আগের জায়গায় যাচ্ছে দেশের শেয়ারবাজার! by সুজয় মহাজন

বাজার তখন পড়ছিল। বেলা সোয়া দুইটা। তখনো লেনদেন শেষ হতে ১৫ মিনিট বাকি। দিলকুশায় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) কার্যালয়ের নিচে দাঁড়িয়ে স্টক এক্সচেঞ্জের এক নেতার কাছে প্রশ্ন, বাজারের কী অবস্থা? জবাবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি এককথায় বললেন,


‘প্রতিদিনই আমাদের আর বিনিয়োগকারীদের টাকার রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের যে নিত্য রক্তক্ষরণ হচ্ছে, আমরাও তার বাইরে নই।’
নিয়ন্ত্রক সংস্থা কী বলে, এ রকম প্রশ্ন করা হলে তিনি বললেন, ‘নিয়ন্ত্রক সংস্থায় যাঁরা আছেন তাঁদের আর আমাদের ব্যথাটা ভিন্ন। তাঁদের (নিয়ন্ত্রক সংস্থা) রক্তক্ষরণ শুধু আত্মসম্মান বা ইমেজের। তাই তাঁদের ব্যথা আর আমাদের ব্যথা মিলবে না।’
এসইসির কার্যালয়ের নিচে প্রতিদিনই কিছু বিনিয়োগকারীর দেখা মেলে। বাজার নিয়ে তাঁদেরই একজনের ছোট্ট মন্তব্য, ‘দ্বিতীয় মৃত্যু হয়েছে আমাদের।’ বিনিয়োগকারীর এই মন্তব্যই এখন বাস্তবতা শেয়ারবাজারের লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর। ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে যে ধস নেমেছিল তাতে প্রথম দফা ‘মৃত্যু’যন্ত্রণা ভুলতে অনেকে পড়তি বাজারে পুনর্বিনিয়োগ করেছিলেন। উদ্দেশ্য একটাই, দাম সমন্বয়ের মাধ্যমে লোকসানের বোঝাটা একটু কমানো। কিন্তু ঘটেছে উল্টো।
বাজেট-পরবর্তী টানা দরপতনে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ মূল্যসূচক নেমে এসেছে চার হাজার ২৯৫ পয়েন্টে। সূচকের চেয়ে লেনদেনের অবস্থা আরও বেশি খারাপ। গতকাল বুধবার ডিএসইতে লেনদেনের পরিমাণ ছিল প্রায় ১২৩ কোটি টাকা। ২০১১ সালের ২০ জানুয়ারির উদাহরণটি বাদ দিলে গত প্রায় সাড়ে তিন বছরের মধ্যে ঢাকার বাজারে এটিই সর্বনিম্ন লেনদেন। এর আগে ২০০৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর সর্বশেষ ডিএসইতে সর্বনিম্ন ১১৬ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল।
এ ছাড়া, ২০১১ সালের ২০ জানুয়ারি মাত্র পাঁচ মিনিটে ৬৮ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল। সেদিন পাঁচ মিনিটে ডিএসইর সাধারণ সূচক ৬০০ পয়েন্ট কমে যাওয়ায় লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এ কারণে ওই দিনের লেনদেনকে স্বাভাবিক লেনদেনের হিসাবে ধরা হয় না।
গতকাল এক দিনেই ডিএসইর সাধারণ সূচক কমেছে প্রায় আড়াই শতাংশ বা ১০৮ পয়েন্ট। ৭ জুন জাতীয় সংসদে নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পর থেকেই শেয়ারবাজারে আবার দরপতন শুরু হয়। অথচ বাজারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার আশায় প্রস্তাবিত বাজেটে কয়েকটি প্রণোদনা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। শেয়ারবাজারে কোনো ধরনের ছোঁয়াছুঁয়ি না করার যে কথা দিয়েছিলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে সেই কথা রেখেছেন তিনি।
তার পরও বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরেনি। এ জন্য নিজের হতাশার কথা বলেছেন তিনি। পাশাপাশি সংসদে শেয়ারবাজারকে ‘দুষ্টু শেয়ারবাজার’ বলেছেন। পড়তি বাজারে অর্থমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে নেতিবাচক ধাক্কা লাগল। এতে আবারও ক্ষোভ তৈরি হয় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে।
অর্থনীতিতে নতুন করে কোনো সংকট দেখা দেয়নি। অথচ শেয়ারবাজারে প্রতিদিনই দরপতন ঘটছে। অর্থনীতির নানা সংকট সত্ত্বেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের শেয়ারবাজারে খুব বেশি নেতিবাচক প্রভাব নেই। ব্যতিক্রম এখন বাংলাদেশে।
দেশের বাজারে কখনো পরিচালকদের শেয়ারধারণকে ঘিরে, কখনো বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ানোয় বিনিয়োগকারীদের আস্থার জায়গাটি বারবার নড়বড়ে হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শেয়ারবাজার তার নিজস্ব নিয়মে চলছে না। বাজার ঠিক করার নামে একের পর এক নানামুখী হস্তক্ষেপে বাজার তার নিজস্ব চেহারাই হারিয়ে ফেলেছে।
অভিমত : পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্বের যেকোনো শেয়ারবাজারে বড় ধরনের একটি ধসের পর সেটি স্বাভাবিক বা স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরতে কিছুটা সময় লাগে। আমাদের দেশেও সেই সময়টা দিতে হবে। দেড় বছর হয়তো অনেক সময়। এই দীর্ঘ সময় পরও আমাদের শেয়ারবাজার তার নিজস্ব গতি ফিরে পাচ্ছে না। তার প্রধান কারণ, গত দেড় বছরে বাজার ঠিক করার নামে আমরা যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছি, সেগুলো বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাসকে আরও নড়বড়ে করেছে। ফলে এসব উদ্যোগ থেকে যৌক্তিক কোনো ফল আসেনি।’
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী আরও বলেন, ‘শেয়ারবাজারের সংকটের সঙ্গে মুদ্রাবাজারের সংকটও পুঁজিবাজারের অস্থিতিশীলতাকে দীর্ঘায়িত করছে। সাধারণত, বিশ্বের অন্যান্য দেশে যেটা দেখা যায় সেটা হলো, সেসব দেশে শেয়ারবাজারে সংকট হলে মুদ্রাবাজার থেকে সহায়তা দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের এখানে প্রায় একই সময়ে দুই বাজারে সংকট দেখা দেওয়ায় কেউ কারও সহায়তায় এগিয়ে আসতে পারছে না। তবে তারল্যের চেয়ে শেয়ারবাজারে আস্থার সংকটই এখন প্রবল।’
বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় সম্পর্কে এসইসির সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, ‘প্রথমত, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে সরকারকে এমন কিছু করতে হবে যাতে তারা বুঝতে পারে বাজার নিয়ে সরকার যথেষ্ট মনোযোগী। কিন্তু সেটি না করে দায়িত্বশীল অবস্থানে থেকে এমন সব বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে, যা আত্মবিশ্বাসকে আরও নড়বড়ে করে ফেলছে। এরপর সরকার বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে পারে, যা হয়তো বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে সহায়তা করবে।’
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সভাপতি আল মারুফ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘শেয়ারবাজারের ব্যাপারে সব মহলের সমান দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেওয়া উচিত। লাখ লাখ সাধারণ বিনিয়োগকারী, প্রতিদিনই যাঁরা ক্ষতির মুখে পড়ছেন, তাঁদের কথা ভেবেই এটা করা উচিত।’
বাজার পরিস্থিতি: গতকাল ঢাকার বাজারে ২৫৪টি কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডের শেয়ার লেনদেন হয়। এর মধ্যে ৮৭ শতাংশ বা ২২২টির দাম কমেছে, বেড়েছে কেবল ২১টির আর অপরিবর্তিত ছিল ১১টি কোম্পানির শেয়ারের দাম। দিন শেষে ডিএসইর সাধারণ সূচক গত প্রায় সাড়ে তিন মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে এসেছে। সর্বশেষ গত ১১ মার্চ ডিএসইর সাধারণ সূচক ছিল চার হাজার ৩১৭ পয়েন্টের সর্বনিম্ন অবস্থানে। গতকাল সেটি নেমে এসেছে চার হাজার ২৯৫ পয়েন্টে।
এশিয়ার শেয়ারবাজার: বাংলাদেশের কাছাকাছি ধরনের বা সমমানের বৈশ্বিক পুঁজিবাজারগুলো নিয়ে গঠিত হয়েছে এমএসসিআই ফ্রন্টিয়ার মার্কেটস ইনডেক্স (এফএম সূচক)। এতে বাংলাদেশসহ ২৫টি দেশ অন্তর্ভুক্ত। এই সূচকের সাম্প্রতিক ধারা থেকে দেখা যায়, সমন্বিত সূচকের তুলনায় এককভাবে বাংলাদেশের সূচকের পতনের হার অনেক বেশি। মাসওয়ারি প্রবণতায় এফএম সূচকের পতন হয়েছে দশমিক ৯১ শতাংশ। একই সময়ে এমএসসি বাংলাদেশ সূচকের পতন হয়েছে ৫ দশমিক ৭০ শতাংশ। আবার ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে এফএম সূচকের পতন হয়েছে প্রায় সাড়ে আট শতাংশ, যেখানে বাংলাদেশ সূচকের পতন হয়েছে ১২ দশমিক ৭২ শতাংশ। আর বার্ষিক ভিত্তিতে এমএসসিআই বাংলাদেশ সূচকের পতন হয়েছে ১৪ শতাংশ, যেখানে এফএম সূচকের পতন হয়েছে ৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। এই তথ্য ১৯ জুনের।
এমএসসিআই এফএম সূচকে এশিয়া অঞ্চল থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে আছে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও ভিয়েতনাম। চারটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের বাজারে সূচকের পতনই সবচেয়ে বেশি। বার্ষিক ও ত্রৈমাসিক হিসাবে ভিয়েতনাম ও পাকিস্তানের সূচক বেড়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) ১৯৯২ সালে ফ্রন্টিয়ার মার্কেট ধারণা প্রবর্তন করে। মূলত উদীয়মান বাজার তবে পিছিয়ে থাকা অর্থনীতি এতে অন্তর্ভুক্ত। প্রত্যাশা করা হয়, পর্যায়ক্রমে এই বাজারগুলো অগ্রসর উন্নয়নশীল বাজারের মতো হয়ে উঠবে।
এমএসসিআই একটি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান। নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত এই প্রতিষ্ঠান বিশ্বজুড়ে আর্থিক বাজার সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে। এমএসসিআই পরিচিতি পেয়েছে মূলত এর বিভিন্ন সূচকের কারণে। বিভিন্ন দেশের বড় বড় স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক, লেনদেন, বাজার মূলধন, বিনিয়োগযোগ্য শেয়ার ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে এমএসসিআই বর্তমানে বেশ কয়েকটি সূচক প্রকাশ করে থাকে, যেগুলো থেকে বিশ্ব পুঁজিবাজারের সামগ্রিক প্রবণতা বোঝা যায়।

No comments

Powered by Blogger.