চিকিৎসাসেবার তুলনামূলক চিত্র by শাহনেওয়াজ বিপ্লব

বাংলাদেশের অন্য আরো ১০টি ক্ষেত্রের মতো চিকিৎসা ক্ষেত্রেও এক হতাশাজনক চিত্রের সাক্ষাৎ মেলে। ছোটবেলায় ডাক্তারদের সেবার মহোত্তম কাহিনীগুলো শুনতাম দাদি, নানি আর ফুপু-খালাদের মুখে। গ্রামের কোনো কোনো ডাক্তার নিজ থেকেই খবর নিতেন রোগীদের, তাঁর ব্যবস্থাপত্র দেওয়া রোগীদের সর্বশেষ অবস্থা জানার জন্য।


আর এখন ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা ফি দেওয়ার পরও ডাক্তারদের সঙ্গে তিন থেকে পাঁচ মিনিট অসুখের কথা চালিয়ে যাওয়া দুরূহ। তবে এর বাইরেও যে মার্জিত আর পরোপকারী ডাক্তার নেই, তা বলছি না, কিন্তু সে সংখ্যা নগণ্য। ধান ভানতে শিবের গীত দিয়েই শুরু হোক। অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় বসবাস করছি সাত বছর ধরে। গত অর্ধশতাব্দী ধরে চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান গবেষণায় অস্ট্রিয়া বিশ্বে প্রথম সারির দেশগুলোর একটি। ওখানকার চিকিৎসা ও সেবার সঙ্গে বাংলাদেশের চিকিৎসা আর সেবার মানের তুলনা করাটা খুব বেমানান। ওখানে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অথবা ডায়াগনসিসের জন্য ডাক্তারদের কোনো ফি দিতে হয় না জনগণকে। ফার্মেসি থেকেও ওষুধ কিনতে হয় না নিজের খরচে। রাষ্ট্র সেখানে স্বাস্থ্যসেবাকে মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে নিশ্চিত করেছে। তা ছাড়া ওখানকার চিকিৎসকদের সঙ্গে আমাদের চিকিৎসকদের তুলনাই করা যায় না। এক. অস্ট্রিয়ায় ডাক্তাররা রোগীর অথবা রোগীর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দুর্ব্যবহার বা অসংযত আচরণ করতে পারবেন না। দুই. ব্যবস্থাপত্র দেওয়ার আগে রোগীর কেস-হিস্ট্রি অথবা চিকিৎসা-ইতিহাস শুনতে হবে নিরুদ্বিগ্ন হয়ে। তিন. রোগীর মনস্তাত্তি্বক আকাঙ্ক্ষার গতি-প্রকৃতি মূল্যায়ন করতে হবে। চার. চিকিৎসাধীন থাকা ডাক্তারের চিকিৎসা-মান নিয়ে অসন্তুষ্ট রোগীকে সরাসরি জিজ্ঞেস করতে হবে, সে অন্য কোনো ডাক্তারের চিকিৎসা নিতে আগ্রহী কি না? পাঁচ. সিরিয়াল দেওয়া রোগীদের নির্ধারিত সময়ের ১০ থেকে ১৫ মিনিটের বেশি বাইরে বসিয়ে রাখা হয় না। এবার আসা যাক অস্ট্রিয়ার ডাক্তারদের চিকিৎসা আর সেবার কথায়। ওখানকার বেশির ভাগ ডাক্তারই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন না। দুয়েকজন করলেও রোগীরা তাঁদের ব্যবস্থাপত্র নেন না। ফলে শেষ পর্যন্ত সরকারি চাকরিতেই ফিরে আসতে হয় ডাক্তারদের। একজন ডাক্তার তৈরি করতে সাধারণ জনগণের বিপুল অঙ্কের করের টাকা ব্যয় হয় বলে ওখানকার ডাক্তাররা সনদ অর্জন শেষে সরকারি হাসপাতালগুলোতেই ফিরে আসেন চিকিৎসাসেবা দিতে। আমাদের দেশের মতো ক্লিনিক-ব্যবস্থা ওই দেশে নেই। ধনী-গরিব সবার জন্যই সমান সুবিধা নিয়েই সদা-উন্মুক্ত সরকারি সব হাসপাতাল। সেখানকার ডাক্তাররা মনে করেন, ডাক্তার হওয়া মানে জনগণের অর্থে গড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে আবার জনসাধারণের কাছে ফিরে আসা। জনগণের যথাযথ চিকিৎসার অধিকার নিশ্চিত করাকেই তাঁরা কর্তব্য বলে গণ্য করেন। ডাক্তাররা ওখানে অন্য ১০ জনের মতোই সাধারণ মানুষ। পেশার বাইরে তিনি ফুটবল খেলেন, পাড়ার ক্লাবের জন্য চাঁদা তোলেন, সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখেন অথবা গবেষণায় নিবিষ্ট হন। আর আমাদের এখানে? এখানে ডাক্তারদের দম ফেলার ফুরসত নেই। দৌড় আর দৌড়। এক চেম্বার থেকে আরেক চেম্বার। এক ক্লিনিক থেকে আরেক ক্লিনিক। আগেই বলেছি, এর ব্যতিক্রম যা লক্ষ্য করা যায়, তা উল্লেখ করার মতো নয়। রোগীদের কথা দূরে থাক, সম্ভবত নিজের পরিবার-পরিমণ্ডলের অভিযোগ শোনার সময়ও তাঁদের নেই। যে গরিব মানুষটি দুই বেলা খেতে পান না, সেই গরিব মানুষটির জন্য সপ্তাহে একদিন বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার কথা তাঁদের সিংহভাগই ভাবতে পারেন না। তাঁদের অনেকেই ভুল চিকিৎসায় কোনো দুঃখ প্রকাশ করেন না। আমাদের দেশে ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হলে রোগীর আত্মীয়স্বজন কোনো ডাক্তারের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছেন বলে আমার জানা নেই। অনেক ডাক্তারের এই ঔদাসীন্য, সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধের অভাব, অমানবিক আচরণ আজকের সমাজব্যবস্থায় স্বাস্থ্যক্ষেত্রে এক উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা চিকিৎসাসেবাকে অধিকার ঘোষণা করেই দায়িত্ব শেষ করেছে। যাদের টাকা নেই, তাদের জন্য চিকিৎসা ও সেবা কোনোটাই নেই। সরকারি হাসপাতালগুলোর ব্যাপারে একসময় বলা হতো, ওখানে চিকিৎসা পাওয়া যায়, সেবা পাওয়া যায় না। কিন্তু সেখানে গেলে এখন সেবা পাওয়া তো দূরে থাক, চিকিৎসাও পাওয়া যায় না। চিকিৎসাসেবার মানকে কোনো একটি কাঠামোতে দাঁড় করাতে পারেনি আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র। এর ফলে অনেক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগ নির্ণয়ের নামে চলছে গলাকাটা ব্যবসা। যে দেশের রাজনীতি রুগ্ণ, রুগ্ণ রাষ্ট্রযন্ত্র, সে দেশে ডাক্তারদের কাছ থেকে মানবিক আচরণ পাওয়া কতটুকু সম্ভব? এসব কারণে এ দেশে যথাযথ চিকিৎসাসেবা পাওয়া আজ স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লেখক : গবেষক, তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ, ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়
shahnewaybiplob@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.