, সন্ত্রাস ও হানাহানি প্রতিরোধের একমাত্র অস্ত্র তার কয়েক হাজার বছরের মিত্র গণসভ্যতা ও গণসংস্কৃতি। তার সর্বাধুনিক ও সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি রবীন্দ্রনাথ। কবি ইকবালের নামটিও এ ক্ষেত্রে উচ্চারণ করা যায়। ইকবালকে বলা হয় 'পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা'। কিন্তু তার কোনো কবিতা বা লেখায় পাকিস্তানের জয়ধ্বনি শোনা যায়নি, কেবল হিন্দুস্তানের বা ভারতের জয়ধ্বনি শোনা গেছে। এমনকি 'শিকওয়া' কাব্যগ্রন্থটির জন্য রক্ষণশীল মুসলমানরা তাকে কাফের বলে ফতোয়া দিয়েছিল।
পাকিস্তানের সামরিক ও অসামরিক দু'ধরনের শাসকরাই সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি থেকে ইকবালকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছেন, তাকে রবীন্দ্রনাথের প্রতিদ্বন্দ্বী সমকক্ষ কবি বলে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন এবং রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু কবি বলে প্রচার চালিয়ে তাকে পাকিস্তানের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে তার সঙ্গীত, সাহিত্য সবকিছু পাকিস্তানে, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত তৎকালীন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন। তাতে তারা সফল হননি। বরং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তার 'আমার সোনার বাংলা' গান গেয়ে বাঙালি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হয়েছে এবং এই গানটি এখন স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত।
ব্রিটিশ বা ফরাসি জাতীয়তার সঙ্গে যেমন সর্ব ইউরোপীয় মহাজাতীয়তার কোনো ভেদ নেই, তেমনি উপমহাদেশে বাঙালি জাতীয়তার সঙ্গেও সর্বভারতীয় মহাজাতীয়তার কোনো বিভেদ নেই। রবীন্দ্রনাথ তাই বাংলাভাষা, সংস্কৃতি ও বাঙালি জাতীয়তার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি হয়েও ভারত-তীর্থ কবিতাটিতে সর্বউপমহাদেশীয় মহাজাতীয়তার উদ্বোধন করতে পেরেছেন। ইকবালও নিজেকে কেবল সংকীর্ণ মুসলিম পরিচয়ে সীমাবদ্ধ রাখতে চাননি। তার কবিতায় লিখেছেন, 'মুসলিম হয়ে হাম, ওয়াতান হায় সারে জাঁহা হামারা' (আমি মুসলমান, তবে সারাবিশ্ব আমার স্বদেশ)। এমনকি 'ভয়েস অব কার্ল মার্কস' কবিতায় সব ধর্মের শোষকের বিরুদ্ধে সব ধর্মের শোষিত গরিবকে লড়াই করার ডাক দিয়েছেন (ওঠো মেরি দুনিয়াকো গরিবোকো জাগাদো)। গণতান্ত্রিক ভারতে তাই ইকবাল কোনো ধর্মরাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা নন। তিনি উপমহাদেশীয় মহাজাতীয়তার কবি। তার সঙ্গীত দেশটির দ্বিতীয় জাতীয় সঙ্গীত। এমনকি মহাশূন্যে নিক্ষিপ্ত ভারতীয় উপগ্রহেও প্রথম এই গানটি (সারে জাঁহাসে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হামারা) প্রথম বাজানো হয়।
ভারত-ভাগের পর রবীন্দ্রনাথকেও নানা সংকীর্ণ পরিচয়ে চিহ্নিত ও বিভক্ত করার চেষ্টা হয়েছিল। গণতন্ত্র ও গণবিরোধী সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রদর্শন তাকে এবং তার দর্শন ও সাহিত্যকে ধ্বংস করতে চেয়েছে। কিন্তু তার বিশ্বজনীন মানবতাবাদী সুরটি ধ্বংস করতে পারেনি। এই সুরই বরং প্রতিরোধ করেছে সব সংকীর্ণতা ও সাম্প্রদায়িকতাকে। তাকে 'হিন্দু কবি' বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছিল পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক ও সামরিক শাসকরা। রবীন্দ্রনাথ ধর্ম পরিচয়ে ছিলেন ব্রাহ্ম। জাতি পরিচয়ে ছিলেন বাঙালি এবং সর্বভারতীয়। বার্ট্রান্ড রাসেল বলতেন, ও ধস ধ ইৎরঃরংয, ধষংড় ধহফ ঊঁৎড়ঢ়বধহ (আমি ব্রিটিশ, কিন্তু ইউরোনিয়ানও)। রবীন্দ্রব্যক্তিত্বের সম্প্রসারণ ঘটেছিল বিশ্বব্যক্তিত্ব হিসেবে। তিনি নিজেও বলেছেন, 'আমি পৃথিবীর কবি, সেথা তার ওঠে যতো ধ্বনি, আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি।' এতদসত্ত্বেও তার বিশ্বব্যক্তিত্বের ভিত্তি ছিল সর্ব উপমহাদেশীয় মহাজাতীয়তা। নিজের বাঙালিত্বও তিনি বর্জন করেননি।
রবীন্দ্রনাথের উপমহাদেশীয় সর্বজাতীয়তার দর্শনটি তার ভারত-তীর্থ কবিতায় সবচেয়ে উজ্জ্বলভাবে ধরা পড়েছে। শুধু সর্বভারতীয় আদি সভ্যতার নয়, যে সভ্যতা অস্ত্র হাতে, রণতূর্য বাজিয়ে (পাঠান, মোগলরা) ভারতে এসেছিল, তিনি নিজেকে তাদেরও বংশধর বলে দাবি করেছেন।
"রণধারা বাহি জয়গান গাহি
উন্মাদ কলরবে
ভেদি মরুপথ, গিরি পর্বত
যারা এসেছিলো সবে_
তারা মোর মাঝে সবাই বিরাজে
কেহ নহে নহে দূর
আমার শোনিতে রয়েছে ধ্বনিতে
তার বিচিত্র সুর।"
ভারতীয় আদি আধ্যাত্মিক সভ্যতা এবং ইউরোপের আধুনিক বাস্তুবাদী সভ্যতার মিশ্রিত চেতনার মানবতাবাদী প্রকাশ ঘটেছে রবীন্দ্রনাথের কাব্য, গান ও সমগ্র সাহিত্যে। বাংলাভাষায় তিনি এই সাহিত্য রচনা করেছেন এবং বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে দিয়েছেন বিশ্বসভায় সম্মানিত আসন। বিশ্বকবি হয়েও তিনি তাই প্রতিটি বাঙালির কাছে তাদের ঘরের কবি। তাদের সব ইচ্ছা-অনিচ্ছা, সব অনুভূতির মূর্ত প্রকাশ এবং তাদের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গীত।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সরকারই তাই প্রথম ভারত সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী দুই দেশ কর্তৃক যুক্তভাবে উদযাপনের। ভারত সরকার তাতে রাজি হয়। এ বছর চলতি মে মাসেই শুরু হয়ে গেছে বাংলাদেশ-ভারত যুক্ত উদ্যোগে এই সার্ধশত জন্মোৎসব পালন। আগেই বলেছি, পাকিস্তানকেও এই যৌথ উদ্যোগে গ্রহণ করা হলে বা পাকিস্তান এই উৎসবে অংশ নিতে এগিয়ে এলে ভালো হতো। ভবিষ্যতে কবি ইকবালকে নিয়েও ত্রিদেশীয় এ ধরনের উৎসব হলে উপমহাদেশে ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক যে মিলন সেতুটি গড়ে উঠবে, তাতে ধর্মান্ধতা ও সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার সন্ত্রাস ও ধ্বংসাত্মক তাণ্ডবের উন্মাত্ততা থেকে গোটা উপমহাদেশ মুক্ত হবে এবং মুক্ত মানবতা ও সুস্থ গণতান্ত্রিকতার ভিত্তিতে বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তান একই মহাজাতির পৃথক স্বাধীনসত্তা নিয়ে আবার ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী বাংলাদেশ-ভারত যুক্তভাবে পালনের এই যে শুভ সূচনা তা নতুন ভারত-তীর্থের উদ্বোধন ঘটাবে। রবীন্দ্রনাথ আগে এই তীর্থের উদ্বোধন ছিলেন। ভবিষ্যতেও থাকবেন। তিনিই বাংলাদেশের প্রথম বিশ্ব বাঙালি।
লন্ডন, ৬ মে ২০১১, শুক্রবার
 

No comments

Powered by Blogger.