নিরাপদ সড়ক-সড়ক দুর্ঘটনা এবং আমরা by মোহাম্মদ গোলাম মাওলা

সড়ক দুর্ঘটনা হলে আমাদের প্রতিক্রিয়া বিগত ৬০ বছরে একই রকম রয়ে গেছে। পথচারী ও সাইকেলের মধ্যে দুর্ঘটনা হলে সর্বদাই সাইকেলের দোষ, সাইকেল ও রিকশার মধ্যে হলে রিকশার দোষ, রিকশা ও মোটরসাইকেলের মধ্যে হলে মোটরসাইকেলের দোষ, মোটরসাইকেল ও কারের মধ্যে হলে কারের দোষ,


কারের সঙ্গে ট্রাক বা বাসের হলে বাস বা ট্রাকেরই দোষ। আর পথচারীরা সর্বদা দোষমুক্ত। জেব্রা ক্রসিং ছাড়া বা ফুটওভারব্রিজের নিচ দিয়ে পার হতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়লেও দোষ সব সময় চালকের হয়ে থাকে। এ জন্য চালককে মাশুল দিতে হয়—হয় তাঁর যানটি ভাঙা হবে বা উপরি পাওনা হিসেবে পিটুনিও খেতে হবে।
তাই যেকোনো সড়কে, বিশেষ করে মহাসড়কে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হলে ওই যান ও এর চালকের নিস্তার নেই। তার ওপর ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হবে, বেশ কিছু যানবাহন ভাঙচুর করা হবে। যানবাহনের মালিকেরা তখন জানতেও পারবেন না, কেন তাঁদের যান ভাঙচুর করা হচ্ছে। দু-চার ডজন আহত হবেন, খবর পেয়ে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনবে। তখন জনতার দাবি হবে—তখনই সেখানে একটা স্পিডব্রেকার বসাতে হবে। ডিসি বা ইউএনও ওই প্রতিশ্রুতি দিলে হয়তো বা তখন সড়ক অবরোধ তুলে নেওয়া হবে। কিন্তু ওই ভাঙচুরে যে জাতীয় সম্পদের ক্ষতি হলো, তার জন্য কেউ দায়ী থাকবে না। রাস্তা বন্ধ থাকায় যে সময়ের অপচয় হলো, তার কোনো হিসাব হয় না। উল্লেখ্য, স্পিডব্রেকার যেখানে তৈরি হলো, সেই একই স্থানে যে ভবিষ্যতে আবার কোনো দুর্ঘটনা হবে না, তারও কোনো নিশ্চয়তা থাকে না।
সড়ক দুর্ঘটনার কারণ আমাদের সবারই প্রায় জানা আছে। মহাসড়ক, জেলা সড়ক বা অন্যান্য সড়কে সব রকম যানবাহন চলাচল করে। গরু, ছাগল, বড়-ছোট মানুষ মহাসড়ক পার হয় যেকোনো স্থান দিয়ে, যখন খুশি। রিকশা, গরুর গাড়ি, ভ্যান, নসিমন প্রভৃতি আইনের কোনো তোয়াক্কা না করেই স্বাধীনভাবে মহাসড়কে চলাচল করছে। আর রাজধানীতে যানবাহন চলাচল একদম ফ্রি-স্টাইলে হয়ে থাকে। রিকশা ও মোটরসাইকেল উল্টো পথে চললেও কেউ তাকে বাধা দেয় না। পথচারী হঠাৎ হাত তুলে বা আঙুল দেখিয়ে রাস্তা পারাপার শুরু করে, তখন দুর্ঘটনা এড়ানোর দায়িত্ব সব সময় যানের। মুরগির খাঁচার মতো করে ভ্যান বানিয়ে তাতে স্কুলের কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের যে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করানো হচ্ছে, তা রীতিমতো অমানবিক ও বিপজ্জনক। এ ছাড়া ওই ভ্যানগুলো প্রায় সময়ই রাস্তার বিপরীত দিক দিয়ে উল্টো পথেই চলাচল করছে, আর এ ব্যাপারে পুলিশ নির্বিকার। মা তাঁর সন্তানকে, আমজনতা এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও ট্রাফিক আইন না মেনে উল্টোপথে রিকশায় বা মোটরসাইকেলে ফ্রি-স্টাইলে চলাচল করছেন। সবার ধারণা, আইন আমি ছাড়া অন্য সবার জন্য প্রযোজ্য।
গত ১১ আগস্ট সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২০ জন নিহত আর ১০৬ জন আহত হয়। ওই দিন কুমিল্লায় এক ইংরেজির শিক্ষক দুর্ভাগ্যজনকভাবে ট্রাকচাপায় মারা যান। ফলে তিন ঘণ্টা সড়ক ও রেলপথ উভয়ই জনগণের অবরোধের শিকার হয়। জনতা ৩০টি গাড়ি ভাঙচুর করে এবং ঘাতক ট্রাকসহ তিনটি গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। হাজার হাজার যানবাহন আটকা পড়ে এবং নিরীহ যাত্রীরা চরম ভোগান্তির শিকার হয়। এর পাশাপাশি কিছুদিন আগে সরকারের দুজন সচিব চালকসহ দ্রুতগামী বাসের ধাক্কায় মৃত্যুবরণ করেন। সরকারের একটি নতুন গাড়ি, যা দেশের সম্পদ, তাও নষ্ট হয়। কিন্তু এর জন্য জনগণ কোনো সড়ক বা রেলপথ অবরোধ করেনি, কোনো গাড়ি ভাঙচুর করা হয়নি। দুর্ঘটনাস্থলে কোনো স্পিডব্রেকার তৈরি করার কোনো দাবিও কেউ জানায়নি। জনতার আচরণে এই বৈপরীত্য কেন, তা ভেবে দেখার অবকাশ আছে বৈকি।
গত সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় দুজন সম্ভাবনাময় ছাত্র দুর্ঘটনায় মারা যান। তাঁদের বাবা-মায়ের ওপর যে কষ্ট ও দুঃখ নেমে আসে, তা অবর্ণনীয়। কারণ বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ দুনিয়ার সবচেয়ে ভারী বোঝা। তবে ওই ছাত্র যদি জেব্রা ক্রসিং বা ওভারব্রিজ দিয়ে পার হতেন, তবে হয়তো বা এ দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। প্রচলিত আইনে জেব্রা ক্রসিং ছাড়া অন্য জায়গা দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় দুর্ঘটনা হলে পথচারী দায়ী হবেন। আর দৌড়ে বাসে ওঠার সময় দুর্ঘটনা হলে সর্বদা যানচালককে দায়ী করা কি উচিত হবে? এ ছাড়া গত ২৭ সেপ্টেম্বর যুবলীগের দুই পক্ষের লড়াইয়ে এক পক্ষের নেতা নিহত হন। ফলে অপর পক্ষের লোকেরা সাড়ে তিন ঘণ্টা রাস্তা অবরোধ করে রাখেন। সিরাজগঞ্জে ট্রেনের নিচে কয়েকজনের মৃত্যুর জন্য গায়েবি জানাজা ঢাকার একটি প্রধান সড়ক বন্ধ না করে, জনগণের অসুবিধার কথা চিন্তা করে, কোনো মাঠে করা কি সম্ভব ছিল না?
বছরে প্রায় ১২ হাজার লোকের প্রাণহানি হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায়। দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, ট্রাফিক-ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনয়ন, গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ, চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকসহ সব ব্যক্তিকে ত্বরিত ও যথাযথ শাস্তি প্রদান করা সম্ভব হলেই কেবল এর হার কমানো যেতে পারে। সবাইকে আইন মেনে চলতে বাধ্য করুন। সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি, তা কথায় ও কাজে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে। সড়ক ও রেলপথ অবরোধ এবং এর ওপর কোনো বিক্ষোভ, সমাবেশ বা যেকোনো কার্যক্রম বেআইনি ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে। সবাইকে এ বিষয়গুলো ভেবে যথাযথ পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের অনুরোধ জানাচ্ছি।
মোহাম্মদ গোলাম মাওলা: অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল।

No comments

Powered by Blogger.