উইকিলিকস-ইরাকে আমেরিকার গোমর ফাঁস by লিন্ডা এস হার্ড

আমেরিকার গোমর ফাঁসকারী উইকিলিকসের সাহসের তারিফ করতেই হয়! এ ধরনের বিবেকি মানুষজন ছাড়া ভিয়েতনাম যুদ্ধের আসল সত্যগুলো জানা যেত না। জানা যেত না মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি কিংবা ইসরায়েলের গোপন পারমাণবিক বোমাভান্ডার অথবা আবু গারিব কারাগারের পাশবিক নির্যাতনের কথা।


গণতন্ত্রে নির্বাচিত সরকারের জনগণের সেবক হওয়ার কথা এবং কী হচ্ছে জনগণের নামে, তা জনগণকে জানতে দেওয়ার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে অনেক মানুষই তা জানতে চায় না এবংসরকারও জানায় না। তার পরও যাঁরা সত্য তুলে আনেন, হোক সেই সত্য যতই কুৎসিত, বিরাট সম্মান তাঁদের প্রাপ্য। অথচ তাঁদের নামে রটানো হয় কুৎসা, তাঁদের চাকরি যায় বা তাঁরা শাস্তি পান। যিনি ন্যায়বিচারে বিশ্বাস করেন তাঁরই উচিত উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ এবং মার্কিন সেনাবাহিনীর বেনামি তথ্যদাতাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা। ইরাকে আমেরিকা কী বিভীষিকা চালাচ্ছে, তা তাঁরাই ফাঁস করে দিয়েছেন।
জুলিয়ান এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন ‘ফেরারি আসামির’ মতো। মার্কিন ও অস্ট্রেলীয় সরকার ভয় দেখিয়েছে যে জুলিয়ানকে হয়তো বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে অথবা মার্কিন নাগরিকেরা তাঁকে হত্যার হুমকি দিতে পারে। কেননা জুলিয়ানের ওয়েবসাইটে বিবিসি, আল-জাজিরা, গার্ডিয়ান, সুইডিশ এসভিটি, ফরাসি লা মঁদের সঙ্গে একযোগে ইরাক যুদ্ধসংক্রান্ত চার লাখ গোপন মার্কিন নথিপত্র প্রকাশ করা হয়। এ ঘটনাকে কেবল চাঞ্চল্যকর বললে কমই বলা হয়।
কোনো যুদ্ধে যদি সেনাদের থেকে বেসামরিক মানুষজনের মৃত্যুর হার অনেক বেশি হয়ে যায়, তখন বুঝতে হয় মারাত্মক কোনো গোলমাল আছে।
মার্কিন সেনাবাহিনীর দৈনন্দিন কার্যক্রমের তালিকাগুলো থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০০৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০০৯ সালের শেষ দিন পর্যন্ত ইরাকে এক লাখ নয় হাজার ৩২টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর ৬০ ভাগেরও বেশি হলো নিরীহ মানুষ। অথচ এর আগে মার্কিন-ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ বলেছিল, তারা লাশ গোনে না। এত নিরীহ মানুষের মৃত্যুর কথা তারা জেনেও অস্বীকার করে গেছে। এ ছাড়া ইরাকি সেনাদের নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যালীলা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারেও তাদের স্পষ্ট সম্মতি ছিল।
উইকিলিকস দেখিয়েছে, কীভাবে আত্মসমর্পণকারী বিদ্রোহীদের ওপর অ্যাপাচি হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে মারা হয়েছে। কীভাবে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ মার্কিন-ব্রিটিশ সেনাদের তল্লাশি চৌকিতে হত্যার শিকার হয়েছে। কীভাবে আট বছরের ইরাকি কিশোরী রাস্তায় খেলতে থাকা অবস্থায় ব্রিটিশ সেনার গুলিতে মরে গেছে।
এসব ঘটনা ফাঁস হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের এই দাবিও বাতিল হয়ে গেল যে ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র না থাকলেও ইরাককে স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যই মার্কিন সেনারা সেখানে আছে। বিস্ময়ের কিছু নেই যে বেশির ভাগ ইরাকিই মনে করে, এর থেকে তারা সাদ্দামের শাসনেই ভালো ছিল।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন উইকিলিকসের নিন্দা করেছেন। এতে নাকি মার্কিন সেনা ও বেসামরিক আমেরিকানদের নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। হিলারির মধ্যে যদি বিন্দুমাত্র নৈতিকতা থাকত, তাহলে তিনি প্রথমেই তাঁর প্রশাসনকে এসব নিষ্ঠুরতা থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করতেন। এরপরে ইরাকি জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে আর্থিক ক্ষতিপূরণের অঙ্গীকার করতেন।
ইরাকের প্রধানমন্ত্রী নুরি আল মালিকিও খুশি নন। তাঁর জ্ঞাতসারে তাঁর স্বদেশীয়দের ওপর হত্যা-নির্যাতন চালানো হচ্ছে, এ কথা জানার পর তাঁর আর প্রধানমন্ত্রী থাকার বৈধতা থাকে না।
জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি ম্যানফ্রেড নোভাক বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উচিত, এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করা। তাঁর ভাষায়, ‘ওবামা ক্ষমতায় এসেছেন নীতিকথা বলে। তিনি বলেছিলেন, আমরা আর যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের প্রধান মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী দেশ হিসেবে দেখতে চাই না।’ কিন্তু এ ধরনের কোনো তদন্ত হবে না। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেও বিষয়টি আলোচিত হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন বাহিনী ইরাকে ইতিহাসের বৃহত্তম অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই নিকৃষ্ট অপরাধের কোনো শাস্তি তারা পাবে না। মিথ্যা কথা বলে তারা একটি দেশকে ধ্বংস করেছে, এর জনগণকে হত্যা করেছে, ধর্ষণ করেছে নারীদের এবং ভয়াবহ নির্যাতন করেছে বন্দীদের।
দুঃখজনক এটাও যে, যে পশ্চিমারা তাদের সেনাদের অন্য দেশের মাটিতে যুদ্ধে পাঠানোর সময় অভিনন্দন জানিয়েছে, এখন তারা যেন অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছে, ইরাকের মর্মান্তিক দশায় তাদের কিছুই এসে-যায় না। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মতো মানুষ আছে, যাদের এখনো মন আছে, আছে বিবেকের দায়।

গালফ নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ।
 লিন্ডা এস হার্ড: মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ।

No comments

Powered by Blogger.