স্বর্ণার দুই অধ্যায় by শফিক আল মামুন

বিষয়টি এমন! স্বর্ণাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় মঞ্চে বা টেলিভিশনে প্রচার হওয়া আপনার অভিনীত প্রথম নাটকের নাম কী? কিংবা যদি বলা হয় কবে নাটকটি মঞ্চে এসেছিল বা টেলিভিশনে প্রচার হয়েছিল? উত্তরে তিনি কিছুক্ষণ হাসবেন। তারপর একটু থামবেন। বলবেন, ‘মনে নেই। মনে করতে পারছি না।


জানেন, আমার না কোনো কিছু একদম মনে থাকে না।’ এই ভুলে যাওয়া কেন? প্রশ্ন ছুড়ে দিই তাঁর দিকে। সোজাসাপটা বলে দেন, ‘যা কিছু ঘটে যায়, বা যা মনে রাখার কোনো দরকার মনে করি না, তা নিয়ে ভাবনাও কাজ করে না। ফলে স্মৃতি থেকে তা মুছে যায়। তখন আর মনে করে বলতে পারি না। বলতে পারেন, এটা আমার একটা অদ্ভুত স্বভাব।’ এই অংশটুকুর সঙ্গে আরেকটি বাক্য যোগ করার আগে তিনি আবারও একটু হাসলেন। বললেন, ‘আমার মায়ের জন্মদিনটা অনেক কষ্টে প্রতিবছর মনে রাখি।’ এই হলেন স্বর্ণা। মঞ্চ ও টেলিভিশনের অভিনেত্রী। কিন্তু পাঠক তাঁকে নিয়ে পরের ঘটনা জানার পর একটু অবাকই হবেন বৈকি।
আচ্ছা, এই যে সবকিছু ভুলে যাওয়ার বাতিক, তাহলে মঞ্চে দেড়-দুই ঘণ্টা সময় নিয়ে অনর্গল সংলাপ আওড়ান কীভাবে? আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করি। এবার চটজলদি তাঁর উত্তর, ‘এই জায়গাটা তো আমার নিজের। এটাকে নিয়ে আমি প্রতিনিয়ত ভাবি। আমার দায়িত্ববোধের জায়গা এটি। ফলে ভুলে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।’ প্রাচ্যনাটের নিয়মিত নাট্যকর্মী স্বর্ণার থিয়েটার নিয়ে ভাবনার শেষ নেই। নিজেকে তৈরি করতে চান মঞ্চের একজন পাক্কা অভিনেত্রী হিসেবে। ছয় বছর ধরে সেই অভিযানে নেমেছেন তিনি। তাঁর মঞ্চে কাজের ফিরিস্তি দেওয়ার আগে ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধের এই জায়গাটাতে আগমনের গল্প শুনে নিই।
নিজের ইচ্ছায় থিয়েটারে কাজ শুরু। ছোটবেলায় টেলিভিশনে ভদ্দরনোক নাটকটি দেখার সুযোগ হয় তাঁর। নাটকটি দেখার পর থিয়েটার নিয়ে নিজের মধ্যে একটা আলাদা উপলব্ধি তৈরি হয়। থিয়েটার করার স্বপ্ন নিয়ে সময় বয়ে চলে। এরপর স্কুল-কলেজ পেরিয়ে ভর্তি হন বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা ইনস্টিটিউটের গ্রাফিকস ডিজাইন বিভাগে। প্রথম বর্ষে পড়াকালীন চারুকলার ছেলেমেয়েদের করা একটা পথনাটক দেখে থিয়েটারের ধারণা তাঁর কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। পরে জানতে পারেন নাটকটির অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সবাই থিয়েটারের সঙ্গে জড়িত।
পরের ঘটনা স্বর্ণার মুখ থেকে শুনি, ‘ঘটনাটা ২০০৬ সালের। মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। প্রথম বর্ষে পড়ার সময়ই প্রাচ্যনাটের থিয়েটার স্কুলে ভর্তি হই। আমার নিজের আঁকা ছবি বিক্রি করে থিয়েটার স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। ছয় মাসের কোর্সের ওই ব্যাচে আমি প্রথম হয়েছিলাম। পরে প্রাচ্যনাটে যোগ দিই। এর পর থেকে টানা কাজ করে চলছি।’ এ পর্যায়ে এসে মঞ্চে কী নিয়ে ব্যস্ততা? তাঁর কথা শেষে প্রশ্নটা করি। ‘দলের চলতি দুটি প্রযোজনা রাজা এবং অন্যান্য আর মায়ের মুখ। এবং বিকল্প চরিত্র হিসেবে করছি পুনর্জন্ম নাটকটি।’ বললেন স্বর্ণা।
এদিকে টেলিভিশন নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে স্বর্ণার আরেক অধ্যায় সূচনা হলেও প্রথমদিকে টেলিভিশন নাটকে তেমন আগ্রহী ছিলেন না তিনি। আফসানা মিমির কাছের মানুষ নাটকে অভিনয় দিয়ে টেলিভিশনে যাত্রা শুরু। শুরুটা হলেও এ কাজটি ওই সময় আর নিয়মিত করেননি। মাঝখানে এই সময়ের ব্যবধানটাও বড় হয়ে যায়। কেন? প্রশ্ন নিয়ে তাঁর কাছে যাই। স্বর্ণা বললেন, ‘ওই সময়টাতে টেলিভিশন নাটকে আমার আগ্রহ ছিল কম। ভালো পাণ্ডুলিপি ও ভালো নির্দেশকের দিকেই আমার খেয়াল বেশি ছিল। ফলে কাজও কম করেছি।’
কিন্তু একটা সময় তিনি আর ওই ছকে নিজেকে আটকে রাখেননি। অভিনয়ে চরিত্রের বৈচিত্র্যের জন্য টেলিভিশন নাটকে নিয়মিত হলেন। স্বর্ণা কী বলেন? ‘ভেবে দেখলাম, এখানে নিয়মিত কাজ করা গেলে নানা ধরনের চরিত্রে নিজেকে তৈরি করা যাবে। অভিজ্ঞতাও হবে।’ এই জায়গাটাকে আরও পাকাপোক্ত করতে তিনি ২০০৯ লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার হওয়ার প্রতিযোগিতায় নাম লেখান। চূড়ান্ত পর্বে শীর্ষ দশের তৃতীয় স্থানটি দখলে নিয়ে তিনি হয়ে যান লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার। এ ব্যাপারে স্বর্ণার যুক্তি, ‘লাক্স চ্যানেল আই সুপার স্টার প্রতিযোগিতায় আসার কারণ ছিল মিডিয়ায় নিজের ক্ষেত্রটা আরও প্রসারিত হবে, বয়ে আনবে সম্মান।’ হয়েছেও তা-ই। সুপারস্টার হওয়ার পরপরই টেলিভিশন নাটকে তাঁর পথ হয়েছে মসৃণ। একে একে অভিনয় করেছেন ফ্যাশন, উপসংহার, গ্রন্থিকগণ কহে, লালছাতা, ভবিষ্যতের স্মৃতি, পেন্সিল হিল, সামান্তা, প্রভৃতি নাটকে। সামান্তা, গ্রন্থিকগণ কহের ডোম চরিত্রগুলো তাঁকে দর্শকের আরও কাছে নিয়ে গেছে। এই ধারাবাহিকতায় টেলিভিশনে এখন ব্যস্ততা কী নিয়ে? ‘সোনালি আলো, মুম্বাসা, হেলফ ডি—এই তিনটি নাটকের শুটিংয়ে অংশ নিচ্ছি।’ বললেন স্বর্ণা।
মঞ্চ-টেলিভিশন—এই দুটি মাধ্যমেই স্বর্ণা এখন নিয়মিতই কাজ করছেন, কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। কোন মাধ্যমে কাজ করে তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন? উত্তরে স্বর্ণা নিজের মতো করেই বললেন, ‘দুটি জায়গায় দুই রকমের স্বাচ্ছন্দ্যবোধ কাজ করে। থিয়েটার আমার কাছে পরিবারের মতো। পরিবার থেকে যেমন আমি শিখি, একইভাবে থিয়েটার থেকেও জ্ঞানার্জন করি। রাগ, অভিমান, ভালোবাসা—পরিবারের মতো এখানেও এসব ঘিরে আছে। আবার টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করি। এখানে অভিনয়ের পরিবর্তে আমাকে অর্থ দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং সেটাও এক ধরনের দায়িত্ববোধ মাথায় নিয়ে করতে হচ্ছে এবং তা করতে হবে। এখানকার কাজেও আছে ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ।’

No comments

Powered by Blogger.