আদালত-বিচারক নিয়োগে নতুন শর্ত কতটা যুক্তিযুক্ত? by ওমর হাসান আল জাহিদ

ভর্তি পরীক্ষা মেধা তালিকায় প্রথম সারিতে থাকা শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দই হলো আইন বিষয়ে অধ্যয়ন করা। নতুন শর্তারোপের ফলে যদি আইনের মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিচারপতি হতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন এবং নিম্ন আদালতে কম মেধাবীরা বিচারপতি হিসেবে যোগ দেন, তাহলে তার দায়ভার কে নেবে?


বিগত কয়েকদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থীরা সহকারী বিচারক নিয়োগ পরীক্ষায় নতুন শর্তারোপের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তার প্রতিবাদ করে আসছে। গত ৩ মে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এবং গত ৯ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে তারা মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে এবং সংবাদ সম্মেলন করেছে, যা দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে। জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে স্মারকলিপিও প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এখন পর্যন্ত কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এ ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ফলে শিক্ষার্থীরা রয়েছে অনিশ্চয়তায়।
প্রতিবাদ কর্মসূচির সূত্রপাত হয় গত ২ এপ্রিল রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে 'পার্বত্য চট্টগ্রামে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা : জজ আদালত স্থাপন ও পরবর্তী করণীয়' শীর্ষক কর্মশালায় প্রদত্ত মাননীয় প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের সূত্র ধরে। একটি জাতীয় দৈনিকে ৩ এপ্রিল প্রকাশিত প্রতিবেদনে উলেল্গখ করা হয়, 'বিচারক সংকট নিরসনে আরও ১০১ জন সহকারী বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন আছে বলে জানিয়ে এবিএম খায়রুল হক বলেন, আরও ১৫০ জন সহকারী বিচারক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে আবেদনকারীর বয়সসীমা ৩২ করা হচ্ছে। তবে বার কাউন্সিল পরীক্ষায় পাস করাসহ কয়েকটি শর্তও থাকছে। বর্তমানে এটা রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।'
যুক্তিসঙ্গত কারণে নতুন শর্তারোপের প্রস্তাবটি আইন শিক্ষার্থীদের মাঝে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। বিচার বিভাগ স্বাধীন হওয়ার পর জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের অধীনে তিনবার সহকারী বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিগত তিনটি পরীক্ষায় যারা সহকারী বিচারক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের সবার প্রাতিষ্ঠানিক ফল ভালো। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরাই সহকারী বিচারক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। ফলে নিম্ন আদালতে গত কয়েক বছরে এক ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়েছে। নিম্ন আদালত থেকে গত কয়েক বছরে বেশ কিছু স্বপ্রণোদিত রুল জারি হওয়াই তার প্রমাণ। নতুন শর্তারোপের কারণ হিসেবে দক্ষতা বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু গত কয়েকটি পরীক্ষায় নিয়োগ পাওয়া সহকারী বিচারকদের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত অদক্ষতা, অনভিজ্ঞতা, বিচারিক প্রজ্ঞা কিংবা সামর্থ্যের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। এমতাবস্থায় নতুন শর্তারোপের যৌক্তিকতা কোথায়, তা সুস্পষ্ট নয়।
শর্তারোপের প্রস্তাবটি অনুমোদন পেলে তা বিচারক হওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি করবে, যা মেধাবীদের বিচারপতি হতে অনুৎসাহিত করবে। বার কাউন্সিলের সদস্য হওয়া একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। আইন বিষয়ে স্নাতক উত্তীর্ণ হওয়ার পর কমপক্ষে এক থেকে দেড় বছর লেগে যায় বার কাউন্সিলের সদস্য হতে। তাছাড়া বার কাউন্সিলের পরীক্ষায় নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণী পাওয়া এবং সহকারী জজ নিয়োগ পরীক্ষার মেধা তালিকায় উপরের দিকে থাকা প্রার্থীদের মূল্যায়নপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে অকৃতকার্য করার লজ্জাজনক নজিরও রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে নতুন শর্তারোপ শুধু যে মেধাবীদের বিচারপতি হতে অনুৎসাহিত করবে তাই নয়, একে কেন্দ্র করে বার কাউন্সিলের সনদ অর্জনে যে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়, তাকেও উস্কে দেওয়া হবে। সুতরাং এ ব্যাপারটিতে নতুন করে ভাবার অবকাশ রয়েছে। বার কাউন্সিলের সদস্য হওয়ার প্রক্রিয়া আগে স্বচ্ছ করতে হবে। পাশাপাশি যাতে স্বল্প সময়ে বার কাউন্সিলের সদস্য হওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় সে ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বিসিএস ক্যাডাররা যেখানে কোনোরূপ অতিরিক্ত শর্ত ছাড়া এবং অনেক ক্ষেত্রে সংশিল্গষ্ট পেশায় পূর্ব পড়াশোনা ছাড়াই আবেদন করার যোগ্যতা রাখেন, সেখানে আইনের শিক্ষার্থীদের চার বছরের স্নাতক ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন পরীক্ষা দেওয়ার জন্য বার কাউন্সিলের সদস্য হওয়া ও অন্যান্য শর্ত কতটা যৌক্তিক?
বর্তমান শর্তারোপের পক্ষে একটি যুক্তি হতে পারে যে, প্রত্যক্ষ বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে আইনের শিক্ষার্থীদের কোনো ধারণা কিংবা অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায়োগিক আইন তথা প্রসিডিউরাল ল'র ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়। তৃতীয় বা চতুর্থ বর্ষে পড়াকালেই ক্লিনিক্যাল লিগ্যাল এডুকেশন, মুট কোর্ট প্রতিযোগিতা ইত্যাদিসহ সিনিয়রদের সঙ্গে আদালতে প্রত্যক্ষ বিচার প্রক্রিয়ায়ও অংশগ্রহণ করে। উলেল্গখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ আয়োজিত মুট কোর্টে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকসহ দেশের প্রখ্যাত আইনবিদরা উপস্থিত থাকেন। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ থেকে আইন শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মুট কোর্ট প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে। সুতরাং বার কাউন্সিলের সনদ না থাকা মানে প্রত্যক্ষ বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানে না বা অজ্ঞ, এমন দাবি সম্পূণরূপেই অযৌক্তিক।
বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার মেধা তালিকায় প্রথম সারিতে থাকা শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দই হলো আইন বিষয়ে অধ্যয়ন করা। অর্থাৎ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষার্থীরা নিঃসন্দেহে দেশের সেরা মেধাবী শিক্ষার্থী। তাদের অনেকেরই স্বপ্ন, বিচারপতি হিসেবে নিজেকে আত্মোৎসর্গ করে দেশের বিচার ব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন নিয়ে আসা এবং বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা। নতুন শর্তারোপের ফলে যদি আইনের মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিচারপতি হতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন এবং নিম্ন আদালতে কম মেধাবীরা বিচারপতি হিসেবে যোগ দেন, তাহলে তার দায়ভার কে নেবে?

ওমর হাসান আল জাহিদ : শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
 

No comments

Powered by Blogger.