কলেরার টিকা বিতর্ক

সম্প্রতি কলেরা টিকার বৃহত্তম ট্রায়াল শুরু হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের ওপর। দুই লাখ ৫০ হাজার মানুষের ওপর কলেরা প্রতিরোধে ওই পরীক্ষা চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছে পরীক্ষা সংশ্লিষ্ট গবেষক। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, যদি এই পরীক্ষা সফল হয়, তাহলে কলেরা ডায়রিয়ার মতো জীবনঘাতী রোগের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিষেধক হিসেবে টিকাটি কাজ করবে। তবে এই পরীক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের জীবন সংশয়ের মধ্যে চলে যাবে কি না তা নিশ্চিত করতে পারেননি দেশের বিশেষজ্ঞরা।
ফ্রান্সের বিখ্যাত ওষুধ কম্পানি সনোফি এভেন্টিসের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ভারতীয় মালিকানাধীন ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান শান্তা বায়োটিকস সঞ্চল (ঝযধহঈযড়ষ) নামের একটি কলেরা টিকা আবিষ্কার করেছে। সঞ্চল নামের ওই কলেরা টিকাটি বাংলাদেশের দুই লাখ ৫০ হাজার মানুষের ওপর 'দিশারী' প্রকল্প নামে ট্রায়াল (পরীক্ষা) শুরু হয়েছে।
দিশারী প্রকল্পের এই ট্রায়াল কলেরার টিকা গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মিরপুরের ৯টি কেন্দ্রে সব বয়সের নারী-পুরুষ ও শিশুদের খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বৃহৎ ট্রায়াল ভ্যাকসিন কর্মসূচির উদ্বোধন করা হয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও ঢাকা সিটি করপোরেশন যৌথভাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে, যদি দিশারী প্রকল্পটির (পাইলট প্রজেক্ট) সফল হয় তাহলে সারা দেশে নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচির সঙ্গে কলেরার টিকাও সম্পৃক্ত করা হবে।
প্রথম ডোজ নেওয়ার ১৫-২৩ দিন পর দ্বিতীয় ডোজটি দেওয়া হবে। বছরব্যাপী এই ট্রায়াল ভ্যাকসিনের কর্মক্ষমতা পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ পর যদি সফল হন বিশেষজ্ঞরা; তবে এই ভ্যাকসিন পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় কাজে লাগানো হবে। ট্রায়াল ভ্যাকসিনের এই কর্মসূচির জন্য মার্কিন প্রতিষ্ঠান বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেইটস ফাউন্ডেশন অনুদান দিয়েছে। তবে এই ফলাফলের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসিও (সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন) উৎসুক। উল্লেখ্য, উচ্চমূল্যের কারণে এর আগে বাংলাদেশে কলেরার টিকা বা প্রতিষেধক দেওয়া হয়নি। পরীক্ষায় ব্যবহৃত টিকাটি বিগত যেকোনো টিকা থেকে স্বল্পমূল্যের বা ১০ ভাগের এক ভাগ।
মানবদেহে পরীক্ষাধীন এই প্রকল্পটি বাংলাদেশে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করবে আইসিডিডিআর,বি। কলেরা গবেষণা ও চিকিৎসা প্রদানে এই প্রতিষ্ঠানটির আন্তর্জাতিক পরিচিতি আছে। প্রতিষ্ঠানটির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. ফেরদৌস কাদরীকে প্রকল্প পরিচালক করা হয়েছে। ঢাকা এবং আশপাশের অঞ্চলগুলোর দরিদ্র মানুষের ওপর চালানো হবে এই পরীক্ষা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আখতারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পাইলট প্রজেক্টে এত মানুষকে গিনিপিগ বানানোর কোনো মানে নেই।' তিনি আরো বলেন, 'ডায়রিয়া প্রধানত পানি এবং পয়োনিষ্কাশনের কারণে হয়। এ বিষয়গুলো স্বাস্থ্যসম্মত হলে ডায়রিয়া এমনতিইে শূন্যের কোটায় চলে আসবে।'
ভিয়েতনাম থেকে বাংলাদেশে:
বাংলাদেশের মানুষকে গিনিপিগ বানানোর বিষয়টি এই প্রথম নয়। ডুকারল নামের একটি কলেরা টিকার পরীক্ষা করা হয়েছিল ১৯৮৫ থেকে '৮৮ সাল পর্যন্ত চাঁদপুরের মতলবে। ৮৯ হাজার ১৫২ মানুষের ওপর চালানের ওই গবেষণা থেকে আশানুরূপ ফল আসেনি। ওই গবেষণার ফল হলো প্রথম বছরে সাফল্যের হার ৮৫ শতাংশ হলেও পরের বছর টিকার কার্যকারিতা ৬৪ শতাংশে নেমে আসে। তৃতীয় বছরে টিকার কার্যকারিতা ৫২ শতাংশ মানুষের ওপর কার্যকর থাকে; যা চতুর্থ বছরে নেমে আসে মাত্র ১৯ শতাংশে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কলেরা টিকা দেওয়ার চেয়ে কলেরা হয় যে কারণে তা প্রতিরোধ করা দরকার।
ডুকারলের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমতি না পাওয়ার পেছনে কারণ টিকাটি মানবদেহে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সফল হয়নি। বাংলাদেশের মানুষের ওপর পরীক্ষার আগে ভারতীয় কম্পানিটি ১৯৯৭ সালে ভিয়েতনামে মানব দেহে পরীক্ষা চালিয়েছিল। সেখানেও সফলতার হার নগণ্য। টিকার সফলতার হার হিসেবে প্রশ্ন করা হলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ভিয়েতনামের উদাহরণটিই সামনে এনেছে। ভিয়েতনামে ঠিক কত পরিমাণ মানুষের ওপর এই টিকা পরীক্ষা করা হয়েছিল এবং ওই গবেষণায় সফলতার হার কত_স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সে প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলেও ভিয়েতনামে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, সে বিষয়টি সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন।
তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে জানা যাচ্ছে, এক থেকে ১৫ বছরের ৬৭ হাজার শিশু-কিশোরের ওপর ডুকারল পরীক্ষা করা হয়। ৬৭ হাজার শিশু-কিশোরের ওপর চালানো এই পরীক্ষা কার্যকর হয়েছে ৬৮ শতাংশ। ৬৮ শতাংশ সফল টিকা গ্রহণকারীর টিকাও আবার মাত্র দুই বছর সক্রিয় ছিল। দুই বছর পর থেকে টিকা কোনো কাজ দেয়নি কলেরা প্রতিরোধে। প্রাপ্ত ফল কম্পানিটিকে হতাশই করেছে।
বহুজাতিক কম্পানি বনাম অসহায় মানুষ:
বহুজাতিক কম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। কিন্তু মানুষের শরীরে নানা রকম পরীক্ষা বিশ্বব্যাপী কম্পানিগুলোর প্রতি জন-অসন্তোষ বাড়িয়ে দিয়েছে। বহুজাতিক ওষুধ কম্পানিগুলো মানব দেহে নানা ধরনের ওষুধ প্রয়োগ করে তার প্রতিক্রিয়া দেখে থাকে। দীর্ঘমেয়াদী সেই পরীক্ষার কারণে মানব দেহে ঘটে যাচ্ছে ভয়ংকর সব পরিবর্তন। ওষুধ কম্পানির পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়টি সব থেকে বেশি পরিমাণে হয়েছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে; তবে খোদ ধনতান্ত্রিক দেশগুলোও গিনিপিগ পরীক্ষার শিকার হয়েছে।
নাইজেরিয়ার ২০০ শিশুর ওপর মার্কিন কম্পানি ফাইজার মেনিনজাইটিস রোগের ওষুধের পরীক্ষা চালায়। পরীক্ষার শিকার ওই শিশুদের অনেকেই পরবর্তী সময়ে মৃত্যুবরণ করে। বাকিরা নানা রকম সমস্যায় আক্রান্ত হয়। নাইজেরিয়ান সরকার কম্পানিটির কাছে ক্ষতিপূরণ চাইলে কম্পানিটি নানা রকম টালবাহানা শুরু করে। অবশেষে চলতি বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি মার্কিন সরকারের হস্তক্ষেপে বিষয়টি ফয়সালা হয়। ফাইজারকে এ কারণে শিশুপ্রতি এক লাখ ৭৫ হাজার মার্কিন ডলার গুনতে হবে।
উগান্ডা, কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশের এইচআইভি (ঐওঠ অরফং) প্রতিষেধক হিসেবে হবারৎধঢ়রহব নামের একটি ওষুধ দেওয়া হয় বিভিন্ন বয়সের মানুষকে। ওষুধ গ্রহণকারীদের মধ্যে গর্ভবতী নারীও রয়েছে। ওষুধের ফলাফল হিসেবে যা বেরিয়ে এসেছে তা ভয়াবহ। গর্ভবতী নারী ও নবজাতক শিশুও এইচআইভি রোগে আক্রান্ত হয়েছে! বিষয়টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইউনাইটেড স্টেট ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ (এনআইএইচ) এক গবেষণায় উল্লেখ করে।
তবে মার্কিন নারীরাও বাদ পড়েনি নেভিরাপাইনের পরীক্ষা থেকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধটির নাম ারৎধসঁহব নামে পরীক্ষা চালানো হয়। তবে অবাক হওয়ার মতো বিষয় যে ওষুধটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের পৃষ্ঠপোষকতায় বাজারজাত করা হয়ে থাকে। বিবিসি ও ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স ইন সোসাইটির মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দরিদ্র জনগণের ওপর এইচআইভি ট্রায়াল ওষুধ পরীক্ষা করা হয়। প্রধানভাবে ট্রায়াল ড্রাগের শিকার আফ্রিকান-আমেরিকান এতিম বালক-বালিকারা, যারা চার্চ পরিচালিত বিভিন্ন এতিমখানায় থাকে। মার্কিন সরকার ট্রায়াল ড্রাগের ব্যাপারে নীরবে সমর্থন দিয়ে এসেছে; যার শিকার হয়েছে দরিদ্র নারী ও শিশুরা।
শিল্প বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বিজ্ঞান ব্যাপক বিকাশ লাভ করে। বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ শাখা চিকিৎসাবিজ্ঞান সেই বিকাশে সভ্যতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে অন্যান্য বিজ্ঞানের মতো চিকিৎসাবিজ্ঞানও বহুজাতিক কম্পানির মুনাফা তৈরির যন্ত্র হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। এই সময় থেকেই মূলত ওষুধ তৈরির বড় বড় কম্পানিগুলো রোগের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থার আবিষ্কার থেকে কিভাবে মুনাফার জন্য আরো অধিক হারে ওষুধের ওপর মানুষের নির্ভরশীলতা বাড়ানো যায় তার ওপর বিস্তারিত গবেষণাকর্ম শুরু করে। নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ বহুজাতিক কম্পানির এই আক্রমণ কিভাবে প্রতিরোধ করবে_সেটাই এখন ভাবার বিষয়।
এথিক্যাল কমিটি কি সক্রিয়?:
বাংলাদেশে যদি কোনো ওষুধ ট্রায়াল বা পরীক্ষা করতে হয় তার জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে এথিক্যাল কমিটির অনুমোদন। কমিটির অনুমোদনের পর যার ওপর প্রয়োগ করা হবে তাকে বিষয়টি বিস্তারিত জানানো হবে যে ওষুধটি ট্রায়াল বা পরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে। যার দেহে ওষুধটি পরীক্ষা করা হবে যদি তিনি সজ্ঞানে রাজি থাকেন এবং লিখিত অনুমতি দেন তবেই ওষুধটি পরীক্ষা করা যাবে। তথ্য গোপন করে কোনো ব্যক্তির ওপর কোনো ওষুধ পরীক্ষা করা যাবে না। তবে এথিক্যাল কমিটির পক্ষ থেকে এ সব বড় ট্রায়ালে কিভাবে মনিটর করা হয় বা আদৌ মনিটর করার মতো লোকবল আছে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কলেরার এই টিকা পরীক্ষার ব্যাপারে সরকারের অনুমতি নেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে আইসিডিডিআর,বি কর্তৃপক্ষ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এথিক্যাল কমিটির কাছ থেকে অনুমতি নিলেও যাদের ওপর সঞ্চল নামের টিকাটি প্রয়োগ করা হয়েছে, তাদের জানানো হয়নি যে টিকাটি পরীক্ষাধীন রয়েছে। এমনকি তাদের কাছ থেকে লিখিত কোনো অনুমতিও নেননি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। এ বিষয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিনের প্রবীণ অধ্যাপক নাম না প্রকাশ করার শর্তে কালের কণ্ঠকে জানান, 'না জানিয়ে কারো ওপর কোনো ধরনের ওষুধ পরীক্ষা করা খুবই অন্যায়।'
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, না জানিয়ে কারো ওপর কোনো ধরনের পরীক্ষা করা ফৌজদারি দণ্ডবিধির আওতায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

No comments

Powered by Blogger.