নূতন চন্দ্রের ছেলের দাবি-বাবাকে গুলি করেন সাকা

মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলেন চট্টগ্রামের কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহের ছেলে প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ (৭২)। বাবার হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে গতকাল বুধবার তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বলেন, '১৯৭১ সালের ১৩


এপ্রিল সকাল আনুমানিক ৯টা থেকে সাড়ে ৯টায় আমার বাবাকে মন্দিরের ভেতর থেকে টেনেহিঁচড়ে মন্দিরের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে। যখন আমার বাবা ছটফট করছিলেন, তখন আর্মিদের সঙ্গে থাকা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী পিস্তল দিয়ে তাঁকে আরো দু-তিনটি গুলি করে তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করে। এ কথা আমার দাদা চিত্তরঞ্জন সিংহ ও ব্রজহরি কর্মকারের কাছ থেকে শুনেছি।'
এদিকে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর অনুপস্থিতিতে বিচারকাজ মুলতবি রাখার আবেদন গতকাল খারিজ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এ আদেশের পর সাঈদীর বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তাকে জেরা করা হয়েছে। তবে উন্নত চিকিৎসার জন্য সাঈদীকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তির নির্দেশ দেওয়া হয়।
এ ছাড়া জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আগামী ৫ জুলাই সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করা হয়েছে। সাক্ষ্যগ্রহণের অংশ হিসেবে গতকাল রাষ্ট্রপক্ষের সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন শেষ হলে বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবিরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২ সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেন।
বাবার মুখে আগুনটুকু দিতে পারলাম না : গতকাল ট্রাইব্যুনাল-১-এ সাকা চৌধুরীর মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের পঞ্চম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ। জবানবন্দি দেওয়ার একপর্যায়ে তিনি আবেগ-আপ্লুত হয়ে বলেন, 'আমরা এতই অভাগা ছেলে যে বাবার মরদেহ দাহ করতে পারিনি। হিন্দু ধর্মের প্রথা অনুযায়ী সৎকারের সময় বাবার মুখে আগুনটুকু দিতে পারলাম না।'
প্রফুল্ল রঞ্জন বলেন, 'বজ্রহরি আমাকে জানান, ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার দিকে ব্রজহরিসহ পাঁচজন আমার বাবাকে বাড়ি থেকে সরানোর জন্য জোর করছিলেন। এ সময় তাঁরা পাকিস্তান আর্মির সঙ্গে (সে সময়ের স্বঘোষিত মেজর বা ব্রিগেডিয়ার) সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে আসতে দেখেন। তাদের দেখে তিনজন জঙ্গলের দিকে আর দুজন বাড়ির ওপরে উঠে পালিয়ে থাকেন। ব্রজহরি ওপর থেকে দেখেন, তারা বাবার কাছে এসে টাকা ও সোনা দাবি করে। বাবা তাদের সোনা দিলে তারা চলে যায়। কিন্তু তারা ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে আবার ফিরে আসে। পরে তাঁকে মন্দির থেকে বের করে হত্যা করে। আমার বাবাকে গুলি করে মারার পর তাঁর লাশ তিন দিন পড়ে ছিল ওই মন্দিরের সামনে। পরে এলাকার চেয়ারম্যান আমনত খাঁসহ পাশের গ্রামের বড়ুয়ারা এসে আমার বাবাকে সৎকার করেছেন বলে শুনেছি।'
নূতন চন্দ্রের ছেলে বলেন, 'আমার বাবা বার্মাতে থাকতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ সালে তিনি চট্টগ্রামে চলে আসেন। এরপর ১৯৪৬ সালে তিনি চট্টগ্রাম এবং কলকাতায় ওষুধ ও সাবানের কারখানা স্থাপন করেন। ১৯৫২ সালে ভারত বিভক্তির পর পাসপোর্ট প্রথা চালু হলে আমার বাবা স্থায়ীভাবে চট্টগ্রামে থেকে যান। তিনি চট্টগ্রামে বিভিন্ন মন্দির, স্কুল ও একটি মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।'
প্রফুল্ল বলেন, 'বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলনের পর সারা পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন শুরু হয়, যার ঢেউ রাউজানেও এসে লাগে। এ সময় আমি, আমার মেজো ভাই সত্য রঞ্জন, আবদুল ওহাব, নুরুল আমিন, আবদুল্লাহ আল নোমানসহ আমরা আবদুল্লাহ আল হারুনের নেতৃত্বে এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হই।' তিনি বলেন, '২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, যা আমরা পরের দিন এলাকার মাইকে শুনতে পাই। ২৫ মার্চ রাত থেকেই নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। ১১ এপ্রিল বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান আমাদের বাড়িতে আসেন। তিনি আমাকে বলেন, তোমাকে এখনই পালিয়ে যেতে হবে, নইলে পাক বাহিনী তোমাকে মেরে ফেলবে। তুমি পালিয়ে যাও। তার কথায় আমার স্ত্রী-সন্তান, দাদার স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও দিদির ছেলে-মেয়ে নিয়ে দুটি জিপগাড়িতে করে ভারতের রামগড় হয়ে সাবলুমের দিকে রওনা হই। সাবলুমে সবাইকে রেখে আমি আবার রামগড়ে এসে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে পাসপোর্ট ইস্যু করতে থাকি। এ সময় বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কিছু শরণার্থী আমাকে বলে, আপনি কি আপনার পরিবারের খবর জানেন? আমি বললাম, না। তখন তাদের মধ্য থেকে কেউ বলল, আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। কেউ বলল, গ্রেপ্তার করা হয়েছে। স্কুল হেডমাস্টার যতিশধর বললেন, হত্যা করা হয়েছে। পরে আমি দেশে এসে পুরো ঘটনা জানতে পারি।'
প্রফুল্ল রঞ্জন বলেন, '১৯৭২ সালে এ বিষয়ে একটি মামলা হয়। তখন এ মামলার চার্জশিটও হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে মামলাটি ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়েছিল। তারপর সে মামলার ভাগ্যে কী হয়েছিল, তা আমি জানি না।' এ পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল আজ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।
সাঈদীর মামলায় জেরা মুলতবির আবেদন খারিজ : বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১-এ গতকাল সকালে আদালতের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর সাঈদীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম মামলার তদন্ত কর্মকর্তার জেরা দুই দিনের জন্য মুলতবি রাখার আবেদন করেন। তিনি সাঈদীর বিষয়ে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের চিকিৎসকদের সনদ দেখিয়ে বলেন, সাঈদীর হৃৎপিণ্ডে চারটি ব্লক ধরা পড়েছে। চিকিৎসকরা আরো দুটি পরীক্ষা করতে বলেছেন। এ কারণে তাঁকে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নেওয়া প্রয়োজন। শুনানি শেষে বিচারক সাঈদীকে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে স্থানান্তরের নির্দেশ দেন এবং কারা কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে বলেন।
জেরা মুলতবির আবেদন খারিজ করে বলা হয়, দীর্ঘ সময় অসুস্থ থাকার ক্ষেত্রে মামলার কার্যক্রম মুলতবির কোনো সুযোগ আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে নেই।
এ আদেশের পর সাঈদীর আইনজীবীরা তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিনকে জেরা শুরু করেন।
গত ১৪ জুন প্যারোল পেয়ে বড় ছেলে রফিক বিন সাঈদীর জানাজায় অংশ নেন সাঈদী। এরপর নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়লে ট্রাইব্যুনালের আদেশে তাঁকে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সাঈদীর হৃদযন্ত্রে সফল অস্ত্রোপচার : এ দিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে মানবতাবিরোধী মামলার অপর আসামি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে গতকাল দুপুরে মিরপুরের ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে সাঈদীর হৃৎপিণ্ডের ধমনীর কয়েকটি ব্লক এনজিওপ্লাস্টির মাধ্যমে অপসারণ করা হয়। বর্তমানে তিনি হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) রয়েছেন।
সাঈদীর কৌঁসুলি তাজুল ইসলাম জানান, সাইদী চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। এর আগে গতকাল সকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাঁর আইনজীবীরা আবেদন করলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে পাঠানোর নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
১৩ জুন বড় ছেলের মৃত্যুর পর অসুস্থ হয়ে পড়েন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। তখন থেকে তিনি রাজধানীর ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ অবস্থায় গতকাল পরিবারের পক্ষ থেকে সাঈদীর উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে প্যারোলে মুক্তির আবেদন করা হয়। এ ছাড়া জাতীয় প্রেসক্লাবে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে ছেলেসহ পরিবারের সদস্যরা সাঈদীকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার জন্য আবেদন করে।
« পূর্ববর্তী সংবাদ
       

No comments

Powered by Blogger.