প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী-আসুন, মায়ের মতো দেশকে ভালোবাসি by মতিউর রহমান

প্রথম আলো এক যুগ পেরিয়েছে। ‘যা কিছু ভালো তার সঙ্গে প্রথম আলো’ স্লোগান নিয়ে ১২ বছর আগে (৪ নভেম্বর ১৯৯৮) যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রথম আলোর। আমাদের প্রত্যয় ছিল একটা স্বাধীন, বস্তুনিষ্ঠ, পারিবারিক ও মানবিক দৈনিক হিসেবে প্রথম আলোকে গড়ে তোলার। সেই লক্ষ্য থেকে আমরা কখনো সরে আসিনি।


দশম বর্ষপূর্তিতে আমরা সবাই বলেছি, ‘বদলে যাও বদলে দাও’। কেননা, সবাই মিলে বদলে গেলেই কেবল সম্ভব মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়া।
পাঠকের ভালোবাসাকে প্রথম আলো পরম পাথেয় মনে করে, যার প্রতিদান হিসেবে এক যুগে এই কাগজ অর্জন করেছে প্রতিদিন গড়ে ৫২ লাখ পাঠক। প্রতিদিন প্রথম আলো ছাপা হয় গড়ে চার লাখ ৪০ হাজার কপি।
আমরা প্রতিদিনের প্রথম আলোকে স্বাধীন ও বস্তুনিষ্ঠ করতে সচেষ্ট রয়েছি। সে জন্য অনেক সময় নানা মহল থেকে চাপ, ভয়ভীতি, হুমকি, আক্রমণ, হামলা-মামলার মুখেও প্রথম আলো এগিয়ে গেছে।
উগ্র ধর্মীয় জঙ্গিগোষ্ঠী প্রথম আলোকে আক্রমণ করেছে, পত্রিকা বন্ধের দাবি তুলেছে। দুর্নীতিপরায়ণ ও অসহিষ্ণু রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও ভূমিদস্যুরা আমাদের পথচলাকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছে। তার পরও আমরা সত্য ও সুন্দরের পথ থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হইনি, ভবিষ্যতেও হব না।
তার পরও, প্রকাশের শুরু থেকেই, একটা প্রশ্ন ছিল আমাদের মধ্যে। প্রথম আলোয় আমরা কি শুধু প্রতিবেদন লিখব, মতামত দেব, সমালোচনা করব? আর কিছু করব না? ঠিক তখন (২০০০ সালে) সারা দেশে উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যায় নারীর ওপর এসিড-সন্ত্রাসের ঘটনা।
এই প্রেক্ষাপটে প্রথম আলোর সব কর্মীর এক দিনের বেতন দিয়ে ২০০০ সালের ১৯ এপ্রিল গঠন করা হয় ‘এসিডদগ্ধ নারীদের জন্য প্রথম আলো সহায়ক তহবিল’। সংবাদপত্রের চেয়ে একটু বেশি ভূমিকা পালন এভাবেই শুরু। তারপর মাদককে ‘না’ বলো, বন্যা-সিডর-আইলাদুর্গতদের জন্য বহুমুখী সাহায্য-সহযোগিতা, অদম্য মেধাবীদের জন্য শিক্ষাবৃত্তি এবং সাংবাদিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে নানা কার্যক্রম পরিচালনা করে চলেছি।
প্রথম আলোর লক্ষ্য বাংলাদেশকে আলোকিত বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলা।
শত বছরেরও অধিক সময় আগে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তাঁর গানে বলেছেন:
ভায়ের মায়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ
ওমা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি,
আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি।
এ দেশটা সম্পর্কে বলা হয়: ‘বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলেরই বাংলাদেশ, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, রূপের যে তার নেইকো শেষ।’
আজও যখন আমাদের ভাষাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের গানগুলো শুনি, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সেই গানগুলো বাজানো হয়, তখন আমাদের শরীর কি শিহরিত হয় না? চেতনায় দেশপ্রেমের শিখা কি জ্বলে ওঠে না?
আর কদিন পরই আমাদের স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্ণ হবে। অথচ আজও আমরা দেশ নিয়ে গর্ব না করে অনেক সময় হতাশার কথা বলি, যার নজির পৃথিবীর অন্য কোনো জাতির মধ্যে আছে কি না সন্দেহ। আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি, আমাদের এই দ্বিমুখিতা, পরস্পর বিরোধিতার কারণ কী?
একটা ব্যাপার সবাই খেয়াল করেছেন হয়তো, আমাদের সবার পরিবারে ছেলেমেয়েদের যত আবদার, যত আহ্লাদ, যত রাগ-অভিমান, সব মায়ের সঙ্গে। ছেলেমেয়েরা সাধারণত মায়ের সঙ্গে মধুর করে, নরম হয়ে কথা বলে না। ওরা কথা বলে একটু তাড়া দিয়ে, রাগের সঙ্গে। মা-ও পরম মমতায় সন্তানের এই দুর্বিনীত আবদার রাগ-ক্ষোভ আহ্লাদ মেনে নিয়ে তাদের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়ে নিঃস্ব হন, আবার খুশিও হন। ছেলেমেয়ে মায়ের সঙ্গে রাগ করতে পারে। মা কিন্তু রাগ করেন না, করলেও মনে রাখেন না।
হতাশার কথা বলতে বলতে, চারদিকে নেতিবাচক কথা শুনতে শুনতে হয়তো আমাদের এই বদ্ধমূল ধারণা হয়ে যায়, দেশটার কিছু হবে না। অথচ যে মানুষটি বিদেশে লাইন ভাঙে না, রাস্তায় ময়লা ফেলে না, রাস্তায় সিগন্যাল মেনে চলে, সে কেন দেশে এসে এসব অন্যায় করে এবং এটাকেই স্বাভাবিক বলে মনে করে? দেশের প্রতি এসব অন্যায় আচরণ থেকে সাংবাদিকেরাও মুক্ত নন। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, শিক্ষক ও সাধারণ নাগরিক—কেউ মুক্ত নন।
এবার এক সত্যিকারের মায়ের গল্প বলি। ষাটের দশকের কথা। বড়লোক বাবার ছেলে আজাদ ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। বাবা আরেকটা বিয়ে করলেন। মা এই দ্বিতীয় বিয়ের প্রতিবাদে প্রাসাদের মতো বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন ১২ বছরের আজাদকে নিয়ে। বহু কষ্টে একমাত্র ছেলে আজাদকে মানুষ করলেন।
১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। আজাদকে বন্ধুরা বলল, ‘আমাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে যাবি?’ আজাদ বলল, ‘মা ছাড়া আমার কেউ নেই, মায়েরও আমি ছাড়া কেউ নেই। মা অনুমতি দিলে তবেই আমি মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারি।’ মা বললেন, ‘আমার জন্য তোমাকে আমি মানুষ করি নাই। নিশ্চয় তুমি যুদ্ধে যাবে।’
আজাদ যুদ্ধে গেল। পাকিস্তানি সেনারা বাড়িতে হামলা করে ধরে নিয়ে গেল আজাদকে। ওকে রমনা থানায় রাখা হয়েছে। মা তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে দালালেরা বলল, ‘আজাদকে বলেন রাজসাক্ষী হতে। ওকে ছেড়ে দেওয়া হবে।’
মা আজাদের সঙ্গে দেখা করে বললেন সম্পূর্ণ উল্টো কথা। বললেন, ‘শক্ত হয়ে থেকো বাবা। কোনো কিছু স্বীকার করবে না। বন্ধুদের নাম-ঠিকানা বলবে না।’ আজাদ বলল, ‘মা, কত দিন ভাত খাই না। কাল আমার জন্য ভাত নিয়ে আসবে।’ পরের দিন মা ভাত নিয়ে গেলেন ছেলের জন্য। দেখলেন, ছেলে নেই।
আজাদ আর কোনো দিনও ফিরে আসেনি। মা ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। এই ১৪ বছরে কোনো দিন ভাত খাননি। এ রকম অনেক অনেক মা রয়েছেন, যাঁরা এই দেশের জন্য, মাতৃভূমির জন্য নিজের সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠাতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা বোধ করেননি।
ভাষাশহীদেরা প্রাণ দিয়ে আমাদের ভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছেন; মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের একটা স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছেন। পৃথিবীতে এই দেশ গরিব থেকে যাবে, পৃথিবীর দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বারবার স্থান পাবে, রাজনৈতিক সংঘাত কি চলতেই থাকবে—এটা হতে পারে না। এই দেশ কি সেই দেশই থেকে যাবে, যে দেশে বই-কলম ছুড়ে ফেলে অস্ত্র নিয়ে ছাত্র-যুবক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করবে? যেখানে ছেলেরা মেয়েদের এসিড ছুড়ে মারে? মেয়েদের উত্ত্যক্ত (ইভ টিজিং) করা চলতেই থাকবে? আরও কত অন্যায়-অপরাধই না আমরা করি!
কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বাংলাদেশের বড় সাফল্য রয়েছে। আমাদের অর্জনের তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য বা এমডিজি অর্জনে অনেক দূর আমরা সফল হয়েছি। এরই মধ্যে দারিদ্র্যসীমার নিচে লোকসংখ্যা ৫৬ দশমিক ৬ শতাংশের জায়গায় ৪০ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা ৬০ দশমিক ৫ শতাংশের স্থানে ৯১ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। শিশুমৃত্যুর হার পাঁচ বছরের নিচে ১০০০ জনে ১৪৬ থেকে ৬৭ জনে নেমে এসেছে। নবজাতকের মৃত্যুর সংখ্যা একইভাবে ৯২ থেকে নেমে ৪৫-এ এসেছে। প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যুর সংখ্যা প্রতি এক লাখে ৫৭৪ জন থেকে ৩৮৪ জনে নেমে এসেছে। সুতরাং আশাহত হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশে এগিয়ে চলেছে।
এ ছাড়া বেশ কিছু খাতে গত এক দশকে আমাদের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বেড়েছে; ১৯৯১-২০০০ সময়ে যা ছিল ৪ দশমিক ৮ শতাংশ, ২০০১-২০০৮ সময়ে তা দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ, এর মধ্যে গত তিন অর্থবছরের গড় প্রবৃদ্ধি হলো ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। মাথাপিছু আয় বেড়েছে; ২০০৫-০৬ সময়ে যা ছিল ৪৪৭ ডলার, ২০০৯-১০ সময়ে তা হয়েছে ৬৮৪ ডলার। খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে, ১৯৮৬-৮৭ অর্থবছরে মোট চাল উৎপাদিত হয়েছিল এক কোটি ৫৪ হাজার মেট্রিক টন আর গম হয়েছিল ১০ লাখ ৯২ হাজার টন। আর এখন মোট চাল ও গম উৎপাদিত হচ্ছে তিন কোটি ৩৬ লাখ টন। বর্তমানে বাংলাদেশ খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ বলা যায়। রপ্তানি-আয় বেড়েছে; ১৯৮০-৮১ সময়ে তৈরি পোশাক খাতে আয় ছিল মাত্র ৩১ লাখ ডলার। আর এখন তা এক হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। আর ২০০৯-১০ অর্থবছরে মোট রপ্তানি-আয় হয়েছে ১ হাজার ৬২১ কোটি ডলার। প্রবাসী-আয় বেড়েছে; ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে প্রবাসী-আয় বা রেমিট্যান্স এসেছিল মাত্র ১৭০ কোটি ডলার। এই আয় এখন এক হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। জিডিপির ১০ শতাংশের বেশি এখন আসছে প্রবাসী-আয় বা রেমিট্যান্স থেকে। অন্যদিকে বিশেষ সাফল্য হলো, আমরা বিদেশি সাহায্য-নির্ভরতা কমিয়েছি। ১৯৮০-৮৫ সময়ে যে সাহায্য ছিল জিডিপির ৬ দশমিক ৩ শতাংশ, ২০০৫-০৮ সময়ে সেই সাহায্য কমে হয়েছে ২ দশমিক ১ শতাংশ। এসব তথ্য আমাদের অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া। সুতরাং আমাদের ভয়ের কিছু নেই। বাংলাদেশ অবশ্যই এগিয়ে যাবে।
আমরা আমাদের অর্জনগুলো থেকেও শক্তি নেব, প্রেরণা নেব। পৃথিবীকে আমরা দিয়েছি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, দিয়েছি ক্ষুদ্রঋণের ধারণা। আমরা এনেছি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার। আমাদের আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন, এক বাংলাদেশি আমেরিকাকে দিয়েছে সবচেয়ে উঁচু ভবন, আর এই দেশে আমাদের আছে অনন্য স্থাপত্য নিদর্শন লুই আই কানের নকশা করা জাতীয় সংসদ ভবন। শান্তিরক্ষায় পৃথিবীর দেশে দেশে শান্তির পতাকা নিয়ে কাজ করে চলেছেন আমাদের সাহসী সেনাসদস্যরা। আমাদের সাফল্য তো কম নয়।
আমরা আশাবাদী—বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। আমার সোনার বাংলা, তোমার মুখ আর কোনো দিনও মলিন হতে দেব না। আমরা ১৬ কোটি মানুষ আমাদের মায়ের মুখে হাসি ফোটাবই। বাংলাদেশকে এক আলোকিত দেশ হিসেবে গড়ে তুলবই।
আজকের যুগপূর্তি অনুষ্ঠানের আনন্দঘন এই মিলনমেলায় আমাদের আবারও দৃঢ় অঙ্গীকার—প্রথম আলো সত্য ও সুন্দরের পথে নিষ্ঠাবান থাকবে। আমরা ভয়ভীতি, মামলা-ষড়যন্ত্র যত কিছুই হোক না কেন, স্বাধীন ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় অবিচল থাকব।
[প্রথম আলোর এক যুগ পূর্তিতে গত ৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় আয়োজিত বিশেষ অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তৃতা।]
মতিউর রহমান: সম্পাদক, প্রথম আলো।

No comments

Powered by Blogger.