দূরদেশ-ক্ষমতার লড়াইয়ের নতুন পর্বে মিসর by আলী রিয়াজ

মিসরে বৃহস্পতিবার নাগাদ যে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হবে, তার হাতে যে কোনোরকম ক্ষমতাই থাকবে না, মিসরের ক্ষমতাসীন সুপ্রিম কাউন্সিল অব আর্মড ফোর্সেস (স্কাফ) তা ইতিমধ্যে নিশ্চিত করেছে। মিসরের নাগরিকেরা যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় পর্যায়ে ভোট দিচ্ছিলেন, মিসরের সেনাবাহিনী তখন প্রজ্ঞাপন জারি করে দেশে কার্যত সেনাশাসন পুনর্বহাল করেছে।


দেশের নির্বাচিত পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া এবং দেশে কোনো কার্যকর সংবিধান না থাকার ফলে এখন ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিকারী সেনাবাহিনীর সুপ্রিম কাউন্সিল। সংবিধান রচনার জন্য ১০০ সদস্যের যে কমিটি পার্লামেন্ট নিয়োগ করেছিল, তার ভবিষ্যৎও কী হবে, তা কেউ-ই জানে না। সেনাবাহিনীর মুখপাত্ররা বলেছেন যে তা এখনো বহাল আছে, কিন্তু এ প্রজ্ঞাপনে এটাও বলা হয়েছে যে যদি এই কমিটি তাদের নির্ধারিত সময়ে সংবিধানে খসড়া তৈরি করতে ব্যর্থ হয়, তবে সেনাবাহিনী নিজেই নতুন কমিটি নিয়োগ করবে। শুধু তা-ই নয়, কমিটির করা খসড়ার ব্যাপারে স্কাফ, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কিংবা ওই কমিটির এক-পঞ্চমাংশ সদস্য আপত্তি করলে কমিটি সংশ্লিষ্ট আপত্তিকর ধারাগুলো পুনর্বিবেচনা ও সংশোধন করতে বাধ্য থাকবে। যদি এ বিষয়ে কমিটিতে মতৈক্য না হয়, তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে সুপ্রিম কনস্টিটিউশনাল কোর্ট বা সংবিধানবিষয়ক সর্বোচ্চ আদালত। মনে রাখা দরকার, এই আদালতই নির্বাচিত পার্লামেন্টকে বেআইনি ঘোষণা করেছেন এবং মোবারক সরকারের সাবেক প্রধান আহমেদ শফিকের প্রার্থিতা বৈধতা দিয়েছেন। মোবারক সরকারের নিয়োগকৃত ও স্কাফ-সমর্থিত এই আদালতের সিদ্ধান্ত কী হতে পারে, সেটা কোনোরকম বিতর্কের আগেই অনুমান করা যায়।
ফলে প্রায় ষোলো মাস আগে মিসরের জনগণ যে ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে পথে নেমেছিল, তা যে এখন ‘গণতন্ত্রায়ণ প্রক্রিয়া’র চোরাবালিতে পড়েছে, তা বলা বাহুল্য। গত কয়েক মাসে সংসদ ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে, সাংগঠনিকভাবে মুসলিম ব্রাদারহুডের শক্তি সবচেয়ে বেশি। তবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম দফা ফলাফলে এটাও স্পষ্ট যে মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থক মোট ভোটারসংখ্যার ৫০ শতাংশের অনেক কম। প্রথম দফা নির্বাচনে ব্রাদারহুড প্রার্থী মোহাম্মদ মোরসি পেয়েছিলেন ২৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ ভোট। ব্রাদারহুডের দলত্যাগী প্রার্থী আবদেল মোনেম আবুল ফতুহ পান ১৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। অর্থাৎ, সাংগঠনিক শক্তিতে অন্য যেকোনো দলের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও মিসরের সাধারণ ভোটারদের অধিকাংশই ব্রাদারহুডের নেতৃত্বের প্রতি আস্থাবান নয়। তবে নির্বাচনের দ্বিতীয় পর্যায়ে মোরসির পাওয়া ভোট ৫০ শতাংশের বেশি। তদুপরি নির্বাচনী গণতন্ত্রে ৫০ শতাংশ জনগণের সমর্থন প্রয়োজন হয় না, প্রয়োজন সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের।
সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর অত্যাসন্ন বিজয়কে সামনে রেখে সেনাবাহিনী যে সবার চোখের সামনে একটি সেনা অভ্যুত্থান ঘটাতে পেরেছে, তা দেখে বলা যায়, তারা এ ব্যাপারে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। কিন্তু সবার মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে পরিস্থিতি এখন কোন দিক গড়াবে। আপাতদৃষ্টে তিনটি বিকল্পের কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রথমটি হচ্ছে, মুসলিম ব্রাদারহুড ও সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রত্যক্ষ সংঘাত। অর্থাৎ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর ব্রাদারহুড প্রার্থী মোহাম্মদ মোরসি আরও ক্ষমতার জন্য চাপ দিতে পারেন। তার পরিণতি কী দাঁড়াবে, তার অতীত ইতিহাস হিসেবে নব্বইয়ের দশকে আলজেরিয়ার কথা মনে করা যায়। ১৯৯২ সালে নির্বাচনপ্রক্রিয়ার মাঝামাঝি সেনাবাহিনী নির্বাচন বাতিল করে দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করে। তার পরিবর্তে এক দশকের বেশি সময় ধরে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে দেশটি। এই এক দশকের অভিজ্ঞতা বিভিন্ন দেশে ইসলামপন্থীদের নতুন পথ অনুসন্ধানের তাগিদ দেয়। অন্য পক্ষে দেশে দেশে সেনাবাহিনীও বুঝতে পারে, এ ধরনের সংঘাত দেশের জন্য ইতিবাচক নয়। আন্তর্জাতিক সমাজ নব্বইয়ের দশকে ইসলামপন্থীদের যে চোখে দেখত, এখন সে অবস্থাও নেই। ফলে ব্রাদারহুড বা সেনাবাহিনী কেউ-ই এই পথ মাড়াবে বলে মনে হয় না।
দ্বিতীয় বিকল্প হলো, সেনাবাহিনী ও ব্রাদারহুডের মধ্যে অপ্রকাশ্য সমঝোতা সৃষ্টি হওয়া। সংবিধান না থাকায় এবং সংসদ ভেঙে দেওয়ার ফলে ব্রাদারহুডের হাতে তুরুপের তাস হলো রাষ্ট্রপতির পদ। সেটা নিয়ে তারা যদি সেনাবাহিনীর ওপর চাপ না দিয়ে আপস সমঝোতার প্রস্তাব দেয়, তবে তা উভয়ের জন্য লাভজনক। ব্রাদারহুড যদি আগামী ৯০ দিন সংবিধান প্রণয়ন কমিটির মাধ্যমে তাদের লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট হয় এবং প্রণীত সংবিধানের ভেতরে তাদের শক্তি সঞ্চয়ের পথ তৈরি করতে পারে, তবে নতুন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তারা যে তাদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে পারবে, তার ইঙ্গিত গত নির্বাচনগুলোতেই স্পষ্ট। সেনাবাহিনী ও ব্রাদারহুডের এই টানাপোড়েন কেবল প্রাসাদের অভ্যন্তরেই ঘটবে, তা মনে করার কারণ নেই। সেনাবাহিনীর কাছ থেকে ক্ষমতার ভাগ আদায় করতে হলে রাজপথ ও সংগঠনের পেশিশক্তির প্রদর্শনও দরকার বলে ব্রাদারহুড মনে করতেই পারে। প্রেসিডেন্টের মেয়াদ নিয়েও একটা প্রশ্ন খুব শিগগির উঠবে বলে অনুমান করা যায়। ইতিমধ্যে সেনাবাহিনীর উপদেষ্টা পরিষদের একজন সদস্য আলজাজিরা টেলিভিশনকে বলেছেন যে, ‘নতুন প্রেসিডেন্ট চান অথবা না চান, খুব কম সময়ই দায়িত্বে থাকবেন।’ বুঝতে অসুবিধা হয় না যে নতুন সংবিধান লেখা হলেই সেনাবাহিনী বলবে যে নতুন সংবিধানের আওতায় নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে হবে।
তৃতীয় বিকল্প হলো, নির্বাচনোত্তর সময়ে সেনাবাহিনীর এই ক্ষমতা দখলকে রাজপথে মোকাবিলা করা। সেনাবাহিনীর এই কার্যত ক্ষমতা দখল দেশের ‘সেক্যুলার’পন্থী উদার গণতন্ত্রী বলে পরিচিত রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি মোটেই গ্রহণযোগ্য মনে করে না। কিন্তু তারা যে মুসলিম ব্রাদারহুডের পাশাপাশি আন্দোলনে খুব বেশি উৎসাহী নয়, সেটা বোঝা যায় সংসদ ভেঙে দেওয়ার পরে তাদের প্রতিক্রিয়া থেকে। ব্রাদারহুডের ডাকে তাহরির স্কয়ারের সমাবেশে দলের কর্মী-সমর্থকদের বাইরে অংশগ্রহণ ছিল খুবই সীমিত। দেশের ইসলামপন্থী নয় এমন গণতন্ত্রকামী কর্মী-সংগঠকদের জন্য সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল যেমন সমর্থনযোগ্য নয়, তেমনি অপছন্দ হলো ব্রাদারহুডের বিজয়। উদার গণতন্ত্রকামীদের জন্য এটা যে সুসময় নয়, তা বলা বাহুল্য, কিন্তু তাঁরা এখন ক্ষমতার লড়াইয়ে অংশ নিতে চান, নাকি দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করবেন, তা-ই দেখার বিষয়। এটাও স্মরণে রাখা দরকার যে সাংগঠনিকভাবে উদার গণতন্ত্রকামীরা বিভক্ত ও দুর্বল।
সম্ভাব্য তিনটি বিকল্পের কোনোটিই আগামী দিনগুলো মিসরে স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দেয় না। ফলে এ অঞ্চলে স্থিতাবস্থা রক্ষা ও স্থিতিশীল নিরাপত্তা-পরিস্থিতি বজায় রাখতে যেসব আন্তর্জাতিক শক্তি উৎসাহী, তাদের জন্য সামনের দিনগুলো খুব উদ্বেগের সময়। এখানে যে কেউ-ই ইসরায়েলের ছায়া দেখতে পাবেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো ইসরায়েলের নিরাপত্তার স্বার্থে কোন বিকল্পটিকে সবচেয়ে কম উদ্বেগজনক মনে করবে, তাদের জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে মনে করবে, তা-ও পরিস্থিতির ওপর প্রভাব ফেলবে। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মিসরে গত ১৬ মাসের অস্থিতিশীলতার অবসান হবে বলে যাঁরা আশা করছিলেন, তাঁরা গোটা গ্রীষ্মকালের জন্য প্রস্তুত হতে পারেন—মিসরে ক্ষমতার লড়াইয়ের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে মাত্র।
ইলিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.