মেহদি হাসান-গজলের সম্রাট by রুনা লায়লা

বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশ্বের দরবারে গজলকে অনেক উঁচু একটা অবস্থানে নিয়ে গেছেন। গজলের সম্রাট তিনি। পাকিস্তানের চলচ্চিত্রশিল্পে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। মানুষকে সুরে সুরে তিনি মাতিয়েছেন জীবদ্দশায়, এখনো শ্রোতা তাঁর গান শোনে তন্ময় হয়ে। মোটক থা সংগীতের জগতে প্রবাদতুল্য একজন তিনি।
সেই মেহদি হাসান সাহেবের সান্নিধ্য, তাঁর সঙ্গে গান করতে পারা আমার জীবনের বড় পাওয়া নিঃসন্দেহে।
ষাটের দশকের কথা। আমার বয়স তখন কত হবে! বড়জোর ১৪-১৫। পাকিস্তানি একটা ছবিতে গান গাইতে গেলাম, সহশিল্পী মেহদি হাসান সাহেব! সাংঘাতিক শিহরিত আমি—এত বড় মাপের একজন শিল্পীর সঙ্গে গাইব! অথচ রেকর্ডিংয়ের আগে-পরে বুঝতেই দিলেন না, আমি বয়সে তাঁর অনেক ছোট। গান গাওয়ার সময় বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করলেন তিনি। আমার মনে চিরস্থায়ী হয়ে রইল সেই স্মৃতি।
ভীষণ স্নেহ করতেন আমাকে। পছন্দ করতেন আমার গায়কি। যখনই দেখা হতো, কাছে ডাকতেন, কথা বলতেন। চমৎকার আড্ডা জমত তিনি থাকলে। ছিলেন সদালাপী, নিরহংকার মানুষ। আড্ডায় মাঝেমধ্যে গানও গাইতেন মুড এলে।
তারপর বাংলাদেশে এসেছিলেন মেহদি সাহেব। বাংলাদেশি একটা ছবিতে গানও করেছি আমরা একসঙ্গে। আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। ভীষণ অবাক হতাম তাঁকে কাছ থেকে দেখে। আগে তো রেডিওতেই গান শোনা হতো বেশি। রেডিও বাজালেই শুনতাম তাঁর গান। একদম ছেলেবেলায় ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। প্রায় ৪০-৫০টার মতো উর্দু ছবিতে একসঙ্গে গান করেছি আমরা। আমার প্রশংসা করলে ভীষণ উৎসাহ পেতাম। আমি গজলের তালিম নিয়েছি মেহদি হাসান সাহেবের বড় ভাইয়ের কাছে। তখনই প্রথম দেখা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। সবাই জানেন, জীবনে অনেক কষ্ট সয়েছেন এই মহান শিল্পী। খুব কাছ থেকে দেখেছি তাঁকে, দেখেছি তাঁর পথচলা। সংগীতের ব্যাপারে তাঁর অনুরাগ অবশ্য-অনুকরণীয়।
বছর চার-পাঁচ আগে করাচি গিয়েছিলাম। ইউনিলিভারের লাক্স এবং পাকিস্তান চলচ্চিত্র শিল্পের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠানের আসর বসেছিল সেবার। সেখানে আজীবন সম্মাননা জানানো হয় মেহদি সাহেবকে। তখন তিনি ভীষণ অসুস্থ, পক্ষাঘাতগ্রস্ত; হুইলচেয়ারে চলাফেরা করেন। স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে গেছে। তার মাঝেও আমাকে দেখে নাম ধরে ডাকলেন! পাশে বসালেন। বললেন অনেক কথা।
মেহদি সাহেবের সঙ্গে আরেকবার দেখা হয়েছিল লন্ডনে, নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে। সনু নিগমের সঞ্চালনায় ‘সা রে গা মা’ অনুষ্ঠানটিতে একই মঞ্চে গান গেয়েছিলাম আমরা। সেখানে আরও ছিলেন গোলাম আলী, ফরিদা খানম ও জগজিৎ সিংয়ের মতো শিল্পীরা। খুব ভালো কটা দিন কেটেছিল সেবার। একসঙ্গে বেশ কটা দিন কাটিয়েছিলাম আমরা। পেয়েছি মেহদি হাসান সাহেবের সান্নিধ্য। তিনি তো এখন নেই, তাঁর গান শুনি তন্ময় হয়ে। তাঁর গজল আমার হূদয় ছুঁয়ে যায়, যেমন ছুঁয়ে যায় আর সবার।
অনুলিখন: মাহফুজ রহমান

No comments

Powered by Blogger.