চারদিক-সুহূদের সঙ্গে by মাহবুবা ইয়াসমীন

অক্টোবরের ওই দিনটা ছিল নির্মলচন্দ্র গোপের জন্মদিন। বিশ্ববিদ্যালয়ে এটাই ছিল তাঁর শেষ জন্মদিন। তাই তিনি জন্মদিনের আয়োজনটা করলেন একটু ব্যতিক্রমী। বরাবরই নির্মলের বন্ধুমহলটা বেশ বড়। এ জন্মদিনে তিনি তাঁর কাছের ৩৫ জন বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করেন এবং জানান, ওই অনুষ্ঠানেই উপহার দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে, তাই কেউ যেন উপহার নিয়ে না আসে।


জন্মদিনের অনুষ্ঠানে একটি মাটির ব্যাংক দেওয়া হয় এবং তাঁর বন্ধুরা উপহারের বদলে টাকা ওই ব্যাংকে রাখেন। ব্যাংকে জমা হওয়া টাকাগুলোই আশ্রমশিশুদের মধ্যে নতুন পোশাক বিতরণের মাধ্যমে ব্যয় করা হয়। পরবর্তী সময়ে অনেকে আগ্রহী হলে সংগঠনটির জন্য একটি নাম চাওয়া হয়। কয়েকটি নামের মধ্যে ‘সুহূদ’ সংগঠনের নাম হিসেবে গৃহীত হয়। সুহূদ অর্থ বন্ধু। অর্থাৎ নিপীড়িত, নিগৃহীত, আর্তনির্যাতিত মানুষের বন্ধু ‘সুহূদ’।
সেই থেকেই শুরু। সুহূদের বয়স মাত্র এক বছর। বলা যায় নবজাতক একটি সংগঠন সুহূদ। নিঃস্বার্থ ব্রত নিয়ে কিছু তরুণ-তরুণীর চেষ্টায় এ শিশুসংগঠন সুহূদ এ বছরই ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও বুয়েটে তার শাখা বিস্তার করেছে।
১০ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে অবস্থিত আরসি মজুমদার মিলনায়তনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত সংগঠন ‘সুহূদ’ এক ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এ অনুষ্ঠানে শারদীয় দুর্গাপূজা ও ঈদুল আজহা উপলক্ষে অনাথ শিশু ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর ক্যানটিন বয়দের মধ্যে নতুন বস্ত্র বিতরণ করা হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। অধ্যাপক সীতেশচন্দ্র বাশারের//// সভাপতিত্বে বস্ত্র বিতরণ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান, অধ্যাপক মো. অহিদুজ্জামান এবং সুভাষ সিংহ রায়।
পুরো অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন সুহূদের আহ্বায়ক শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্নাতকোত্তর বর্ষের শিক্ষার্থী নির্মলচন্দ্র গোপ। তাঁর বক্তব্য থেকেই জানা যায় সুহূদের সূচনার ইতিহাস। গত বছর ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই ঢাকা অনাথ আশ্রমে গিয়েছিলেন নির্মল। সেখানে গিয়েই লক্ষ করেন ছেঁড়া ও মলিন কাপড়েই এখানে শিশুদের দিনাতিপাত। নির্মলকে তখনই ব্যাপারটা বেশ নাড়া দেয়। তখন থেকেই তিনি ঠিক করেন এ শিশুদের জন্য কিছু করার। কিন্তু একার পক্ষে খুব বেশি কিছু করাও ছিল অসম্ভব। হঠাৎ একটি ব্যতিক্রমী চিন্তা মাথায় আসে নির্মলের।
সুহূদের আয়ের উৎস সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানটির অর্থ সম্পাদক সমীরণ বাড়ৈ জানান, ‘কর্মীদের চাঁদাই অর্থের প্রধান উৎস। স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমের জন্য তহবিল বাড়াতে সুহূদ শুরু করেছে মাটির ব্যাংক প্রকল্প। সংগঠনের পক্ষ থেকে সদস্যদের একটি করে মাটির ব্যাংক দেওয়া হয়েছে। ভিক্ষুকদের/// নানাভাবে দেওয়া টাকাগুলো জমা রাখা হয় ব্যাংকে। নির্দিষ্ট সময় পর এগুলো ব্যয় করা হবে দুস্থদের কল্যাণে। তবে সেই সঙ্গে উপদেষ্টা ও দাতাদের মাধ্যমে প্রাপ্ত অনুদানও সুহূদের অর্থ জোগানে সহায়তা করে বলে তিনি জানান।
বছর ধরে জমানো সিকি-আধুলি নিয়ে সুহূদ সাধ আঁটে সাধ্যের কুলোয়। গত এক বছরে পাওয়া সব অর্থ পূজা ও ঈদে সুহূদ অনাথ ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মধ্যে নতুন পোশাক বিতরণ করে।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, শিগগিরই সুহূদ সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য মৌলিক ও ব্যবহারিক শিক্ষা প্রশিক্ষণ প্রকল্প শুরু করতে যাচ্ছে। ন্যূনতম সাক্ষরতা ও হিসাব-কিতাব এবং কর্মজীবনের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রদানই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। সেই সঙ্গে আজকাল সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মধ্যে মাদকাসক্তের হার বাড়ছে, তাই এ শিশুরা যেন মাদকমুক্ত থাকতে পারে, সেই কৌশলও শেখানো হবে এখানে।
নির্মল গোপ তাঁর বক্তব্যে আরও বলেন, পথশিশু, শিশুশ্রমিক তথা অবহেলিত শিশুদের শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে অনেক সময় রাস্তার পাশে, খোলা আকাশের নিচে, মার্কেটের ছাদে কিংবা ছাউনির নিচে ছোটখাটো কোনো স্কুল করা হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় বা অন্যান্য নানা জটিলতায় এসব স্কুল কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বন্ধুকেন্দ্রিক ওই সব সংগঠনের প্রধান সমস্যা হলো, মূল উদ্যোক্তা ছাত্রছাত্রীরা যখনই পড়াশোনা শেষে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করতেন, তখনই ওই সংগঠনগুলোও থেমে যেত। কিন্তু সুহূদ এ ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসী। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত একক সংগঠন সুহূদ। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সহায়তায় প্রতিষ্ঠানটি একটি সাংবিধানিক রূপ লাভ করেছে। তাই পরবর্তী সময়ে উদ্যোক্তাদের আদর্শ নিয়ে নতুনেরা এ সংগঠনকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
সুহূদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি সম্পর্কে সংগঠনের সভাপতি রাজীব পণ্ডিত জানান, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মুখে হাসি ফোটানোই সুহূদের প্রধান লক্ষ্য। আর এ জন্য চাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমনা ও উদার শিক্ষার্থীদের সহায়তা। তিনি আরও বলেন, একটি সুবিধাবঞ্চিত শিশুর মুখে হাসি ফোটাতে পারাই সুহূদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। সুহূদ মনে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থী আর্তমানবতার জন্য কিছু করতে চায়। তাই সবাই সুহূদ। সুহূদের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য সম্পর্কে সুহূদ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুশান্ত সরকার বলেন, দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান, হলের ক্যানটিন বয়দের জন্য শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ঘটনায় বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানো, শীতবস্ত্র সংগ্রহ এবং বিতরণ সুহূদের ভবিষ্যৎ লক্ষ্যের আওতাভুক্ত।
এ জন্য শুধু প্রয়োজন এক ঝাঁক নিবেদিতপ্রাণ ছাত্রছাত্রীর অংশগ্রহণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল ও বুয়েটের যেকোনো আগ্রহী শিক্ষার্থী সুহূদের সদস্য হতে পারেন। যোগাযোগ: Shurid.du2010@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.