বাসচাপায় সহকর্মীর মৃত্যু-চট্টগ্রামে পোশাক শ্রমিকদের ভাঙচুর বাসে আগুন

চট্টগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় সহকর্মীর মৃত্যুর ঘটনায় তৈরি পোশাক কারখানার কয়েক হাজার শ্রমিক রাস্তায় নেমে ভাঙচুর করেছে। অন্তত তিন হাজার শ্রমিক নগরের ব্যস্ততম একটি সড়ক অবরোধ করে যানবাহন, হোটেল ও বীমা অফিস ভাঙচুর করে। তারা দুটি বাসেও আগুন ধরিয়ে দেয়।


গতকাল বুধবার সকালে নগরের বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, বন্দর, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলমুখী (ইপিজেড) সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশ রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। অন্যদিকে, বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে। এতে শ্রমিক, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীসহ অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছে।
পরে নিহত শ্রমিকের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ এবং তাঁর স্ত্রীকে চাকরি দেওয়ার আশ্বাস পেয়ে কাজে ফিরে যায় শ্রমিকরা।
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ওই শ্রমিকের নাম পিন্টু দাশ (৩৫)। আগ্রাবাদের আনোয়ারা ড্রেস মেকারস লিমিটেড নামের একটি পোশাক কারখানার সুপারভাইজার ছিলেন তিনি। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে কর্মস্থলের কাছাকাছি রাস্তা পার হওয়ার সময় একটি যাত্রীবাহী বাস তাঁকে চাপা দেয়। তাঁকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তাঁর।
পিন্টু নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার চরকিন দাশপাড়ার উপেন্দ্র কুমার দাশের ছেলে। তাঁর দুটি সন্তান রয়েছে।
ডবলমুরিং থানার ওসি মতিউল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, ভাঙচুর ও বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় দুটি মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে।
শ্রমিকরা জানায়, বাসের ধাক্কায় আহত পিন্টুর মুখ, নাক ও কান দিয়ে রক্ত পড়া শুরু হয়। কয়েকজন শ্রমিক তাঁকে হাসপাতালে পাঠায়। অন্য কয়েকজন শ্রমিক প্রায় এক শ গজ ধাওয়া করে চিটাগাং স্টক একচেঞ্জ এলাকায় বাসটি আটক করে। তবে বাসের চালক ও তার সহকারী পালিয়ে যায়। পরে শ্রমিকরা গাড়িটি ভাঙচুর করে। ঘটনাস্থল থেকে ৩০ গজ দূরে পিন্টু কর্মস্থলে তাঁর আহত হওয়ার খবর পৌঁছালে সহকর্মীরা রাস্তায় নেমে আসে। তারা কাজে যোগ দিতে আসা অন্যদেরও ডেকে নিয়ে আসে। এরপর শুরু হয় এলোপাতাড়ি গাড়ি ভাঙচুর। অন্তত ১০টি যানবাহন ভাঙচুর করে তারা। একপর্যায়ে তারা দুটি বাসে আগুন দেয়। পাশের জীবন বীমা ভবন ও এম্ব্রোশিয়া নামের একটি রেস্টুরেন্টে ভাঙচুর করে তারা।
সড়ক দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কারখানার শ্রমিক মো. রমজান আলী সাংবাদিকদের বলেন, 'একাধিকবার সিগন্যাল দেওয়ার পরও বাসটি না থামিয়ে তাঁকে চাপা দেয়। এই দৃশ্য দেখে অন্য শ্রমিকরা উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং ভাঙচুর চালায়।'
রমজান আরো বলেন, 'পুলিশ কয়েকজন নারী শ্রমিককে ওই ভবনে নিয়ে আটকে রেখেছে- এমন খবর শুনে শ্রমিকরা সেখানে গিয়ে ভাঙচুর করে।'
শ্রমিকরা অভিযোগ করে, দুর্ঘটনার পর স্টক একচেঞ্জের সামনে একজন সার্জেন্টসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য উপস্থিত থাকলেও তাঁরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ নেননি। এ ছাড়া পুলিশ বিনা কারণে শ্রমিকদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছুড়েছে। এতে নারী শ্রমিকসহ অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছে। একজন নারী শ্রমিকের পিঠে রাবার বুলেট বিদ্ধ হয়েছে।
চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সচিব ওসমান গণি চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'অফিসের উদ্দেশে যাওয়ার সময় সকাল সাড়ে ৯টায় আগ্রাবাদ মোড়ে আটকা পড়ি। প্রথমে মনে হয়েছিল ট্রাফিক জামে আটকা পড়েছি। এমন সময় আচমকা ইটপাটকেল পড়া শুরু হয়। দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার ১৫ সেকেন্ডের মধ্যেই পুরো গাড়িটি ভেঙে চুরমার করে শ্রমিকরা।'
বাসে আগুন দেওয়ার খবর পেয়ে আগ্রাবাদ ও নিউমুরিং ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। তবে তাঁরা শ্রমিকদের হামলার শিকার হয়ে পিছু হটেন। পরে পুলিশ ও র‌্যাবের পাহারায় বাসের আগুন নেভানো হয়।
আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের টেলিফোন অপারেটর সাহিদুর রহমান বলেন, শ্রমিকদের ইটপাটকেলের আঘাতে আহত হন স্টেশনের উপপরিচালক মো. জসিম উদ্দীন, সিনিয়র স্টেশন কর্মকর্তা মো. ফরিদ আহমদ ও নিউমুরিং ফায়ার স্টেশনের ফায়ারম্যান মো. আলাউদ্দিন। তাঁদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশকে সহযোগিতার পর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের গোসাইডাঙ্গা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও চট্টগ্রাম জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, 'কারখানা কর্তৃপক্ষ ও বাস মালিক নিহত পিন্টু দাশের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিয়েছেন। প্রায় দুই লাখ টাকা সাহায্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি পিন্টুর স্ত্রীকে চাকরির আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।'
নগর পুলিশের (সিএমপির) উপকমিশনার (পশ্চিম) মো. হাবিবুর রহমান বলেন, 'ঘটনার পর পরই অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ মৃদু লাঠিপেটা করেছে। তবে পুলিশ ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে।'
র‌্যাব-৭-এর উপ-অধিনায়ক মেজর জিয়াউল আহসান সরওয়ার বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ১৩৫ জন র‌্যাব সদস্য মোতায়েন করা হয়। তবে তাঁদের অ্যাকশনে যেতে হয়নি।
ডবলমুরিং থানার ওসি মতিউল ইসলাম জানান, ঘটনার সময় তিনিসহ সাত পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ২৭ রাউন্ড কাঁদানে গ্যাস ও ১৯টি রাবার বুলেট ছুড়তে হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
বহিরাগতরা উসকে দিয়েছে : ভাঙচুরের ঘটনায় পোশাক কারখানার শ্রমিকরা ছাড়াও কিছু বহিরাগত যুবক জড়িত ছিল। তারাই শ্রমিকদের উসকে দিয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। পুলিশের উপকমিশনার (পশ্চিম) মো. হাবিবুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, 'প্রথম দফায় ভাঙচুর শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই শ্রমিকরা শান্ত হয়ে যায়। কিন্তু এর পর পরই ডেবারপাড় এলাকা থেকে কিছু যুবক এসে শ্রমিকদের উসকে দেয় এবং আবার ভাঙচুর শুরু করে। এতে বোঝা যায়, গার্মেন্ট শ্রমিকদের বহিরাগতরা উসকে দিয়েছে।'
ঢাকার আশুলিয়ার মতো অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির কৌশল ওই বহিরাগতরা নিয়েছিল কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।

No comments

Powered by Blogger.